দ্বাদশীর জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় বিজনবাড়ি, সঙ্গী রঙ্গিত

পাপিয়া মিত্র

ঝিনঝিনে বৃষ্টি মাথায় পাচেং ছাড়লাম। এ বার যাব বিজনবাড়ি। আলুর পরোটা আর ঘরে পাতা টকদই সহযোগে প্রাতরাশ সারলাম। দু’টি রাতদিনের মাঝে কখন যে আমিনার সংসারের একজন হয়ে উঠেছিলাম বুঝতে পারিনি। চিয়াবাড়ির মালিকের গোরু আছে। খেতখামার আর গোরুর দেখভাল বিমল ছেত্রীর বাবা করেন।

বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে বিমলের ছোট্ট ছেলেটি আমাদের ৭ জনের হাতে লজেন্স দিয়ে গেল। ওর আজ জন্মদিন। আমরাও সামান্য উপহার দিয়ে এলাম।

আবার এলাম সোনাদায়। সেখান থেকে ঘুম। ঘুম স্টেশনের গা দিয়ে বাঁ দিকে যে রাস্তা সুখিয়াপোখরি গেছে, সেই রাস্তায় দু’-এক কিলোমিটার এসে গাড়ি ঘুরল ডান দিকে। এর পর রিশিহাট, মেরিবং, চংটং চা বাগান হয়ে গাড়ি নেমে এল একবারে ছোটো রঙ্গিত নদীর ধারে। নদী পেরিয়ে গাড়ি ঢুকে গেল বিজনবাড়ি বাজারে। তার পরে আরও একটা ছোট খোলা পার হয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের এ বারের ঠিকানা ব‍্যাম্বু রিসর্ট-এ। এটি বিজনবাড়ি শহর থেকে কিছু দূরে, রেলিং গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে। নামে রিসর্ট হলেও এটিও হোমস্টে।

ব্যাম্বু রিসর্টে খাওয়ার জায়গা।

বেশ কিছু পথ আসার পরে বৃষ্টি বিদায় নিল। নীলাকাশকে সঙ্গে নিয়ে সাদা মেঘের ভেলায় গা ভাসিয়ে গাড়ি চলল গড়গড়িয়ে। কিন্তু তা আর কতক্ষণ? নীল আকাশ আর সাদা মেঘ পাব বলে তো এই ঘনঘোর বর্ষায় পাহাড়ে আসিনি। যখন যেমন গাড়ি পাক খাচ্ছে তখন তেমন একটু একটু করে প্রকৃতির বদল হচ্ছে। আবার রিমঝিম ঘন ঘন রে, বরষে।

গাড়ি বেশ খানিক উতরাই পার হয়ে সোজা গড়িয়ে নেমে গেল বিজনবাড়ির ফটকের মধ‍্যে। সবুজ গালিচায় ইতস্তত জল জমে। আর এই জলে ডুব দিচ্ছে ইলশেগুঁড়ির ফোঁটা। আমাদের নিতে এলেন নেত্রা ঘালে। ছোটখাটো, শক্ত চেহারা।

আমাদের থাকার জায়গা দেখিয়ে দিলেন অন্য সাহায্যকারীরা। এই রিসর্টে মোট ৬টি থাকার জায়গা, কটেজ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এক লহমায় চোখ বুলিয়ে ফিরে গেলাম শিশুকালের ঝুলনদোলায়। এ যেন সেই কুঁড়েঘর, পুকুর, নদী, গাছ, গাছের আশপাশে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে নুড়িপাথর। আমরা, বড়োরা ঝুলনপূর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণকে ঝুলাতে দোলাতাম। আর পুতুল দিয়ে এক কল্পনার রূপ বাস্তবে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এই বিজনবাড়িতে এসে দেখলাম প্রকৃতি নিজেই সাজিয়ে রেখেছেন এক ঝুলনযাত্রার মোহময় দৃশ্য।

আমাদের ঘরটি ৫ নম্বর। কটেজের কাছে এগিয়ে আসতেই চোখে পড়ল সেই স্বপ্নের নদী রঙ্গিত। সব কিছু ভুলে হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে গেলাম আরও কাছে। নিরন্তর জলরাশি ডান দিক থেকে এসে নিজের ছন্দে চলেছে বাঁ দিকে। কটেজের ভিতরে ঢুকে দেখলাম আদিমতার ছাপ নেই কোথাও। অতি আধুনিক, কাচের দরজা-জানলা, পর্দায় মোড়া ঘর। এই ঘরটা ৪ শয্যাবিশিষ্ট। তাই কটেজ শেয়ার করেছেন আরও এক দম্পতি। আমাদের সাত জনের দলে থাকা মানুষ। যে যার মতো। সকলেই মুক্ত বিহঙ্গ। বয়স এখানে নিতান্তই একটা সংখ‍্যা মাত্র।

এখানকার কটেজ।

৫ নম্বর কটেজের কাছাকাছি আরও দু’টি কটেজ ও খাবার জায়গা। খেতে বসে মনে হল কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছি না। সবই হারিয়ে যাচ্ছে রঙ্গিতের জলতরঙ্গে। বড়ো বড়ো আদিম পাথরগুলোকে ভালোবাসার পরশ দিয়ে দিয়ে সোহাগিনী জলরাশি যেন কানে কানে কী বলে যায়। আবার আসিব ফিরে? খিদে মিটে গেল। নেপালের দিক থেকে মত্ত হস্তীর দল যেন ধেয়ে আসছে। কখনও কি একটুও শান্ত হবে না? একে একে সকলেই দুপুরের আহার শেষ করল। আগে থেকে জানিয়ে রাখা ছিল নিরামিষ খাবারের। তাই ভাত ডাল আলুভাজা আলু বিনস তরকারি পাঁপড়ভাজা। আর নৈশাহার রুটি ডাল, সবজি, ডিমের কারি।

সন্ধে নামতেই জলে এসে পড়ল চিকচিকে সাদা বালির আস্তরণ। যত চাঁদ ভাসে, তত জ‍্যোৎস্না লুটোপুটি খায় রঙ্গিতের শরীরে। মাতাল করা যৌবন নিয়ে ছুটে আসছে নেপালের দিক থেকে। শহুরে চিন্তাভাবনা বিসর্জন দিয়ে যেন কী কথা কয় মনে মনে। সকলেই মনে হল আবিষ্ট হয়ে আছে। হুঁশ ফিরল ম‍্যানেজারবাবুর ডাকে। এক হাতে পকোরার ট্রে আর অপর হাতে গরম পানীয়ের কেটলি।
এখন আর বৃষ্টি নেই। দূরে, বহূ দূরের পাহাড়ের কোলে কোলে একটি দু’টি আলোর দেখা মিলছে। পাহাড়ি সংসারে জীবনের স্পন্দন। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে ঘরোয়া যাপন, প্রিয়জনদের কাছে পাওয়া।

একটা গাড়ির আওয়াজ মনে হল। হ‍্যাঁ, ঠিক তাই। বিজনবাড়ির পথ ধরে গড়িয়ে আসছে দু’টি আলো। উতরাইয়ের পথ ধরে নেমে এল গাড়িটি। কিছুক্ষণ পরে আমাদের বসার গা লাগোয়া সুইমিংপুলের ধারে চলে এল ৬ নম্বর কটেজের বাসিন্দা দুই যুবতী ও একটি যুবক। এসেছে বিহারের মজফ্‌ফুরপুর থেকে।

দ্বাদশীর জ্যোৎস্না।

দ্বাদশীর জ‍্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে আমার মেয়েবেলার ঝুলনচত্বর। খড়ের চাল বেয়ে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছে রুপোলি স্রোত। নুড়িপাথরের পিঠে খেলে যাচ্ছে গাছগাছালির ফোকর দিয়ে আবছায়া সফেন দুধবিন্দু। সেই স্বপ্নের রঙ্গিতের ওপরে দোলায় দুলছে আমার রাধাকৃষ্ণ। তীরে তীরে সখীরা এখন ক্লান্ত, ঘুমের ঘোরে।

নৈশভোজের পরে একাকী খানিক ঘুরতে গিয়ে দেখি কালো মেঘের কোলে মুখ লুকিয়েছে আমার চাঁদ। অন্ধকার নেমে এল চত্বরের আনাচেকানাচে। অগত‍্যা ঘরমুখো। আমার সমস্ত ভালোলাগা নিয়ে বসে পড়লাম দাওয়ায়। বৃষ্টি এল ঝমঝমিয়ে। খড়ের চাল বেয়ে শ্রাবণধারা এলোমেলো, বৃষ্টি এল, বৃষ্টি এল। মানুষের দল দাওয়ায় এল। শ্রাবণমেঘে নাচে নটবর। পরের দিন ঘুম ভাঙল ঘড়ির নিয়ম মেনে।

দরজা বন্ধ করলে বহির্জগতের কোনো শব্দই কানে আসে না। দরজা খুলে চমকে যাওয়ার মতো দৃশ্য যে অপেক্ষা করছে তা ভাবতেও পারিনি। ফুলে ফেঁপে উঠেছে রঙ্গিত নদী। সারা রাত তুমুল বৃষ্টিতে উপরের ড‍্যাম থেকে জল ছাড়া হয়েছে। ফিনফিনে গেরুয়া সিফনে নিজেকে জড়িয়ে বল্গাহরিণী ছুটে চলেছে উদ্দেশ্যহীন ভাবে। গতকাল সকালে দেখেছিলাম নদীর ধারে ধারে পাথরের ওপরে জীবিকার সন্ধানে পাথর ভাঙার কাজ চলছে। নারীপুরুষ উভয়ের হাতুড়ির হাত উঠছে নামছে। চরাচরে জলপ্লাবনে আজ আর কেউ নেই।

নদী, আপন বেগে…।

গতকাল দুপুরে নদীর ওপারে চা-বাগানের কোলে কোলে চা-পাতা তুলতে দেখেছিলাম যে সব পাহাড়ি রমণীকে, আজ তারা এল কিনা জানা হয়নি।

প্রাতরাশ দিয়ে গেছে চা ডিম অমলেট আর ব্রেড। যেতে হবে পরবর্তী গন্তব্যে। গাড়ি জানান দিচ্ছে। চাঁদনি আলোয় ভেসে ওঠা আমার শিশুবেলার ঝুলনযাত্রাকে বিদায় জানিয়ে এ বার মুনথুমের দিকে এগিয়ে চলা।

বিজনবাড়িতে থাকা

ব্যাম্বু রিসর্ট, যোগাযোগ: ট্রাভেলিজম, ফোন: 8276008189, 9903763296।

ছবি: লেখক

আর পড়তে পারেন

শ্রাবণ-স্নাত চা বাগিচার সান্নিধ্যে

পাচেংয়ের আতিথেয়তা যে ভোলার নয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *