সৌরীশ বসু
দুই বাংলার দক্ষিণে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ বাদাবন বা জঙ্গল অর্থাৎ সুন্দরবনের একমাত্র ভরসার ও আরাধ্য দেবী হলেন বনবিবি বা বনদেবী। জঙ্গলে প্রবেশ করার আগে মাঝি-জেলেরা এই দেবীর পুজো দিয়ে থাকে।
বনবিবি ও তার পরিবারকে নিয়ে অনেক রকম গল্পকথা আছে। সেগুলোকে পালাগানও বলা হয়। আজ অর্থাৎ পয়লা মাঘ বনবিবির পুজো। এই পুজোটা বেশ অন্য রকমের হয়।
এই পুজোয় তথাকথিত কোনো মন্ত্রোচ্চারণ থাকে না। তার বদলে থাকে পাঁচালিপাঠ। ঠিক যেমন বাড়িতে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়া হয়, সে রকমই বনবিবির পাঁচালি।
বনবিবি, তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলি, গাজিবাবা এবং দুঃখে। এঁরা প্রত্যেকই মুসলিম ধর্মাবলম্বী, আর দক্ষিণ রায় হিন্দুধর্মাবলম্বী। তা হলে এ বার প্রশ্নটা হচ্ছে পাঠ কে করে, মৌলবী নাকি পুরোহিত? মজার বিষয় হল এঁরা কেউ পাঠ করেন না। গ্রামের কোনো সৎ বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ এই পাঁচালিপাঠের দায়িত্বে থাকেন।
সব থেকে অবাক হওয়ার পালা আসে পুজোর শেষ অংশে। যখন পূজারি বলেন, “বলো বনবিবির নামে আল্লাহ আল্লাহ”…দিগ্বিদিক থেকে এক সঙ্গে সমস্বরে উচ্চারিত হয়, “আল্লাহ আল্লাহ”।
ঠিক তেমনি পূজারি আবার বলেন, “বলো, দক্ষিণ রায়ের এর নামে হরিবোল”… আগের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সমস্বরে উচ্চারিত হয়, “হরিবোল, হরিবোল”।
বিভিন্ন দ্বীপের বিভিন্ন ক্লাব বনবিবির পুজো করেন ঠিক যেমন কলকাতায় বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয়। তবে একটা তফাত আছে। কলকাতায় প্রত্যেকটা ক্লাব নিজের আলাদা আলাদা প্যান্ডেল করে পুজো করে, সুন্দরবনের চার-পাঁচটা ক্লাব মিলে তাদের ক্লাবের বনবিবি, দক্ষিণ রায়ের মূর্তিগুলো এক জায়গায় রেখে পুজো করে। প্রসাদ হিসেবে একটি পাতার ওপর দু’টো করে বাতাসা দেওয়া হয়।
জঙ্গল ঘোরা বাদ দিলে শুধু বনবিবির পুজো নিয়েই একদিন হই হই করে কাটিয়ে দেওয়া যায় সুন্দরবনে। এ বছর যাওয়া হল না পুজোয়। তাই বাড়িতে বসেই বলতে ইচ্ছে করছিল…
“বলো, বনবিবির নামে আল্লাহ আল্লাহ”,
“বলো, দক্ষিণ রায়ের নামে হরিবোল, হরিবোল”।
ছবি: লেখক