কালীপুজো-দীপাবলি: চলুন দর্শন করে আসি রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত, শ্রীরামকৃষ্ণ স্মৃতিধন্য ভবতারিণীকে

Bhabatarini temple, Dakshineshwar

শুভদীপ রায় চৌধুরী

কালীপুজো-দীপাবলি দোরগোড়ায়। চলুন ঘুরে আসি দক্ষিণেশ্বর থেকে। দর্শন করে আসি রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও মা সারদার স্মৃতিধন্য ভবতারিণীকে।   

ভবতারিণী মন্দিরের কথা বললে প্রথমেই মনে পড়ে যায় রানি রাসমণির কথা। রাসমণির জন্ম ১২০০ বঙ্গাব্দ তথা ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। জন্মেছিলেন হালিশহরে, বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী এক কৈবর্ত পরিবারে, পিতা হরেকৃষ্ণ দাস। হরেকৃষ্ণ দাসের তিনটি সন্তান – প্রথম রামচন্দ্র, দ্বিতীয় গোবিন্দ এবং তৃতীয় রাসমণি। কলকাতার এক প্রাচীন মাহিষ্যবংশীয় ধনাঢ্য জমিদারবাড়িতে রাসমণির বিয়ে হয়েছিল। স্বামী রাজচন্দ্র দাস। পরে তিনি ‘রায়’ উপাধি পাওয়ায় রায় রাজচন্দ্র দাস নামে পরিচিত হন। রাসমণি ছিলেন রাজচন্দ্রের দ্বিতীয় পত্নী। রাজচন্দ্রের পিতা প্রীতিরাম (ওরফে প্রীতরাম) পুত্রের প্রথম বিয়ে দেন ১৮০২ সালে (১২০৯ বঙ্গাব্দে), কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেই বছরেই রাজচন্দ্রের স্ত্রী-বিয়োগ হয়। তার পর রাজচন্দ্রের আবার বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে মনস্থ করেন প্রীতিরাম।

রাজচন্দ্র প্রায়ই পুণ্যপর্বাদি উপলক্ষ্যে নৌকাযোগে ত্রিবেণী যেতেন। রাসমণিকে ত্রিবেণীতেই প্রথম দেখেন রাজচন্দ্র এবং সেই কন্যাকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত করেন। অবশেষে ১২১১ বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখ (১৮০৪ খ্রিঃ) রাজচন্দ্রের সঙ্গে রাসমণির বিয়ে হয়। রাজচন্দ্র তখন ২১ বছরের যুবক, রাসমণির ১১ বছর। রাজচন্দ্র বাস করতেন ৭১ নং ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের পৈতৃক দোতলা বাড়িতে। কয়েক বছর পর তাঁর এই বাড়ির সংলগ্ন সাড়ে ছ’ বিঘা জমিতে একটি প্রাসাদোপম দোতলা ভবন নির্মাণ করান। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ৮ বছর (১২২০-১২২৮ বঙ্গাব্দ) এবং খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। এটাই বর্তমানে রাসমণির বাড়ি বলে পরিচিত।

মা ভবতারিণী।

রাজচন্দ্র-রাসমণির চার কন্যাসন্তান – পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী ও জগদম্বা। রাজচন্দ্র দাসের জীবদ্দশাতেই তাঁর কন্যাদের বিবাহ হয়। জামাইদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম মথুরামোহন বিশ্বাস, দক্ষিণেশ্বরে মন্দির নির্মাণ এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনার ক্ষেত্রে যাঁর সবিশেষ ভূমিকা ছিল। তৃতীয়া কন্যা করুণাময়ীর সঙ্গে বসিরহাটের মথুরামোহনের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছর পরে করুণাময়ীর মৃত্যু হলে মথুরামোহনের সঙ্গে কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বার বিয়ে দেন রাজচন্দ্র-রাসমণি।

মাত্র ৫৩ বছর বয়সে রাজচন্দ্র দাস প্রয়াত হন। দিনটা ছিল ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন। জমিদারির হাল ধরেন রানি রাসমণি। এবং তখন থেকেই তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন লোকমাতা।

শৈশব থেকেই রাসমণি ঈশ্বর-অনুরাগী ছিলেন। হালিশহরের বাড়িতে গৃহদেবতা রঘুনাথজিউ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসেও ঠাকুরঘর পরিষ্কার, ফুল তোলা-সহ পুজোর যাবতীয় কাজ নিজ হাতে করতেন রাসমণি। ১৮৪৭ সালে রানি রাসমণি ঠিক করলেন কাশীতে গিয়ে মা অন্নপূর্ণা ও বাবা বিশ্বনাথের পুজো দেবেন। সেইমতো আত্মীয়-পরিজন, রক্ষী, দাস-দাসী, রসদ ইত্যাদি নিয়ে ২৪টি নৌকা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। যাত্রার আগের দিন রাতে রাসমণি স্বপ্নাদিষ্ট হন। স্বপ্নে জগজ্জননী বলেন, “কাশী যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ভাগীরথী তীরে মনোরম স্থানে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা ও ভোগের ব্যবস্থা করো। আমি ওই মূর্তিতেই আবির্ভৃতা হয়ে তোমার নিত্যপূজা গ্রহণ করব।”

রানি রাসমণি মন্দির-নির্মাণে উদ্যোগী হলেন। জমির সন্ধান শুরু হল। প্রথমে তাঁর জন্মস্থান কুমারহট্ট হালিশহরে মন্দিরের জন্য জমির খোঁজ করেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ-প্রধান হালিশহরের গোঁড়া সমাজপতিরা তাঁর ইচ্ছের মান দেননি। রানির অনুরোধে তাঁরা সদর্পে বলেন, জেলের মেয়ের মন্দির তৈরির অধিকার নেই। বর্ণশ্রেষ্ঠরা বাধা দেওয়ায় হালিশহরে কেউ জমি দিতে চাননি। 

গঙ্গা থেকে দ্বাদশ শিবমন্দির ও ভবতারিণী মন্দির।

তার পর বারাণসী-সমতুল গঙ্গার পশ্চিম কূলের বালি, উত্তরপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে জমি সংগ্রহের চেষ্টা করেন রানি। কিন্তু ওই সব অঞ্চলের ‘দশ আনি’, ‘ছয় আনি’ জমিদাররা প্রচুর অর্থের বিনিময়েও কোনো জমি বিক্রি করতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত গঙ্গার পূর্ব কূলে দক্ষিণেশ্বরে মন্দির নির্মাণের উপযুক্ত জমি পান এবং সেখানেই মন্দির তৈরি শুরু হয়।

কলকাতা থেকে ৫ মাইল উত্তরে গঙ্গার পূর্ব কূলে অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনায় দক্ষিণেশ্বর গ্রাম। মাঝে মাঝে জঙ্গল, বাগান, পুষ্করিণী, কবরস্থান এবং সরকারি বারুদখানা নিয়ে এই দক্ষিণেশ্বর। বারুদখানার সূত্রে কিছু ইংরেজ ও স্থানীয় জমিদারের যাতায়াত ছিল। কিছু হিন্দুর সঙ্গে কয়েক ঘর মুসলমান এবং ইংরেজেরও বসতি ছিল। ইংরেজদের গির্জা না থাকলেও মুসলমানদের মাজার ও দরগা ছিল। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছেই মোল্লাপাড়ায় একটি মসজিদ রয়েছে, যেখানে এক সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলাম ধর্মসাধনের জন্য নামাজ পড়তে যেতেন।

স্থানের নাম দক্ষিণেশ্বর, সুতরাং মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, তা হলে কি এখানে শিবের কোনো মন্দির আছে? এর উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, বহু কাল আগে দেউলিপোতার জমিদার নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এখানে শিবলিঙ্গের সন্ধান পান। তাঁর নিত্য পূজার্চনা শুরু করেন তিনি। দক্ষিণবঙ্গে শিবটি প্রাপ্ত হওয়ার ফলে তিনিই নাকি শিবের নামকরণ করেন ‘দক্ষিণেশ্বর’। সেই নামানুসারে স্থানেরও নাম হয় দক্ষিণেশ্বর। দক্ষিণেশ্বরের শিবতলাঘাটের বুড়োশিবকেই সবাই দক্ষিণেশ্বর শিব বলে মনে করেন।

রানি রাসমণির দলিল থেকে জানা যায় যে, তিনি এখানকার মোট সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা জায়গাটি কুঠিবাড়ি সমেত ৪২৫০০ টাকায় কিনেছিলেন। এই কুঠিবাড়িটিই এই উদ্যানের আদি বাড়ি, যা সামান্য সংস্কারের পর, এখনও অপরিবর্তিত আছে। গাজী সাহেবের পীরের স্থানটিও আদি। বাকি ঘর-বাড়ি-মন্দির-ঘাট ইত্যাদি রানির আমলে তৈরি।

রানি রাসমণি যখন জমিটি কেনেন তখন তার চৌহদ্দি ছিল – পূর্ব দিকে কাশীনাথ চৌধুরীদের জমি, পশ্চিম দিকে গঙ্গা, উত্তর দিকে সরকারি বারুদখানা আর দক্ষিণ দিকে জেমস হেস্টির একটি কারখানা। জমি কেনার পর পূর্ব দিকে লোকালয় গড়ে ওঠে, দক্ষিণ দিকে জেমস হেস্টির কারখানার জায়গায় পরে যদুলাল মল্লিকের বাগানবাড়ি স্থাপিত হয়েছিল।

নহবত।

দক্ষিণেশ্বরে জমি কেনার সঙ্গে সঙ্গেই ১৮৪৭-৪৮ সাল থেকেই এখানকার যাবতীয় নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং সেই কাজে প্রথম দিকে রানির প্রধান সহায়ক ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা রামচন্দ্র দাস। পরে রানির তৃতীয় জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাসের ওপরেই এই কাজের সব দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। তখনকার খুব নামী বিলাতি ঠিকাদারি সংস্থা ‘ম্যাকিনটস অ্যান্ড বার্ন’ কোম্পানিকে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকার চুক্তিতে মন্দিরের পোস্তা ও ঘাট তৈরির বরাত দেওয়া। পোস্তা, বাঁধ প্রভৃতির কাজ শেষ হলে গঙ্গার দিকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একই ধাঁচের ১২টি শিবমন্দির ও চাঁদনি এবং এই মন্দিরগুলির পূর্ব দিকে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত মাটির টালি বাঁধানো একটি বিরাট চতুষ্কোণ প্রাঙ্গণ তৈরি করা হয়, যার আয়তন ৪৪০ ফুট লম্বা এবং ২২০ ফুট চওড়া। মন্দিরের সমগ্র এলাকার তিন পাশে দালানবাড়ি তৈরি করা হয়। এই বাড়িগুলির মাঝখান দিয়ে মন্দিরে আসার জন্য তিনটি প্রবেশপথও করা হয়। একই সঙ্গে কালীমন্দির ও বিষ্ণুমন্দিরের কাজ চলতে থাকে। মন্দির এলাকার বাইরে উত্তরে একটি নহবতখানা এবং দক্ষিণে অনুরূপ একটি নহবতখানা তৈরি করা হয় এবং এলাকাটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হয়।

দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন কালীমন্দির তথা ভবতারিণী মন্দির বাংলার শিল্পকলার এক অপূর্ব নিদর্শন। মন্দিরের উচ্চতা একশো ফুট। গর্ভগৃহে কালো পাথরের বেদির ওপর রুপোর প্রস্ফুটিত শতদল। চার কোণে রুপোর স্তম্ভ। মা ভবতারিণী বেনারসী শাড়ি পরিহিতা, ত্রিনয়নী শ্যামাকালী। গলায় চিক, মুক্তোর সাতনরী হার, সোনার মুণ্ডমালা। সারা গায়ে অসংখ্য স্বর্ণরৌপ্য অলংকার। বাঁ দিকের একটি হাতে নৃমুণ্ড ও অপরটিতে অসি। ডান দিকের দু’টি হাতে বরাভয় মুদ্রা। পদতলে শ্বেতপাথরের শিব। কষ্টিপাথরে মা ভবতারিণীর অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তি তৈরি করেছিলেন তৎকালীন বর্ধমান জেলার দাঁইহাটের অধিবাসী নবীন ভাস্কর।

মায়ের মন্দিরের উত্তরে রাধাকান্তের মন্দির। উলটো দিকে দ্বাদশ শিবমন্দির। তিন মন্দির তিন ধরনের স্থাপত্য। ভবতারিণীর নবরত্ন মন্দির, দ্বাদশ শিবমন্দির আটচালা মন্দির এবং রাধাকান্তের মন্দির ইউরোপীয় ধাঁচের। দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে রাণি রাসমণি সফল করেছিলেন তাঁর সর্বধর্ম-সমন্বয়ের স্বপ্ন। শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের এক মহামিলন তীর্থ দক্ষিণেশ্বর। ধর্মের এই তিন ধারাকে এক করা উদারতার পরিচায়ক হলেও এমন দুঃসাহসের কাজ সম্ভব হয়েছিল রাসমণির অতুলনীয় প্রতিভার জন্যই।

মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৮৫৪ সালে। রানিমা মনের মতো করে মাকে সাজালেন। সকল কাজ নির্বিঘ্নে শেষ হল। এ বার দেবীপ্রতিষ্ঠার পালা। এর জন্য উপযুক্ত দিন খুঁজছিলেন রানি। এমন সময় মায়ের প্রত্যাদেশ – “যত শীঘ্র পারিস আমাকে প্রতিষ্ঠা কর।”

মন্দিরে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হবে, দেওয়া হবে অন্নভোগ। এখানেই বাধল গোল। রানি জাতিতে শূদ্র হওয়ায় সামাজিক প্রথা অনুযায়ী কোনো ব্রাহ্মণই, এমনকি রানির নিজের গুরুদেবও দেবীকে প্রতিষ্ঠা করতে ও ভোগ দিতে রাজি হলেন না। এ ব্যাপারে শাস্ত্রের বিধান জানার জন্য রানি বিভিন্ন চতুষ্পাঠীর পণ্ডিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁরা এক বাক্যে এই কাজকে অশাস্ত্রীয় বলেন। একমাত্র ব্যতিক্রম কলকাতার ঝামাপুকুর চতুষ্পাঠীর পণ্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বিধান, দেবীকে প্রতিষ্ঠার আগে যদি কোনো ব্রাহ্মণকে ওই মন্দির দান করা হয় এবং সেই ব্রাহ্মণ যদি ওই মন্দিরে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন তবে তা অশাস্ত্রীয় হবে না।

ভবতারিণী মন্দির।

এই বিধান দেওয়ায় রামকুমার গোঁড়া ব্রাহ্মণদের রোষে পড়লেন। কিন্তু রামকুমার তাঁর বিধান থেকে পিছু হটলেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁকেই এই কাজ করার জন্য রানি রাসমণি অনুরোধ করলেন। রামকুমারও সেই কাজে ব্রতী হন। ১২৬২ বঙ্গাব্দের ১৮ জ্যৈষ্ঠ, বৃহস্পতিবার, স্নানযাত্রার দিন (১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে) মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়।

অপরূপ সাজে সাজানো হল গোটা মন্দির চত্বর। বড়ো বড়ো ঝাড়বাতি দিয়ে মোহময়ী করে তো্লা হল বিশাল নাটমন্দির।

মন্দির প্রতিষ্ঠার আগের দিন মন্দিরপ্রাঙ্গণে যাত্রাগান, কালীকীর্তন, ভাগবতপাঠ, রামায়ণপাঠ ইত্যাদির ব্যবস্থা হয়েছিল। পরের দিন অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার দিন দেবালয়ের বিশাল প্রাঙ্গণে ভোর থেকেই অসংখ্য ভক্তের সমাগম হয়েছিল। এক শ্রেণির ব্রাহ্মণের বাধা সত্ত্বেও রাসমণি দেবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বঙ্গ তো বটেই, ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্রাহ্মণরা উপস্থিত হন। এই ঐতিহাসিক মহোৎসবে রাসমণি ‘অন্নদান যজ্ঞ’-এর আয়োজন করেন। এই ‘অন্নদান যজ্ঞ’-এ ছিল ‘দধি-পুষ্করিণী’, ‘লুচি-পাহাড়’, ‘মিষ্টান্ন-স্তুপ’, ‘পায়েস-সমুদ্র’, ‘ক্ষীর-হ্রদ’, ‘দুগ্ধ-সাগর’, ‘ঘৃত-কূপ’ ইত্যাদি।

যে সমস্ত বঙ্গীয় বৈদিক শ্রেণির ব্রাহ্মণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রামসুন্দর চক্রবর্তী, উমাচরণ ভট্টাচার্য, বৈকুন্ঠনাথ ন্যায়রত্ন, চণ্ডীচরণ বিদ্যাভূষণ, কেশবচন্দ্র তর্কবাগীশ, ঠাকুরদাস বিদ্যালঙ্কার, রামকুমার তর্কালঙ্কার, পীতাম্বর চূড়ামণি, যদুনাথ সার্বভৌম, মধুসূদন তর্কালঙ্কার, সীতারাম বিদ্যাভূষণ, বৈকুন্ঠ ন্যায়রত্ন, কৃত্তিবাস তর্করত্ন, রাইচরণ ভট্টাচার্য, প্রেমচাঁদ বাচস্পতি, ঈশানচন্দ্র ন্যায়বাগীশ, ভোলানাথ সার্বভৌম, ঈশ্বরচন্দ্র চূড়ামণি, ব্রজনাথ চক্রবর্তী, বানেশ্বর বিদ্যাভূষণ, চিন্তামণি বিদ্যাসাগর, নবকুমার শিরোমণি প্রমুখ।

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মা ভবতারিণীর পূজকপদে সৎসাহসী ও শাস্ত্রজ্ঞ রামকুমারকেই মনোনীত করলেন রানিমা। রামকুমার দক্ষিণেশ্বরেই থেকে গেলেন এবং পরবর্তী কালে কনিষ্ঠ ভ্রাতা গদাধরও (পরে শ্রীরামকৃষ্ণ) তাঁর সঙ্গে বাস করতে থাকেন।

দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। রানি রাসমণি বুঝেছিলেন সমাজসংস্কার করতে হলে শুরু করতে হবে ধর্মের হাত ধরেই। ভারতের সনাতন শক্তিসাধনাকে নতুন তাৎপর্য ও মাত্রা দান করার জন্যই তাঁর আবির্ভাব। ভারতমায়ের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপ দেওয়ার মতন কতই বিপ্লবী এসেছেন মহামায়ার পদতলে। ঋষি অরবিন্দকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করে তখন তাঁর কাছে পাওয়া গিয়েছিল একমুঠো মাটি – সে মাটি দক্ষিণেশ্বরের।

রানি রাসমণি যেন ভারতের অগ্নিপুরুষের আবির্ভাবের জন্যই এই পীঠ নির্মাণ করেছিলেন। সবার অলক্ষ্যে মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন ঘটেছিল সেই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সে এক আশ্চর্য সংযোগ। মন্দিরে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা চলছে, সাধারণ চেহারার বছর আঠারো-উনিশের যুবক এক পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছেন। কে জানত এই যুবকটিই একদিন হয়ে উঠবেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। রামকৃষ্ণ এলেন মায়ের পূজারি হয়ে মন্দিরে। ত্রিশ বছর থেকেছেন এখানে। এই শক্তিসাধক দক্ষিণেশ্বরেই সাধনা করে পেয়েছেন ঈশ্বরদর্শন, হয়েছেন কল্পতরু। তাঁরই ব্যাকুল আহ্বানে মহাশক্তি প্রকটিতা হয়েছেন মূর্তিতে। এই সাধনপীঠেই নরেন্দ্রনাথের মধ্যেই বিবেকানন্দকে জাগ্রত করেছেন তিনি। দক্ষিণেশ্বরেই ছিলেন মহাকালীর মানব-অবতার শ্রীসারদা মা। বিবেকানন্দের ‘জ্যান্ত দুর্গা’।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর।

বিগত ১৬৫ বছর ধরে দক্ষিণেশ্বর মন্দির বাংলার ধর্ম ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে চলেছে। তখন ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, রাসমণি, সারদামা। ছিল খোলার চালের ঘর। ছিল না শানবাঁধানো দালান, গঙ্গার ঘাট। গঙ্গার জোয়ারের সময় জল এসে আছড়ে পড়ত দ্বাদশ শিবমন্দিরের পিছনের দেওয়ালে। এখন গঙ্গার পাড় বাঁধিয়ে সংস্কার করা হয়েছে। উঠোনের উত্তর-পশ্চিমে রামকৃষ্ণদেবের ঘর – এখানেই তাঁকে ঘিরে রাথতেন তখনকার দিকপালরা। এই ঘরেই বিবেকানন্দ দেখেন তাঁর ধর্মগুরুকে। এখন তা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে দর্শনের জন্য। অদূরেই নহবতখানা – সকাল-সন্ধে দু’বার সানাইয়ের সুর ভাসিয়ে নিয়ে যেত মন্দির চত্বর। পরে এই নহবতই হয় সারদামায়ের বাসস্থান। জীবন্ত শক্তিপীঠ। এখন সেখানে সারদা মন্দির।

আজও রানি রাসমণির দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে নিষ্ঠার সঙ্গে পূজা করা হয়। প্রতি প্রভাতে ৪টের সময় হয় মায়ের জাগরণ-আরতি। সেই সময়ে মাখন-মিছরি দিয়ে মায়ের বাল্যভোগ হয়। এর পর মন্দির বন্ধ থাকে, খোলে সকাল ৬টায়। তার পর মায়ের স্নান-আরতি। সকাল ৯টায় নৈবেদ্য ভোগ। বেলা ১২টায় অন্নভোগ। অন্নভোগে থাকে দু’টি তরকারি, তিন রকমের ভাজা, ডাল, চাটনি, পায়েস এবং মাছ। এর পর মন্দির বন্ধ। খোলে সাড়ে ৩টেয়। তখন ফল, ছানা সহযোগে বৈকালিক দেওয়া হয়। রাত্রি ৮টায় শীতল ভোগ।

শাস্ত্রমতে কালীপুজো করতে যে সব উপাচার লাগে সবই এখানকার পুজোয় থাকে, শুধু থাকে না কারণ। যে হেতু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কারণ ছাড়াই মায়ের পূজা করতেন, তাই এই প্রথা চলে আসছে।

দীপান্বিতা ছাড়াও কার্তিক অমাবস্যা, বাসন্তীপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো, সাবিত্রী চতুর্দশী, রটন্তী কালীপুজো, মন্দির প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দিনে বিশেষ পুজো হয়। রানি রাসমণির জন্মদিনে দুপুরে দই-মিষ্টি দিয়ে বিশেষ ভোগ দেওয়া হয় আর রাতে বিশেষ ব্যবস্থা। মায়ের জন্য আমিষ ভোগের ব্যবস্থা। দীপান্বিতা কালীপূজো ছাড়াও বিভিন্ন অমাবস্যা এবং বিশেষ করে কল্পতরু উৎসবের দিন বহু ভক্তের সমাগম হয়।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায় দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে। মন্দিরের দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেছিল মন্দির কর্তৃপক্ষ। সেই পরিকল্পনার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘টু রিভাইভ আওয়ার হেরিটেজ’। এর প্রথম ধাপ হিসাবে মন্দিরে বলি কয়েক বছর আগেই বন্ধ করা হয়েছে। মা ভবতারিণীর পুরোনো সিংহাসনটি পরিবর্তন করে নতুন সিংহাসন বসানো হয়েছে। রানির আমলে তৈরি সিংহাসনটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। মন্দিরে পানীয় জলের ব্যবস্থা, রাস্তা সম্প্রসারণ, কার পার্কিং জোন করা হয়েছে। আরও কাজের মধ্যে রয়েছে অতিথিশালা নির্মাণ, কথামৃত গ্রন্থের সংস্করণ প্রকাশ ইত্যাদি। বাংলার ইতিহাসে ঐতিহ্যপূর্ণ মন্দির হিসাবে রানি রাসমণির প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিণীর মন্দির আজও সমাদৃত।

কী ভাবে যাবেন

কলকাতার উপকণ্ঠেই দক্ষিণেশ্বর। ট্রেন, মেট্রো, বাস – কলকাতা থেকে যে কোনো পরিবহণ মাধ্যমেই পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। আর গাড়ি বা ট্যাক্সি ভাড়া করে তো যেতেই পারেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কেন্দ্র বেলুড় থেকে জলপথেও আসা যায় দক্ষিণেশ্বরে।   

আরও পড়তে পারেন

উত্তরাখণ্ডের কার্তিকস্বামীকে তীর্থকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা

কালীপুজো-দীপাবলি: শান্তিপুরে চাঁদুনিবাড়িতে পুজোর সময় গৃহদেবতারাও উপস্থিত থাকেন

কালীপুজো-দীপাবলি: পুজো উপলক্ষ্যে সেজে উঠেছে ময়দা কালীবাড়ি

কালীপুজো-দীপাবলি: শান্তিপুরে বড়ো গোস্বামী বাড়িতে আগমেশ্বরীর কালীপুজোয় সহিষ্ণুতার কাহিনি

কালীপুজো-দীপাবলি: মা-ই-ত কালীর পুজোয় মেতে উঠছে সোনামুখী    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *