কৃষ্ণনগর গেলে কখনোই সরভাজা-সরপুরিয়ার স্বাদ নিতে ভুলবেন না, বাড়ির জন্য বেঁধেও আনবেন

সরভাজা ও সরপুরিয়া।

ভ্রমণঅনলাইন ডেস্ক: লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়েছেন? চলেছেন ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে? কৃষ্ণনগরের উদ্দেশে? কিংবা কৃষ্ণনগর ছাড়িয়ে আরও উত্তরে? বহরমপুর, মালদহ অথবা আরও উত্তরে? তা হলে অবশ্যই একবার যাত্রাবিরতি ঘটাবেন কৃষ্ণনগরে।

না, কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির মাটির পুতুল দেখার জন্য নয়, বা জগদ্ধাত্রীপুজো উপভোগ করার জন্য নয় অথবা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিধন্য কৃষ্ণনগরের সঙ্গে পরিচিত হতেও নয়, স্রেফ কৃষ্ণনগরের মিঠাইয়ের স্বাদ নিতে এক বার যাত্রাবিরতি ঘটানো উচিত এখানে। অথবা চলেই আসুন না এক বার কৃষ্ণনগরে, সরভাজা, সরপুরিয়া বা সরতক্তি বেঁধে নিয়ে ঘরে ফিরুন। হলপ করে বলা যায়, আপনি ঠকবেন না।

সরভাজা-সরপুরিয়া হয়তো কলকাতা মহানগরীতেও পাওয়া যায়, হয়তো আপনি তা চেখেও দেখেছেন, কিন্তু কৃষ্ণনগরের সরভাজা-সরপুরিয়ার স্বাদই আলাদা। সেই স্বাদ ভোলার নয়।

ট্রেনেও আসতে পারেন কৃষ্ণনগরে। শহরের দ্রষ্টব্য দেখুন, ঘূর্ণি ঘুরে আসুন, কেনাকাটা করুন এবং তার সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যান সরভাজা-সরপুরিয়া। যদি সড়কপথে আসেন, তা হলে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের যেখান থেকে কৃষ্ণনগরের পথ শুরু হয়েছে, সেখানেও সরভাজা-সরপুরিয়া পাবেন, কিন্তু তার আস্বাদ না নিয়ে শহরের ভিতরে চলুন। ‘অথেনটিক’ সরভাজা-সরপুরিয়ার স্বাদ নিন।

ইতিহাস থেকে

এ বার একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা যাক। অনেক আগে কৃষ্ণনগরে বহু গোয়ালার বাস ছিল। তখন এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘রেউই’। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রাজা রাঘবের পুত্র রুদ্র রায় এই জায়গার ‘রেউই’ নাম পালটে কৃষ্ণনগর রাখেন বলে জানা যায়। এই অঞ্চলে দুধের প্রাচুর্য ছিল, ফলে ক্ষীর ও ছানা, মিষ্টির এই দু’টি উৎকৃষ্ট উপাদানের কোনো অভাব ছিল না।

শোনা যায়, পাঁচশো বছর আগেও নাকি সরভাজা-সরপুরিয়া ছিল। কৃষ্ণনগরের কোনো এক ভোজনবিলাসী রাজা সেকালের কোনো ময়রার কাছে কোনো নতুন মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সেই থেকেই সম্ভবত জন্ম সরভাজা-সরপুরিয়া-সরতক্তির। পরবর্তী কালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাত্যহিক জলযোগপর্বে অন্তত একটি সরপুরিয়া বা সরভাজা থাকতই।

সরভাজা-সরপুরিয়ার উপাদান

সরপুরিয়া-সরতক্তির ওপরে, নীচে ও মাঝে সরের আবরণ থাকলেও এ দু’টি মিষ্টির প্রধান উপাদান ক্ষীর ও ছানা। সরের রকমফের থাকে। একটা সর সাদা এবং আরেকটা সর লালচে। সরপুরিয়ায় ছানা ও ক্ষীরের অনুপাত হল ১:২। অর্থাৎ যতটা ছানা থাকবে তার দ্বিগুণ থাকবে ক্ষীর।

সরপুরিয়া তিন স্তরবিশিষ্ট মিষ্টি। কিন্তু সরতক্তিতে একটাই স্তর থাকে। আর সরভাজা মিষ্টিটি সম্পূর্ণই সরের তৈরি।

১১৯ বছরের মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান অধরচন্দ্র দাস

প্রচলিত মতে সরপুরিয়ার সৃষ্টিকর্তা অধরচন্দ্র দাস। আবার মতান্তরে এই মিষ্টি তৈরি করা শুরু করেছিলেন অধরচন্দ্রের বাবা সূর্য কুমার দাস। এই মিষ্টি তৈরি করা নিয়ে অনেক কাহিনি শোনা যায়। রেসিপি চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে ক্ষীর, ছানা আর সর দিয়ে সরপুরিয়া বানাতেন সূর্য কুমার। এই ভাবে তিনি সরভাজাও সৃষ্টি করেন। পুত্র অধরচন্দ্র বাবার কাছে মিষ্টি তৈরি করার কৌশল শিখে নেন। তিনিও তাঁর বাবার মতো রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে মিষ্টি তৈরি করতেন। পরে নিজের দোকান প্রতিষ্ঠা করেন নেদিয়ারপাড়ায়।         

কৃষ্ণনগর শহরে সরভাজা-সরপুরিয়া-সরতক্তির বেশ কিছু দোকান আছে। তবে নেদিয়ারপাড়ায় অনন্ত হরি মিত্র রোডে অধরচন্দ্র দাসের দোকানটি অন্যতম প্রাচীন। ১১৯ বছর পার করে এগিয়ে চলেছে চার পুরুষের এই মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান। ১৩০৯ বঙ্গাব্দ তথা ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে এই দোকান প্রতিষ্ঠা করেন অধরচন্দ্র। ১৩৬৯ বঙ্গাব্দের ১৫ অগ্রহায়ণ তিনি প্রয়াত হন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অধরচন্দ্রের উত্তরপুরুষরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের আধুনিকীকরণ করেছেন, নতুন নতুন মিষ্টি উদ্ভাবন করেছেন এবং পাশাপাশি সরভাজা-সরপুরিয়ার সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।

ছবি: সৌজন্যে adharsweets.in

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *