মদনমোহনের রাস কোচবিহারের অহংকার

সৌরীশ বসু  

বঙ্গবাসী যখন কুয়াশাঘন সকাল ও শীতল রাতের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, ঠিক সেই সময় কোচবিহারবাসী মেতে ওঠেন মদনমোহনের রাস উৎসবে। কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তাই দুর্গাপুজো, কালীপুজো, দীপাবলি ইত্যাদির রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলার উত্তরের এক জেলার মানুষজন ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁদের আদরের মদনমোহন জিউর রাসমেলা নিয়ে।

পুরাণ মতে, যে দিন দেবতারা মর্ত্যে আসেন দীপাবলি উদযাপন করতে, সেই কার্তিকী পূর্ণিমার দিন মদনমোহন জিউর রাসযাত্রার শুভ সূচনা করেন কোচবিহারের জেলাশাসক।

এই বছর অর্থাৎ ২০২২-এ পালন হচ্ছে মদনমোহনের রাস উৎসবের ২১০তম বার্ষিকী। ইতিহাস ঘাঁটলে জানতে পারা যায়, হরেন্দ্রনারায়ণ যে বার রাজা হয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করেন সে বছর থেকে তিনি কোচবিহার শহরে রাসমেলা শুরু করেন। তার আগে এই মেলা হত শহর থেকে কিছুটা দূরে ভেটাগুড়ি নামে এক জায়গায়। আজ আমরা যে রূপে মেলাকে দেখছি সেই রূপে মেলাকে নিয়ে আসেন রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ।

কোচ রাজবংশের শেষ রাজা মহারাজ জগদীপেন্দ্রনারায়ণের পর এই মেলা উদ্বোধনের দায়িত্ব বর্তায় কোচবিহারের জেলাশাসকের উপরে। কিন্তু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে রাজপরিবারের একজন সদস্য থাকতেন। কিন্তু গত বছর রাজপরিবারের অন্তিম সদস্যের মৃত্যু হওয়ায় এ বছর শুধুমাত্র সস্ত্রীক জেলাশাসক রাজবেশে রাসমেলার শুভ সূচনা করেন। এবং এই কারণেই এই জেলায় কখনও অহিন্দু জেলাশাসক আসেন না। মেলা শুরুর এক মাস আগে থেকে জেলাশাসককে নিরামিষ আহার করতে হয়ে এবং পূর্ণিমার দিন মদনমোহনবাড়ির প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে পুজো দিয়ে মদনমহনের রাসচক্র ঘুরিয়ে রাসমেলা আরম্ভ করেন।

এই মেলার মূল আকর্ষণ হচ্ছে রাসচক্র। এই জেলায় ধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক হচ্ছে এই রাসচক্র। লম্বায় প্রায় ৩০-৪০ ফুট ও চওড়ায় ১৫-২০ ফুট গোলাকার এই চক্র তৈরি করেন আলতাফ মিয়াঁ নামক এক ব্যক্তি। শোলা ও কাগজের তৈরি করা নকশায় থাকে বিভিন্ন দেবদেবীর কাহিনি ও আঁকা ছবি। এই চক্রকে অনেকে বৌদ্ধদের ধর্ম-চক্রের সঙ্গেও তুলনা করেন।

মদনমোহনবাড়িতে মেলা উপলক্ষ্যে প্রত্যেক দিন যাত্রা-কীর্তন ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে এবং পুরো বাড়িটা মাটির পুতুল দিয়ে সাজানো হয়। সেই সব মাটির পুতুলে বর্ণিত করা হয় নানা পৌরাণিক কাহিনি। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের হাতে আঁকা ছবি ও ভাস্কর্য দিয়েও সাজিয়ে তোলা হয় ওই বাড়ি। মদনমোহনের বাড়ির বাইরে বসে রাসমেলা যা প্রায় ২ কিমি অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো থাকে।

কভিড-১৯-এর কারণে গত দু’ বছর এই মেলা বন্ধ থাকার পরে এই বছর আবার মেলা আবার নিজের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে। দেশ ও রাজ্যের প্রায় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন আসেন এই মেলায় দোকান দিতে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় থাকে জম্মু-কাশ্মীর, বিহার ও অসমের মানুষজন। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকেও অনেকেই আসেন তাঁতের সম্ভার নিয়ে।

“নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান” – আক্ষরিক অর্থেই এই বাণীর দৃশ্যায়ন হয়ে থাকে এই মেলায়। জেলার এবং জেলার বাইরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত খাবার থেকে শুরু দেশের কিছু অংশের বিশেষ খাবারও পাওয়া যায় এই মেলায়। ২৮ দিন ধরে চলা এই মেলায় প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলায় থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শেষ দিন আসেন একজন স্বনামধন্য গায়ক। বছর কয়েক আগে একবার কুমার শানু এসেছিলেন মেলার শেষ দিনএ। ওই দিন কোচবিহার শহরকে দেখে মনে হয়েছিল নরমুণ্ডের জাল বোনা হয়েছে। শহরের রাস্তায় পা রাখার জায়গা হচ্ছিল না।

বিভিন্ন সরকারি দফতরের অফিসও বসে এই মেলায়। তবে অন্যান্য মেলার মতো এখানেও বিভিন্ন রকমের নাগরদোলার পাশাপাশি একটি বিশেষ আকর্ষণ থাকে, তা হল সার্কাস। মাঠের কোণায় সার্কাসকোম্পানির বিরাট তাঁবু পড়ে মেলার সময়। মদনমোহনের রাসচক্র ঘুরিয়ে, বিভিন্ন সাধের খাবার চেখে, সার্কাস দেখে, পরের বছর আবার সংকল্প নিয়ে, পান চিবোতে চিবোতে, আসন্ন শীতের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে বাড়ি ফেরে শহর ও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মানুষজন।

ছবি: প্রতিবেদক

আরও পড়ুন

ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভুম জেলায় ১৩টা নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার ভাবনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *