দিগন্ত বিস্তৃত বালিরাশি। তাতে অবাধ বিচরণ শুধু আমার আর গোটা কতক গোরুর। কোভিডের চোখরাঙানি, তাই বোধহয় সৈকত এত ফাঁকা!
কোভিড আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে বেশ কিছু জিনিস। আবার নতুন কিছু সুযোগও এনে দিয়েছে।
এই যেমন, প্রতি বছরই পুজোর পরে আমরা বেরিয়ে পড়ি অন্য রাজ্য ভ্রমণে। হিমাচল হোক বা উত্তরাখণ্ড। কিংবা কেরল বা গোয়া। কিন্তু এ বার তো সেই সুযোগ নেই। তা বলে কি একদম বসে থাকব বাড়িতে? কখনোই নয়। অগত্যা একটা গাড়ির বন্দোবস্ত করে বেরিয়ে পড়লাম। এ বার দক্ষিণবঙ্গ চষে বেড়াব। এবং প্রথম গন্তব্য তাজপুর।
অবশ্য তাজপুরকেই ভ্রমণের প্রথম গন্তব্য বলা ঠিক হবে না! পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর থেকে এই ভ্রমণ শুরু হয়েছে। পটাশপুরের কাজলা গ্রামে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমবিহার মঠের নতুন শাখা হয়েছে। ধানখেতের মাঝখানে মঠের বাড়িতে একটা দিন কাটাতে যে কী আনন্দ হয়েছিল তা বলে বোঝানো যাবে না।
কলকাতার ব্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে কাজলার মতোই এমন একটা জায়গার দরকার ছিল আমাদের।
কিন্তু কাজলা ছিল আমাদের নিজেদের মঠ। আর এখন রয়েছি তাজপুরের একটি রিসর্টে। তবে রিসর্টে পৌঁছোনো ইস্তক বিভিন্ন ভাবে হতাশ হতে হয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো ব্যাপারই প্রায় চোখে পড়ল না এখানে। যখন রিসর্টে ঢুকলাম, ম্যানেজার হোক বা কর্মী, কারও মুখেই মাস্ক দেখলাম না।
অথচ স্যানিটাইজ করার নাম করে ওই রিসর্টকর্মীরা আমাদের গায়ে কিছু স্প্রে করে দিতে চেয়েছিলেন। এই সব রাসায়নিক বস্তু শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক কোনো ধারণাই নেই আমাদের। জিনিসপত্রে স্প্রে করা অন্য ব্যাপার, কিন্তু শরীরে স্প্রে কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
কিন্তু যারা রিসর্টে আসা পর্যটকদের গায়ে স্প্রে করার জন্য এতটা উদ্যত, তারা নিজেরা মাস্ক পরছে না কেন? কোনো উত্তর নেই রিসর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
তবে ব্যাপারটা সেখানেই থেমে ছিল না। আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে। মাস্ক পরার ব্যাপারে আমি জারিজুরি করতে রিসর্ট কর্মীরা তো পরলেন, কিন্তু সেখানে থাকা একটি পর্যটকদলের কানে আমাদের কোনো কথাই গেল না।
আমাদের এখানে মাস্ক পরতে যাদের অনীহা, তারা অন্তত নিজেদের থুতনিতে বা কানে মাস্কটা ঝুলিয়ে রাখে। কিন্তু ওই পর্যটক দলে কোনো রকম মাস্ক ছিল না। রিসর্টের পরিবেশকে কলুষিত করে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মদ্যপান করে গিয়েছে।
এখানেই শেষ নয় অবশ্য। মাস্ক পরার আবেদন করেছিলাম বলে ওদের অসম্ভব টিটকিরির শিকার হয়েছি আমরা। খুব খারাপ লাগল যখন ওই দলের কয়েক জন সদস্য মাস্ক না পরে নেশার ঘোরে রিসর্টের বিভিন্ন প্রান্তে থুতু ফেললেন। আমি প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও রিসর্ট কর্তৃপক্ষ আমার পাশে দাঁড়ায়নি।
যা-ই হোক, দু’দিনের এই তাজপুরবাসে আমরা যা বুঝলাম তা হল নিজের সুরক্ষা নিজেদের কাছেই। ভ্রমণ বন্ধ করা যাবে না। কারণ ভ্রমণ আমাদের কাছে প্রয়োজনীয়তা। ৮ দিনের এই দক্ষিণবঙ্গ ভ্রমণে বেরিয়েছি শুধুমাত্র সেই প্রয়োজন মেটাতে।
তবে এটাও ঠিক, এই দু’ দিন তাজপুর সৈকতকে যে ভাবে উপভোগ করেছি, কোভিড না থাকলে এ ভাবে উপভোগ করা যেত কি না জানি না।
মনটা অনেক দিন থেকেই সমুদ্র সমুদ্র করছিল। কিন্তু দিঘা বা মন্দারমণি যাওয়ার সাহস করতে পারছিলাম না কিছুতেই। অগত্যা তাজপুরকেই বেছে নেওয়া। কিছুটা ঝুঁকি অবশ্যই ছিল। কিন্তু ফাঁকা সৈকতটাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে। এ যেন অচেনা তাজপুর।
তাজপুরের যে রিসর্টটি সমুদ্রের এক্কেবারে ধারে, সেখানেই উঠেছিলাম। রিসর্টের লন থেকে সৈকতে নামার জন্য রয়েছে বাঁশের তৈরি ঢালু পথ। জোয়ারের সময়ে সমুদ্রের জল এই বাঁশ-পথে ধাক্কা মারে। আর ভাটার সময়ে তাজপুর সৈকতের আসল চেহারা দেখা যায়।
বাংলার অন্যতম সেরা সৈকত কি বলা যায় তাজপুরকে? আমার সেটা বলতে কিন্তু কোনো আপত্তি নেই। গত বছর বগুড়ানের সৈকতকে সেরা বলেছিলাম। তার পরেই এই তাজপুরকে রাখব।
সকালে বাঁ দিকে ঘাড় ঘোরালে দুর্দান্ত সূর্যোদয় যেমন উপভোগ করেছি, তেমনই মোহিত হয়েছি বিকেলে ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্যাস্তের মুহূর্ত।
সঙ্গে গাড়ি ছিল, তাই মনে হল তাজপুর থেকে একটু ঘুরে আসি। একদিন প্রাতরাশের ঠিক পরেই বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু কোথায় যাব? ঠিক হল পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে ওড়িশায় ঢুকে যাই।
না, তালসারি যাইনি। আমরা গেলাম বিচিত্রপুর। বছর তিনেক হল পর্যটন মানচিত্রে বেশ জায়গা করে নিয়েছে বিচিত্রপুর।
প্রকৃতির উপহার বিচিত্রপুর। একেবারে নতুন পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে ওড়িশা সরকার গড়ে তুলছে বিচিত্রপুরকে। তালসারি নয়, এই বিচিত্রপুরের কাছেই বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সুবর্ণরেখা। এখানে রয়েছে একটি খাঁড়ি।
স্পিড বোটে করে সেই খাঁড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে সুবর্ণরেখার মোহনা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকটা সুন্দরবনের খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা এবং রোমাঞ্চ অনুভব করা যায়। দু’ দিকে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। তফাত বলতে শুধু বাঘটাই যা নেই।
কিন্তু এই খাঁড়ি-সফরের একটা মূল শর্ত হল জোয়ার-ভাটার সময়। ভাটা হয়ে গেলে বোট চলতে পারবে না। আর ঠিক সেই কারণেই এখানে একটা রাত কাটানো বাঞ্ছনীয়।
এখানে থাকার জন্য রয়েছে ওড়িশার বনোন্নয়ন নিগমের বিচিত্রপুর নেচার ক্যাম্প। তা হলে জোয়ার-ভাটার সময় অনুযায়ী খাঁড়ি-সফর করা যাবে। জঙ্গলের মধ্যে নেচার ক্যাম্পটাকে দেখে মনে হল, এখানে একটা রাত কাটানো কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর।
বিচিত্রপুরের কাছেই ভূষণ্ডেশ্বর। এই জায়গাটির খ্যাতি শিবলিঙ্গের জন্য। কোনো মন্দির নেই, মাটি থেকে বেরিয়েছে শিবলিঙ্গটি। স্বয়ম্ভূ। এশিয়ার বৃহত্তম শিবলিঙ্গ হিসেবে খ্যাতি তার।
এশিয়ার বৃহত্তম শিবলিঙ্গ কি না, সেটা নিয়ে বিরুদ্ধমত থাকতেই পারে। কিন্তু মাটি থেকে এ ভাবে শিবলিঙ্গ বেরোনো যে যথেষ্ট রোমহর্ষক একটা ব্যাপার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাতরাশ করে বেরিয়েছিলাম। মধ্যাহ্নভোজের আগেই ফিরে আসি তাজপুরে।
সৈকতে বেড়াতে এসে দু’টো কাজ দেদার হচ্ছে। প্রথমটা হল সৈকত ধরে হেঁটে বেড়ানো। আর দ্বিতীয়টা হল খাওয়াদাওয়া। বিশাল সাইজের পমফ্রেট আর পারশের সাহায্যে দুর্দান্ত পেটপুজো হয়েছে।
তাজপুরের সৈকত ধরে পশ্চিমে হাঁটলে দিঘা, আর পুবে মন্দারমণি। বিকেল ঘনিয়ে যখন সন্ধ্যা নামে, তখন দেখেছি দুই দিকে দিঘা আর মন্দারমণির আলোর ছটায় যেন কিছুটা ম্লান হয়ে রয়েছে অন্ধকার তাজপুর। কিন্তু সেই অন্ধকারই যে আমাদের খুব পছন্দের।
আর সূর্যোদয়ের সময়ে চওড়া সৈকত ধরে এগিয়ে গিয়েছি, দিকশূন্যপুরের উদ্দেশে। আমার এক দিকে বঙ্গোপসাগরের বিরামহীন ঢেউ আর এক দিকে ঝাউবন। নজর পড়েছে, কী ভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র। ঝাউবনকে গ্রাস করছে সে।
সমুদ্রকে কেন্দ্র করে এখানকার বাসিন্দাদের জীবনসংগ্রাম। তাই সক্কাল হতেই সবাই চলে এসেছেন সমুদ্রের ধারে। সৈকতের বিভিন্ন জায়গায় চলছে মীন বাছার কাজ। কেউ কেউ জাল নিয়ে চলে গিয়েছেন সমুদ্রের মধ্যে। ঢেউয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছে মাছ ধরা।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এই সমুদ্রই এখানকার সুখের কারণ, আবার দুঃখেরও। এই সমুদ্র আছে বলে এখানকার মৎস্যজীবী পরিবারগুলির সংসার চলছে। আবার মাঝেমধ্যে এই সমুদ্রের দানব জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে দিচ্ছে এখানকার চাষের জমি।
কিন্তু সে সব নিয়ে মানিয়ে চলতে হচ্ছে এখানকার মানুষদের। ঠিক যেমন বর্তমান কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হচ্ছে অবিরাম। লকডাউনের করাল গ্রাসে জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল এখানকার স্থানীয়দের। এখন ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে পর্যটন-কেন্দ্রিক অর্থনীতি।
তাজপুরের ফাঁকা সৈকতে দু’টো দিন বেশ উপভোগ করলাম। এ বার বিদায় জানাতে হবে, কারণ পরের গন্তব্য যে ডাকছে। (চলবে)