লামাগাঁওয়ের মন ঠিকানায়, বিজনবাড়ির সবুজ পাড়ায়

শ্যামলী মল্লিক

লামাগাঁও — সত্যি বলছি নামটা একেবারে অজানা। বিজনবাড়ি জানতাম কিন্তু লামাগাঁও নামটা মোটেই শোনা ছিল না। তাই ফেসবুকে মৌমিতার দেওয়া ছবি দেখে ও বর্ণনা পড়ে মনটা নেচে উঠল। কিছু দিন যাবৎ দার্জিলিংয়ের জন্য কেন জানি না মন কেমন করছিল। কিন্তু এমন ভাবে সুযোগ এসে যাবে ভাবতেই পারিনি।

মৌমিতার আশ্বাসে ইতিমধ্যেই কোভিডাতঙ্ক বেশ কিছুটা কাটিয়ে উঠেছি। বেরিয়ে পড়ছি ইতিউতি। তাই ছোট্ট একটা দল নিয়ে মৌমিতা যখন বিজনবাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল আমিও সেই দলের সঙ্গী হলাম। হ্যাঁ, অবশ্যই সব রকম সাবধানতা অবলম্বন করে।

বিকেল চারটেয় সরাইঘাট এক্সপ্রেস। যথাসময়েই ট্রেন ছাড়ল এবং ঠিক রাত একটায় পৌঁছে গেল নিউ জলপাইগুড়ি। সবে ঠান্ডা পড়ছে, জনশূন্য প্ল্যাটফর্ম, চারিদিকে কেমন যেন রহস্যময় গন্ধ। গাড়ি আসবে ভোর পাঁচটায়। অতএব চার ঘণ্টা আমাদের ওয়েটিং রুমে কাটাতে হল। গল্পগুজব করতে করতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আর ক্লান্তি শব্দটা তখন আমাদের জীবনাভিধানের বাইরে।

কথা রেখে ঠিক ভোর পাঁচটায় গাড়ি এল। চারিদিকে তখনও রাতের আঁধার সতর্ক সজাগ। গাড়ি ছুটে চলল সজাগ আঁধারকে আরও সচকিত করে। ইতিমধ্যেই কয়েক জন বেরিয়ে পড়েছেন প্রাতর্ভ্রমণে। গাড়ি ক্রমশ শিলিগুড়ির সীমানা পেরিয়ে রোহিনী রোড ধরে ছুটে চলল।

লামাগাঁও — নামটার মধ্যেই প্রেমে পড়ার হাতছানি। এত সুন্দর যার নাম, না জানি সে কত সুন্দরী। পথে যেতে যেতে মনে মনে তার একটা অপরূপ ছবি এঁকে ফেলেছি। দু’পাশে সবুজ প্রান্তরে তখন ভোরের আলোর ঘুম ভাঙছে। নরম তুলতুলে আলো লুটোপুটি খাচ্ছে চা-বাগানের বুকে। গাড়ি ছুটছে গন্তব্যের দিকে আর পথের প্রকৃতি রূপসী থেকে ক্রমান্বয়ে অপরূপা হয়ে উঠছে। আমরা মুগ্ধ, বাক্যহারা।

পাহাড়ি খাদে গোছা গোছা ফুল ফুটে আছে। ভোরের আলোয় তারা আরও মোহময়ী হয়ে উঠেছে। আমরা গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলাম। উত্তর বাংলার প্রকৃতি যত দেখা যায় ততই বুঝি আরও দেখার তৃষ্ণা জাগে। ক্রমে ঢুকে পড়লাম কার্সিয়াং শহরে। পাহাড়ি সবুজ বনানীর উপত্যকায় চোখ জুড়িয়ে যেতে লাগল। দূরে পর্বতশ্রেণি আরও কাছে যাওয়ার আহ্বান জানাতে লাগল।

এখানেই এক জায়গায় খাওয়া হল দারুন সুস্বাদু মোমো, ডিম টোস্ট আর চা। এর পর গাড়ি পেরিয়ে গেল ঘুম শহর, বাতাসিয়া লুপ। দার্জিলিংয়ের শহর বাজার ছেড়ে আমাদের গাড়ি ছুটতে লাগল ধ্যানমগ্ন নির্জনতার দিকে। পাহাড়ি পাকদণ্ডী পেরিয়ে পেরিয়ে দার্জিলিংকে পেছনে ফেলে আমরা পৌঁছে গেলাম সুন্দরী লামাগাঁও-এ। বিশেষ সাহুর হোমস্টেতে।

পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনন্য সুন্দর হোমস্টেটি। মন ভরে গেল। মৌমিতাকে সবাই ধন্যবাদ জানালাম এমন একটি আনকাট জায়গা বাছার জন্য। স্বর্গীয় সৌন্দর্য আর কোথাও নেই, আছে এই ধরণিতেই। এই ভূবনই স্বর্গ, এখানেই আছে স্বর্গের নন্দনকানন।

স্নান সেরে, খাওয়াদাওয়া করে বিকেলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম চার পাশ ঘুরতে। হোমস্টের ঠিক পেছনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। সূর্যাস্তের মৃদু চুম্বন তখন দূরে কাঞ্চনের শিখরে আদর করছে। যদিও তেমন মন ভরল না। আরও বেশিক্ষণ যদি সে ধরা দিত। বিশেষদাজু জানালেন, পরের দিন ঠিক ভোর পাঁচটায় তিনি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাতে নিয়ে যাবেন।

সে দিন সন্ধ্যায় দাজু একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। নেপালি হিন্দি ও বাংলা গানে জমে উঠল লামাগাঁওয়ের হিমেল সন্ধ্যা। সুরের তালে তালে, নাচের ছন্দে মিলেমিশে একাকার হল বয়সের সীমা। বয়সকে পকেটে পুরে, পা তাল ঠুকতে ঠুকতে যৌবনকে আরও এক বার ছুঁয়ে এল।

রাতে ভালো ঘুম হল না। মনে ভয়, যদি উঠতে না পারি। সেই আঠারো বছর বয়সে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখেছিলাম। আবার এত বছর পর পরিণত বয়সে এসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব। উত্তেজনার পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু বিমুগ্ধ করার জন্য কাঞ্চনও বুঝি অপেক্ষা করছিল।

লামাগাঁও থেকে কাঞ্চন দর্শন।

ভিউ পয়েন্টে যখন পৌঁছোলাম তখন কাঞ্চন তুষার শুভ্রতায় ঢাকা। ধীরে ধীরে তার ললাট রাঙা আলোয় রঙিন থেকে রঙিনতর হয়ে আগুন ছড়াতে লাগল। সে এক অনিবর্চনীয় স্বর্গীয় দৃশ্য। মনে হল এই আলোই দেবতা, এই রাঙা পর্বতই স্বর্গ। আর আজ আমরা ক’জন সেই ভাগ্যবানের দল যারা এই অনবদ্য অনুপম সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম।

মৌমিতা আর বিশেষদাজুর দৌলতে যে অমূল্য সম্পদ লাভ করলাম তা মানবজনমকে সার্থক করার জন্য যথেষ্ট। আনন্দ রোমাঞ্চে শিহরিত হয়ে হোমস্টেতে ফিরে এলাম। আমাদের চোখে মনে গল্পে শুধুই তখন অপরুপ কাঞ্চনজঙ্ঘা।

কার্সিয়াং থেকেই পথের আঁকেবাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছে। আজ সম্পূর্ণ ভাবে ধরা দিল। ধন্য হল জীবন। পুরি-সবজি দিয়ে জলখাবার সেরে বেরিয়ে পড়লাম বিজনবাড়ির উদ্দেশে।

অনেক দূর পর্যন্ত এসে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের বিদায় জানাল। ফিরতি পথে দেখা হল চেতনা ফার্ম। এখানেও আছে পাহাড়ি নদীর কোলে সুন্দর একটি হোমস্টে। এর মালিক আমাদের খাওয়ালেন দারুন সুন্দর চা। মেগাতর নামে একটি সুন্দর জায়গা দেখলাম আমরা, যেটি একটি পিকনিক স্পট বলেও পরিচিত।

এর পর এলাম বিজনবাড়ি। আমার কাছে সবুজ পাড়া। দারুণ সুন্দর ছবির মতো একটি জায়গা। ব্যাম্বু হোমস্টে। মুগ্ধ এখানে হতেই হবে। বিসর্জন দিতে হবে যত দুঃস্বপ্ন, যত ভাবনাচিন্তা। হোমস্টের ক্যাম্পাসের মধ্যেই বয়ে চলেছে রঙ্গিত নদী। নদী আর পাখীর দল সদাই এখানে গান শোনায়।

বিজনবাড়ির রিসর্ট থেকে রঙ্গিত নদী।

সারা দিন গাড়িতে ধকল হওয়ায় সে দিনটা আমরা বিশ্রাম নিলাম। ঘরেতেই খেলাম গরম কফি আর পকোড়া। এখানে ছোটো ছোটো কটেজে থাকার ব্যবস্হা। আছে সুইমিং পুল, ডাইনিং হল। এখানকার আতিথেয়তাও অত্যন্ত আন্তরিক।

পরদিন খুব ভোরে হাঁটতে বেরোলাম। চারিদিকে চা-বাগান আর পাহাড়ি স্রোতধারা। বিশ্রাম, আড্ডা আর মন ভালো করার উপযুক্ত মনোরম একটি পরিবেশ। নদীতে সকলে মিলে খুব জলকেলি করা হল। সন্ধ্যায় হল বনফায়ার, সঙ্গে চিকেন রোস্ট ও নাচা-গানা।

নদীতে জলকেলি।

সময় তো থামে না, পরদা উড়িয়ে সে বয়েই চলে। তরতরিয়ে কেটে যায় আনন্দের মুহূর্তগুলি। আমাদেরও ভ্রমণের সময় শেষ। এ বার ফেরার পালা। দার্জিলিংয়ে কেনা হল কুকিস। পথেই খাওয়া হল গরম ম্যাগি ও মোমো।

রাজনৈতিক মিছিলের জন্য রাস্তায় চার ঘণ্টা ধরে জ্যাম। অতএব ঘুরপথ। আবার কিছুটা উপরি পাওনা। আমাদের গাড়ি সীমানা হয়ে, পশুপতি ফটক দিয়ে নেপাল বর্ডার হয়ে এগিয়ে চলল। দারুণ সুন্দর এই রাস্তাটা। দু’ পাশে জঙ্গল আর চা বাগান। হাতি চলাচলের পথ। যথাসময়েই আমরা স্টেশন পৌঁছলাম। এ বার কলকাতায় ফেরার পালা।

দারুণ সুন্দর মনে রাখার মতো একটি ট্রিপ হল। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যে ভাবে উপভোগ করলাম তা ভাবাও যায় না। করোনা গোটা বিশ্ব জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছে ঠিকই, কিন্তু লকডাউন ফিরিয়ে দিয়েছে নির্মল পরিবেশ, নির্মল বাতাস, পাখির ডাক আর ফিরিয়ে দিয়েছে স্বচ্ছ পবিত্র কাঞ্চনজঙ্ঘা।

গুজব নয়, দূর দূর থেকেও এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। তাই হাতে যদি পাঁচ দিন সময় থাকে তবে বেরিয়ে পড়ুন পাহাড়ের কোলে। চাইলে মৌমিতার সাহায্য নিতে পারেন, ফেসবুকে সন্ধান পেয়ে যাবেন।

আরও পড়ুন: ভয়কে জয় করে ঘুরে এলাম মাইথন, সপরিবার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *