সঞ্জয় হাজরা
উদয়পুর থেকে আজ আমরা যাত্রা শুরু করলাম ১৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চিত্রগড় দুর্গ বা চিতোর দুর্গের উদ্দেশে। এক সময়ে মেওয়ারের রাজধানী ছিল চিতোরগড়। রাজস্থানে বেড়াতে এসে মীরাবাঈ-পদ্মিনীর স্মৃতিধন্য চিতোর না দেখলে রাজস্থান ভ্রমণ মনে হয় অসমাপ্তই থেকে যায়।
আদত নাম চিত্তৌরগড়। কিন্তু বাঙালিদের কাছে আবহমান কাল ধরে এই দুর্গ চিতোর নামে পরিচিত। বহু বীরগাথার সাক্ষী এই চিতোর দুর্গ শুধু ভারতেরই নয়, এশিয়ার বৃহত্তম দুর্গ। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৮০ মিটার তথা ৫৯০ ফুট উচ্চতায় প্রায় ৭০০ একর বা ২.৮ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই দুর্গ। দুর্গের পরিধি ১৩ কিলোমিটার। এই দুর্গ ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীরে ঘেরা। ২০১৩ সালে ইউনেস্কো এই দুর্গকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

এই দুর্গ ঘুরে দেখে নেওয়ার আগে এক বার এর ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। চিতোরের বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় – গড় তো চিত্তৌরগড় ঔর সব গঢ়ৈয়াঁ/ রানি তো রানি পদ্মিনী ঔর সব গধৈয়াঁ। লোকে মানুক বা না মানুক, রাজস্থানের প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের প্রথমেই মনে পড়ে চিতোরের ইতিহাস আর রানি পদ্মিনীর জহরব্রতের কথা।
গল্পকথা বলে, পাণ্ডবদের মধ্যমভ্রাতা ভীম এই দুর্গের পত্তন করেন। গল্পকথা থাক, ইতিহাসের কথায় আসি। এ নিয়েও মতান্তর আছে। কেউ কেউ বলেন, খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে মোরি রাজপুত চিত্রাঙ্গদ এই দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নাম থেকেই এই দুর্গের নাম হয় চিত্রকোট, তার পর চিত্রগড়, সেখান থেকে কালক্রমে চিত্তৌরগড় – বাঙালিদের কাছে চিতোরগড়। আবার এ নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকে বলেন, ষষ্ঠ শতকে মেওয়ারের গুহিলা শাসক বাপ্পা রাওয়ালের হাতে চিতোরের পত্তন। যাই হোক, এই দুর্গের বয়স যে অন্তত ১৪০০ বছর তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বার বার তিন বার বহিরাগতদের হাতে দখল হয়েছে এই দুর্গ। এবং তিন বারই দখলদারমুক্ত হয়। প্রথম বার এই দুর্গ দখল হয় ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে গুহিলা রাজা রতন সিং-এর আমলে, দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির হাতে। পরে এই দুর্গ দখলমুক্ত হয়ে সিসোদিয়া রাজপুতদের হাতে যায়। এর পর ১৫৩৪-এ উদয় সিং-এর কালে, গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহের হাতে চলে যায় এই দুর্গ। পরে আবার মুক্ত হয়। মুঘল সম্রাট আকবর চিতোরের দখল নেন ১৫৬৭ সালে।
পাহাড়ি পথে সাতটা ফটক দিয়ে প্রবেশ করে অবশেষে পৌঁছোতে হয় এই দুর্গে। সিসোদিয়া-রাজ রানা কুম্ভ তাঁর রাজত্বকালে (১৪৩৩-১৪৬৮ খ্রিস্টাব্দ) এই সাত প্রবেশদ্বার তৈরি করেন। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পাহাড়শীর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত পথে পড়ে এই ফটকগুলো – প্রথমে পদন পোল বা পয়দল পোল, তার পর একে একে ভৈরোঁ পোল বা সুরজ পোল, হনুমান পোল, গণেশ পোল, জোড়লা পোল, লক্ষ্মণ পোল এবং রাম পোল।

দুর্গে প্রবেশ করে প্রথমেই ঘুরে নিন মীরাবাঈ-এর কৃষ্ণ মন্দির তথা মদনমোহন মন্দির। ইন্দো- আর্য স্থাপত্যরীতির সঙ্গে ওড়িশার মন্দিরশৈলীর মিশেল । রানা সঙ্গের জ্যেষ্ঠ পুত্র রানা ভোজরাজের পত্নী রাঠোর-রাজপুত কন্যা কৃষ্ণভক্ত মীরাবাঈয়ের নামেও এই মন্দির পরিচিত। এই মন্দিরে বসে কৃষ্ণভজনার উদ্দেশ্যে গান বাঁধতেন মীরা, যে সব গান আমাদের কাছে মীরার ভজন নামে পরিচিত।
মীরাবাঈয়ের মন্দির চত্বরেই রয়েছে আরও বড়ো একটি মন্দিরটি। নাম কুম্ভ শ্যাম মন্দির, ইন্দো-আর্য স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। কারুকার্যময় পিরামিডধর্মী ছাদবিশিষ্ট এই মন্দিরে দেবতা বরাহ অবতাররূপী বিষ্ণু।

মীরার মন্দিরের কাছেই রয়েছে বিজয় স্তম্ভ বা জয় স্তম্ভ। এই বিজয় স্তম্ভকে চিতোরের প্রতীক বলা হয়। মালবের সুলতান মামুদ শাহ প্রথম খিলজিকে যুদ্ধে হারিয়ে মহারানা কুম্ভ এই স্তম্ভ নির্মাণ করেন। নির্মাণকাল ১৪৫৮ থেকে ১৪৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। সংকীর্ণ বৃত্তাকার পথে ১৫৭টি সিঁড়ি ভেঙে ন’তলা বিশিষ্ট ১২২ ফুট উঁচু এই স্তম্ভের শীর্ষে ওঠা যায়। উপর থেকে দুর্গের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং আরও নীচে আধুনিক চিতোরগড় শহরটি দেখতে বেশ ভালো লাগে। এই বিজয়মিনারটি ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা হলেও এখানে আরবি অক্ষর এবং আল্লাহ শব্দটি খোদাই করা রয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় ধর্মীয় মেলবন্ধনের প্রতি সেই সময়ের মহারানাদের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। এ ছাড়া এই মিনারটির স্থাপত্য আপনাকে আকর্ষণ করবেই।
বিজয় স্তম্ভ ছাড়াও এই দুর্গে রয়েছে কীর্তি স্তম্ভ, উচ্চতায় বিজয় স্তম্ভের চেয়ে কিছুটা ছোটো – ৭২ ফুট। তবে বয়সে প্রাচীন। ১১৭৯ থেকে ১১৯১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাওয়াল কুমার সিং-এর শাসন কালে এটি নির্মিত হয়েছিল। এটি সুরজ পোল বা অতীতের দুর্গের মূল ফটকের পাশেই অবস্থিত। এই স্তম্ভ প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথকে উৎসর্গ করা। জৈন স্থাপত্যের চিহ্ন বহন করছে কীর্তি স্তম্ভ।
মীরাবাঈ মন্দির, কুম্ভ শ্যাম মন্দির, বিজয় স্তম্ভ, কীর্তি স্তম্ভ ছাড়াও চিতোরগড় দুর্গে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্যগুলির মধ্যে রয়েছে পদ্মিনী প্রাসাদ, গৌমুখ জলাধার, রানা কুম্ভ প্রাসাদ, কালিকামাতা মন্দির, জৈন মন্দির এবং ফতেহ প্রকাশ প্রাসাদ ইত্যাদি।
পাহাড়ের উপরে এই দুর্গ অবস্থিত হওয়ার ফলে জলকষ্টের আশঙ্কা ছিল। তাই জলকষ্ট দূর করার জন্য এই দুর্গের মধ্যে ৮৪৮টি কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করিয়েছিলেন তখনকার মহারানারা। যদিও এখন তার মধ্যে শুধু ২২টিই রয়েছে। আর তার মধ্যে গৌমুখ জলাধারটিই সব চেয়ে প্রসিদ্ধ ও নান্দনিক। দুর্গের দক্ষিণে রয়েছে শিব মন্দির। সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচুতে গৌমুখ জলাধার বা কুণ্ড।
একাধিক বার এই দুর্গটি বহিরাগতদের দ্বারা আক্রান্ত হলেও তিন বার এই দুর্গের মানুষ বহিরাগতদের কাছে পরাজিত হয়েছিল। রাজপুত পুরুষরা যুদ্ধে মারা না যাওয়া পর্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করতেন এবং দুর্গের মহিলারা বহিরাগতদের থেকে নিজেদের সম্মান-মর্যাদা বাঁচাতে জহরব্রতর মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেন। বীর যোদ্ধা বাদল, গোরা, মহারানা প্রতাপ, রানা কুম্ভ, পাট্টা এবং জয়মালদের মতো কিংবদন্তি যোদ্ধাদের যুদ্ধের সাক্ষী ছিল এই দুর্গ।

তবে রানি পদ্মিনীর রূপে পাগল হয়ে বাদশা আলাউদ্দিন খিলজির তাঁকে পেতে চাওয়া ও ব্যর্থ হলে চিতোরগড় ছারখার করে দেওয়ার হুমকি এবং আলাউদ্দিনের কামনার আগুন থেকে বাঁচতে রানি পদ্মিনীর জহরব্রত উদযাপন ইত্যাদি ঘটনা নিয়ে যে কাহিনি প্রচলিত আছে তা চিতোরের ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়। কথিত আছে, আলাউদ্দিন খিলজির সেই অচরিতার্থ কামনার আগুন থেকে নিজেদের বাঁচাতে রানি পদ্মিনীর সঙ্গে বারো হাজার নারীও বরণ করে নিয়েছিলেন আগুনের দুঃসহ তাপ। জহরব্রত করে বিধর্মী শত্রুর লালসা থেকে আত্মসম্মান রক্ষা করেছিলেন তাঁরা। তবে বহু ইতিহাসবিদ রানি পদ্মিনীর এই কাহিনি বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করেন। সে যাই হোক, চিতোরের মানুষ কিন্তু এই কাহিনিকে সত্য ঘটনা বলেই মানেন। রাজস্থানি লোকগাথায় রাজা রতন সিং-এর পত্নী রানি পদ্মিনীর এই আত্মত্যাগ অমর হয়ে রয়েছে।
আজও যখন আমরা রানি পদ্মিনীর প্রাসাদের সেই অংশে যাই তখন আমাদের গাইড দূরের সেই জায়গাটি দেখিয়ে দিচ্ছিলেন যেখানে বসে প্রতিবিম্বের মধ্যে দিয়ে রানির রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন চিতোরের খলনায়ক আলাউদ্দিন খিলজি। তবে সেই জহর কুণ্ড আজ আর নেই। আধুনিক প্রজন্মের কাছে অভিশপ্ত অতীতের বিভীষিকাময় রূপকে তুলে না ধরে সরকার সেই জায়গায় পর্যটকদের জন্যে উপহারস্বরূপ বানিয়ে দিয়েছেন সবুজ ঘাস বিছানো ফুলের বাগান।

এই দুর্গে আছে একাধিক মন্দির। এ ছাড়াও রয়েছে দুর্গ থেকে দূরের শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্যে নিরীক্ষণ তোরণ। ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তায় ঘেরা দুর্গ রক্ষা করার জন্যে যে পাঁচিলগুলি তখনকার আমলে নির্মিত হয়েছিল, তার নির্মাণকৌশল আজও চোখে পড়ার মতো। এই দুর্গের মধ্যে রয়েছে একটি সংগ্রহশালাও। সেখানে মহরানাদের ব্যবহার করা নানান রকমের জিনিসপত্র সংরক্ষিত করা আছে পর্যটকদের দেখার জন্যে।
এই দুর্গের মধ্যে আজও বংশানুক্রমিক ভাবে বসবাস করেন একাধিক পরিবার। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দুর্গের উপর থেকে নীচে দেখলাম বর্তমান চিতোর শহরকে। লোককথায়, আজও নাকি রাতের অন্ধকার নামলে চিতোরের এই দুর্গে ঘটে চলে নানা অলৌকিক ঘটনা।

যা-ই হোক, রাজপুতদের বীরগাথার কেন্দ্রভূমি চিতোরগড়কে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরে চললাম আমাদের রাত্রিকালীন আবাসস্থল আরটিডিসির হোটেল ‘পান্না’য়। আগামী পর্বে আপনাদের সঙ্গে থাকব আজমের শরীফ এবং পুষ্করের গল্প নিয়ে। (চলবে)
ছবি: লেখক
আরও পড়তে পারেন
রাজভূমি রাজস্থান ১/ মরুভূমির প্রবেশদ্বার জোধপুরে
রাজভূমি রাজস্থান ২/ সোনার কেল্লার জয়সলমিরে
রাজভূমি রাজস্থান ৩/ দিলওয়ারা মন্দির, নক্কি লেকের মাউন্ট আবুতে