মেঘভাঙা বৃষ্টি, দুর্যোগ সঙ্গে নিয়ে এলাম লুংচু

শ্রয়ণ সেন

মাত্র ৪৭ কিলোমিটার রাস্তা। সাধারণত পাড়ি দিতে সময় লাগে বড়োজোর ঘণ্টা আড়াই। কিন্তু আমাদের সেটাই লাগল সাড়ে চার ঘণ্টা।

আজ সকালে মুনথুম থেকে এখানে আসার জন্য যখন বেরিয়েছিলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা। আর এখানে এসে পৌঁছোলাম যখন, ঘড়ি বলছে বিকেল ৩টে।

আসলে একটা লম্বা সফরের মধ্যে এক একটা দিন এমন আসে, যখন কোনো কিছুই আমাদের নির্দিষ্ট সূচি অনুযায়ী হয় না। আবার এটাও ঠিক যে নির্দিষ্ট সময় মেনে না হলেও সে দিন কোনো নতুন এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই আমরা।

পাহাড়ে মেঘভাঙা বর্ষণ কাকে বলে, তা এত দিন ছবিতেই দেখেছি। আজ কার্যত প্রত্যক্ষ করলাম। কিছুটা বিপদেও পড়লাম। তবে কথাতেই আছে, ‘সব ভালো যার শেষ ভালো তার’। তাই লুংচুর সৌন্দর্য নিমেষের মধ্যে সেই বিপদসংকুল অভিজ্ঞতাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। 

আজ সকালে বিশাল-নীতার আস্তানা থেকে চেক-আউটের জন্য তৈরি হচ্ছি, এমন সময় নামল বৃষ্টি। তখন সাড়ে ন’টা। খুব একটা বিচলিত হইনি। বর্ষায় পাহাড়ে এমন বৃষ্টি তো হবেই। গত কয়েক দিন ধরে মাঝেমধ্যেই তো তা হচ্ছে, উপভোগও করছি।

কিন্তু আজকের বৃষ্টিটা কেমন যেন অন্য রকম। বৃষ্টির তেজ ক্রমশ বাড়তে লাগল। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে, এ এখনই থামার নয়। তাই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই রওনা হলাম।

চারশো মিটার দূরে, যেখান থেকে পিচ রাস্তা শুরু, সেখান আমাদের ছোটো গাড়িটাকে রাখা আছে। আমাদের অন্য গাড়ি, অর্থাৎ বোলেরো রয়েছে হোমস্টের দোরগোড়াতেই। এই চারশো মিটার পাথুরে রাস্তা দিয়ে ওর পক্ষে আসা খুব একটা সমস্যার হয়নি।

মুনথুমকে বিদায় জানানোর মুহূর্তে বিশাল আর নীতা চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী আমাদের খাদা পরিয়ে দিলেন। যে হেতু ছোটো গাড়িটা নেই, তাই দলের সাত জনের মধ্যে চার জন আর সমস্ত জিনিসপত্র বোলেরোয় চাপিয়ে আমরা রওনা হয়ে গেলাম। আমরা তিন জন হাঁটা লাগালাম বোলেরোর পেছন পেছন।

রাস্তাটা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পাথুরে, পিচ্ছিল রাস্তায় যত এগোচ্ছি বৃষ্টির তেজ তত বাড়ছে। পাহাড়ের গা বেয়ে তোড়ে জল নেমে এসে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে রাস্তাটাকে। তার ওপর দিয়েই আমরা হাঁটছি। এ ভাবেই ওই পথ অতিক্রম করে মূল রাস্তায় যখন এসে পৌঁছোলাম, তখন আরও এক বিপত্তি।

কাল রাতে আমাদের ছোটো গাড়ির চালক, কামু লামা গাড়িটাকে পিচ রাস্তায় না রেখে, একটা মাটির জায়গার ওপরে রেখেছিল। গিয়ে দেখা গেল তীব্র বৃষ্টির কারণে সে পুরোপুরি ফেঁসে গিয়েছে। তাকে এখনই উদ্ধার করা সম্ভব হবে না, কারণ বৃষ্টি যে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।

এ দিকে, প্রবল বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে গিয়ে আমরা তিন জন চপচপে হয়ে ভিজে গিয়েছি। ভাগ্যিস এখানে একটা চায়ের দোকান ছিল। আমরা তাই বোলেরোয় না উঠে সেখানে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম।

ঘড়ির দিকে দেখলাম। বারোটা বেজে গিয়েছে। অর্থাৎ গত দেড় ঘণ্টায় মুনথুমের হোমস্টে থেকে চারশো মিটারই আসতে পেরেছি আমরা। ছোটো গাড়ি ফেঁসেই রয়েছে। রাস্তা পুরো নদী। ওপর থেকে বিপুল পরিমাণে জল তোড়ে নেমে আসছে। সেই সঙ্গে ভেসে আসছে বড়ো বড়ো পাথর, বোল্ডার।

উপায় বাতলে দিল বোলেরোর চালক বাপিদা। তার কথামতোই আমরা সাত জনে মিলে বোলেরোতেই রওনা হয়ে গেলাম লুংচুর দিকে। দু’টো গাড়ির সব জিনিসপত্র একটা গাড়িতে, সেই সঙ্গে সাত জন। এক প্রবল দমবন্ধ করা পরিস্থিতি গাড়ির ভেতর। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। লুংচু আমাদের পৌঁছোতেই হবে।

ছোটো গাড়ি মুনথুমে থাকল, আমরা রওনা হয়ে গেলাম। পথেই দেখলাম পালা নদীকে। কালও দেখেছিলাম, বর্ষার বৃষ্টিতে যেমন পাহাড়ি নদীর রূপ হওয়ার কথা, তেমনই ছিল।

কিন্তু আজ দেখলাম তার ভয়ংকর রূপ। হিমাচল-উত্তরাখণ্ডে মেঘভাঙা বৃষ্টি হলে যে ভাবে জল নেমে আসে, ঠিক সে ভাবেই নেমে আসছিল পালা।

না পথে আর অন্য কোনো বিপদ হয়নি। অতি পরিচিত লাভায় এসে যখন পৌঁছোলাম তখন সওয়া দু’টো। লাভা পেরিয়ে কিছুটা মালবাজারের দিকে গিয়ে, ঘুরলাম বাঁ দিকে। ঢুকে গেলাম নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের ভেতর। এখানে ঢোকার মুখে ১২০ টাকা দিয়ে বন দফতরের অনুমতি নিতে হল।

ঢুকে গেলাম নেওড়া ভ্যালির ঘন জঙ্গলের ভেতরে। পাইন, দেবদারু-সহ ঘন আকাশছোঁয়া গাছের ঠাসবুনোট জঙ্গল এই নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান। দিনের বেলায় বহু জায়গায় সূর্যের আলো পৌঁছোয় না।

চারিদিকে একটা আলোআঁধারি। ঘন কুয়াশা ঘিরে রেখেছে আমাদের। সেই কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে চলেছি আমরা। বৃষ্টি এখন নেই, কিন্তু চারিদিকে কী অদ্ভুত রোমহর্ষক একটা ব্যাপার।

এই নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে উত্তরপূর্ব ভারতের সব চেয়ে সমৃদ্ধ অরণ্যভূমি। ৮৮ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে এই জঙ্গল ছড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রতল থেকে হাজার দুয়েক উচ্চতার সামসিং থেকে হাজার দশেক উচ্চতার রাচেলা পিক পর্যন্ত এর বিস্তার। পুরোটাই কালিম্পং পাহাড়ে।

বছর তিনেক আগে এই জঙ্গলেই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখা দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই জঙ্গলের খ্যাতি আরও বেড়ে গিয়েছে।

আলো আঁধারির মধ্যে দিয়েই লাভা থেকে ৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে, চলে এলাম কোলাখাম। পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই কোলাখামে এখন কংক্রিটের জঙ্গল বেড়ে চলেছে। সবই পর্যটকদের মুখ চেয়ে। আমরা আরও এগিয়ে চললাম।

এই অঞ্চলের সব থেকে জনপ্রিয় জলপ্রপাত ছাঙ্গে। তার প্রবেশপথ বাঁ দিকে। মূল রাস্তা থেকে অসংখ্য সিঁড়ি নেমে তবেই ছাঙ্গে পৌঁছোনো যায়। বর্ষায় সেই সিঁড়ি এখন অত্যন্ত পিছল। অগত্যা ছাঙ্গে দেখার বিরুদ্ধেই অধিকাংশের মত। এগিয়ে চলি আরও কিছুটা। 

মূল রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে খাড়া একটি রাস্তায় উঠে দু’টো হেয়ারপিন বেন্ড সুলভ বাঁক নিয়েই থামল আমাদের গাড়ি। এখান থেকে কয়েকটা সিঁড়ি উঠে তবেই আমাদের আজকের আস্তানা।

আমরা পৌঁছোতেই ম্যাজিকের মতো চলে এল দুই কিশোর। প্রবীণ সদস্যদের থেকে জিনিসপত্র নিয়েই উঠতে থাকল তারা। পেছন পেছন সিঁড়ি ভাঙতে থাকলাম আমরাও।

এক ছোট্ট সবুজেঘেরা পাহাড়ি গ্রাম লুংচু। সমুদ্রতল থেকে ৫,৮০০ ফুট উচ্চতার এই লুংচুতে একরাশ শান্তির খোঁজ পেলাম। লুংচুকে আলো করে রেখেছে এখানকার আস্তানা, লুংচু নেচার স্টে।

নেওড়াভ্যালি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সেই সঙ্গে হরেক রকমের পাখি তো আছেই। পৌঁছোনো ইস্তক পাখিদের নানা রকম ডাকে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।

দু’তলা বাড়ি, ছ’টা ঘর, একটি সুন্দর ডাইনিং রুম আর সামনে বেশ বড়ো একটা বাগান নিয়ে তৈরি এই নেচার স্টে। বাগানে নানা রকমের ফুলের গাছ। 

এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য দেখা এক স্বর্গীয় অনুভুতি। অবশ্য এই বৃষ্টির মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব, এমন আশা করা উচিত নয়।

এক তলার তিনটে ঘর আমাদের জন্য বরাদ্দ। ঘরগুলো বেশ বড়ো, সামনের দেওয়ালটা প্রায় পুরোটাই কাচের। বিছানায় শুয়ে শুয়েই পাহাড় দেখা যায়। ঘরের সামনেই বেশ বড়ো একটা বারান্দা। এই বারান্দায় বসে সামনে পাহাড়, মেঘের খেলা আর বৃষ্টি দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে।

আর যদি মনে করেন, অফিসের কাজও করতে পারবেন মনের আনন্দে। অজ জায়গা হলেও ৪জি নেটওয়ার্ক রয়েছে পুরোপুরি। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ এখানে হয়ে উঠতে পারে ‘ওয়ার্ক ফ্রম মাউন্টেন।’ কয়েকটা দিন প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটিয়ে অফিসের কাজ করতে মন্দ কিন্তু লাগবে না।

সন্ধ্যা নামতেই হাজির গরম গরম মোমো। গোটা সফরে এই প্রথম বার বেশ ঠান্ডা লাগছে। এই প্রথম বার গায় গরম জামা চাপাতে হয়েছে। এই পরিবেশে ধূমায়িত মোমো খাওয়া অসাধারণ এক অনুভূতি।

খাবারদাবারের প্রশংসা এখানে করতেই হবে। এখানকার দেখভালের দায়িত্বে আছেন অশোক রাই এবং তাঁর পরিবার। তাঁদের রন্ধনগুণের বাহবা দিতে হয়। নৈশভোজে যে চিকেন কারি খেলাম, তাতে নিজের বাড়ির গন্ধ মেশানো ছিল।

রাত বাড়ছে লুংচুতে। বাড়ছে বৃষ্টিও। নৈশভোজের পালা মিটিয়ে এ বার ঘুমোতে যাওয়ার পালা। সেই সঙ্গেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা আগামীকাল ভোরের।

কিছুক্ষণ আগেই অশোকজি বললেন, “আজ সকালে কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো থাকলে কাল সকালেও দেখা যাবে।”

কিন্তু এখন যা তেড়ে বৃষ্টি পড়ছে, কাঞ্চনকে কি আদৌ দেখা যাবে?

লুংচুতে থাকা

লুংচু নেচার স্টে’তে রাত্রিবাসের যাবতীয় আয়োজন করে দিতে পারে ট্র্যাভেলিজম (Travelism)। যোগাযোগ করুন: 8276008189 অথবা 9903763296 নম্বরে।

আগের পর্বগুলি পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন

আরও পড়তে পারেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *