শ্রাবণ-স্নাত চা বাগিচার সান্নিধ্যে

পাপিয়া মিত্র

আবছায়া বাঁশের কুটিরে দীর্ঘ পথের বিশ্রাম। বাইরে শ্রাবণের রিমঝিম সুর। টুকটুক করে ঘরে ঢুকে লাফিয়ে একবারে খাটে। খাট থেকে কোলে। তুলতুলে শরীর নিয়ে কোল ঘেঁষে জায়গা করে নিল। গাল মুখ শুঁকে আরও আদর খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে বুকের ওপরে দু’ হাত তুলে দিল। এমনই আপ‍্যায়ন ঘোষণা করল ছোট্ট মাইকেল।

নিরাপদ আশ্রয়ে মাইকেল।

শ্রাবণস্নাত পথ শেষ হল আপার পাচেঙের চিয়াবাড়ি হোমস্টেতে। আকাশের মুখ ভার ভোর থেকেই। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় সাত জনের দলটি কুটিরের সামনে অপেক্ষায়। হোমস্টের কর্ণধার বিমল ছেত্রীর ঘরনি আমিনা এলেন খাদা নিয়ে। সকলকে খাদা পরিয়ে বরণ করে ঘর দেখিয়ে দিলেন।

পাহাড়ে বর্ষার রূপ দেখার ইচ্ছে ছিল অনেক দিন ধরেই। কিন্তু ইচ্ছের সায় সব সময় পাওয়া যায় না। তাই ইচ্ছে গুমরে মরে সংসারের জাঁতাকলে। আর এখন তো দোসর করোনা-আবহ। কোথায় যাব কোথায় যাব, এমনই চিন্তা মাথাচাড়া দিচ্ছিল ক’ দিন ধরে। মনে হল ঈশ্বর সহায়। খবর পেলাম ট‍্র‍্যাভেলিজিমের। ওখানকার কর্ণধার শ্রয়ণ সেন সব সমস‍্যা বাতলে দিলেন। যাতায়াত-সহ ১০ দিনের অফবিট রুট ম‍্যাপ, হোমস্টে বুকিং করে দিলেন। প্রথম গন্তব্য হল দার্জিলিং-এর পাচেং।

১৭ জুলাই সিক্ত শহর কলকাতাকে টাটা করে উঠে পড়লাম দার্জিলিং স্পেশাল-এ। ফটাফট কয়েকটি ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতেই মুহূর্তে দেওয়ালে ভেসে উঠল সাবধানবাণী আর অবাক করা ইমোজি। তা দেখে আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়ল মনে। শান্তিতে রাতের শয‍্যা নিলাম।

পাচেং-এর চা বাগান।

১৮ জুলাই, সকাল ৮-৪৫-এ নিউ জলপাইগুড়িতে নামলাম। ওখানেই অপেক্ষা করছিল সারথি বাপী ও লামা। গাড়ি যিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, সেই টিঙ্কুও ছিলেন। করোনা-আবহে পাহাড়ে গাড়িতে এখন ৫০ শতাংশ লোড নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। তাই বড়ো ও ছোটো দু’টি গাড়ি ঠিক ছিল।

এনজেপি স্টেশন থেকে রওনা দিয়ে হিলকার্ট রোড ধরে সুকনার কাছাকাছি এসে আমরা ঘুরলাম বাঁ দিকে। মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের বুক চিরে রোহিণী রোড ধরে এগিয়ে চললাম। এই পথ ধরার দু’টি কারণ – এক, হিলকার্ট রোড না ধরে এই পথে গেলে দূরত্ব কম পড়ে এবং দুই, পাগলাঝোরার উৎপাতে হিলকার্ট রোডে ধস। রোহিণী রোড কার্শিয়াং-এর কাছে গিয়ে হিলকার্ট রোডে মিশল। সঙ্গী ছিল ট্রয়ট্রেনের লাইনও।

আমরা কার্শিয়াং, টুং হয়ে সোনাদা শহরে এলাম। সোনাদা বাজার থেকে বাঁ দিকের পথ ধরে চলে এলাম পাচেং – ৫৮০০ ফুট উচ্চতায়। আমাদের হোমস্টের অবস্থান আপার পাচেং বলা হলেও আসলে তা আপার পাচেং ও পাচেং বাজারের মাঝামাঝি। পথসফরে সবুজের হাতছানি ক্রমশ ধূসর হয়েছে মেঘকুয়াশার দ্বৈত আক্রমণে। কোথাও বা শ্রাবণের ধারা চোখে অন্ধকার নামিয়েছে। জ্বলে উঠেছে শকটবাতি।

উচ্ছল পাহাড়ি শৈশব।

তিব্বতি ভাষায় ‘খাদা’র অর্থ উত্তরীয়। ‘চিয়া’ অর্থ চা। সুদৃশ‍্য পেয়ালায় চা সেবনের অনুরোধ নিয়ে ঘরে এলেন বিমল ছেত্রী। বাঁশ-দরমার ঠাস বুননে ও টিনের চালের সুদৃশ‍্য কুটিরে দু’টি দ্বিশয্যাবিশিষ্ট (৪ জন) ঘরে থাকার ব‍্যবস্থা। হোমস্টেতে দুই পরিবার এক সঙ্গে থাকতে হতে পারে এমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে সফরে বের হতে হবে। আবার কখনও তা নাও হতে পারে। বিমলের আবদার ফেলা গেল না। দ্বিপ্রহরের খাবার রেডি হয়ে গেলেও চায়ের রং ও সুবাস মোহিত করে তুলল।

মাইকেলকে নিয়ে গেলেন বিমল। আহারাদির ব‍্যবস্থা হয়েছে খোলা চত্বরে টেবিলছাতার নীচে। আমিনার তৈরি রান্নার স্বাদ নিতে নিতে গল্প চলল। বাবা-মা, দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার বিমলের। বিমলের পড়াশোনা কলকাতায়। হোটেল ম‍্যানেজমেন্ট নিয়ে পাশ করেছেন একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে। পাঁচতারা হোটেলে কাজের অভিজ্ঞতা ১৭ বছরের। গরম ভাতের সঙ্গে ডাল, পাঁপড়ভাজা, স্কোয়াসের তরকারি (পাহাড়ি অঞ্চলের উপাদেয় সবজি), বাড়িতে তৈরি আচার ও চিকেন কারি।

রিমঝিম বর্ষার গান চলেছে অবিরাম। সময়ের কাঁটা দৌড়োচ্ছে। ক্লান্তি নেই। ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। রংমুক, ওকস-সহ ৭টি চা-বাগান ঘেরা অঞ্চল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম অনেক পথ। পাহাড়ি পথের টান মনে হয় এমনই। বাঁকের মুখে যেন অদৃশ‍্যের হাতছানি। ‘আর একটু ঘুরে যাই। দেখি কী আছে?’ এমনি করে দীর্ঘ পথ এগিয়ে যাওয়া চা-বাগিচাকে সঙ্গে নিয়ে। কোথাও ধাপে ধাপে উঠে গেছে, আবার কোথাও নীচে নেমে গেছে। সবুজের কোলে কোলে প্রকৃতি সেজে উঠছে প্রতিনিয়ত। ফেরার পথ ধরতে হল ঝেঁপে বৃষ্টি নামায়।

পথের টানে।

কটেজে ফিরতেই সান্ধ‍্য চা আর আলুর চপে উষ্ণ হল ওষ্ঠ। একাকী অনুভবে জংলি পোকার গান চার দিক ক্রমশ ছেয়ে ফেলছে। ঘরের গুঞ্জন থেমে গিয়ে মগ্ন হল ঝিঁঝির তারতানে। জানলার বাইরে বিন্দুমাত্র আলোর ছটা নেই। পাতায় পড়া জলের ফোঁটার এক ছন্দময় গতি ঝিম ধরিয়ে দিল। দলের একজন গান ধরেছে ‘বঁধু, এমন বাদল দিনে তুমি কোথা?’ রাতের খাবারের ডাক পড়ল। ঘড়িতে ৯টা। ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন স‍্যালাড। বিমল নিজেই সার্ফ করে দিলেন।

ভোররাতে ঘুম ভেঙে গেল। বাঁশদরমার ঠাস বুননের দেওয়ালে কাচের জানলা দিয়ে ধোঁয়াটে আলো এসে পড়েছে। গতকালের বৃষ্টিধোয়া চড়াই-উতরাইয়ের পথে হেঁটে ক্লান্তি এসেছিল ঠিকই, কিন্তু এক ঘুমে শরীর-মন দুই ফুরফুরে। দরজা খুলে বের হতে দেখি দলের দু’ জন ছাতাচত্বরে চায়ের আসরে। ইশারায় শামিল হয়ে চুমুক দিলাম গলানো সোনায়। হালকা গন্ধে মন মজে উঠল। সামনের দিকে তাকাতেই মনে হল পাহাড়ের স্বর্গরাজ‍্য যেন সমুখের প্রান্তরে নেমে এসেছে।

হোমস্টের প্রবেশপথে নানা রঙের ফুলগাছের সমারোহ। এখানকার প্রতিটি বাড়ি, বারান্দা, ছাদের আলসে রঙিন হয়ে আছে। মাথায় নীলাকাশ, দূরে সবুজ প্রান্তর আর চার দিকে বসন্ত। ফুল আর পাখির সমাবেশ। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম এমন অফবিট জায়গায় আসার জন‍্য। সোনাদার সবুজের মধ‍্যে এমন জায়গা লুকিয়ে থাকবে তা ভাবতেও পারিনি। পথ জুড়ে পাইনগাছের কথাকলি, খাড়াই রাস্তা, কুয়াশা মেশানো মেঘের অভিমানের এক বিচিত্র মেলবন্ধনে এখানকার পরিবেশ নেশা ধরিয়ে দেয়। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়া।

পাচেং-এর অন্যতম দ্রষ্টব্য গ্রোটো।

পাচেং-এর গায়েই নালিচৌর গ্রাম। প্রথমে যাওয়া হল সেখানকার গির্জায়। চড়াই পথের পরে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে। ২০০৯-এ তৈরি এই পবিত্র স্থানটি ‘গ্রোটো’ অন্তর্ভুক্ত। এর অর্থ মাতা মেরি যে সব জায়গায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, সেই সব জায়গা ‘হোলি প্লেসে’ পরিণত হয়েছে। বলছিলেন, গির্জার দায়িত্বে থাকা স্থানীয় ডনবস্কো স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক থমাস লেপচা। সুউচ্চ স্থানে ক্রুসবিদ্ধ জিশু। নীচে থেকে ওপরে সাজানো ক্রুসবিদ্ধ নানা মোটিভ। এই মূর্তিগুলোর বিশেষ তাৎপর্য আছে। এখানে জিশুর জীবনের অন্তিম যাত্রাপথের বর্ণনা আছে। এই পথ ‘ক্রুসের পথ’ নামে অভিহিত। রোদবৃষ্টির খেলা নিয়ে নেমে আসা সমতলে।

সবুজের গালিচা চার ধারে। প্রকৃতি তার অদেয় ঐশ্বর্যে সাজিয়ে তুলেছে প্রান্তরের পর প্রান্তর। তারই মাঝে চোখে পড়ল দূরে লাল নীল সবুজ হলুদ গোলাপি ফুল। ভুল ভাঙল তাদের জায়গা বদল দেখে। নানা রঙের ছাতা মাথায় পাহাড়ি কন‍্যারা চা-পাতা তুলে ঝুড়ি ভরছে। মন ভোলানো চোখ জুড়োনো ছবির ক‍্যানভাস নিয়ে এগিয়ে চললাম। যখন যা খুশি আঁকতে পারি যেন।

এক জায়গায় রাস্তা শেষ হয়েছে দেখি। ছোটোবড়ো বোল্ডারে সামান্য পথ। জলের তীব্র আওয়াজ। কোনো ক্রমে আরও একটু এগিয়ে যাওয়া। ডান দিকে উঁচু পাহাড়ের কোল থেকে অবিন‍্যস্ত ভাবে ঝোরা নেমে আসছে। আদরে সোহাগে নুড়ি পাথরকে স্নান করিয়ে পথচারীর পা ভিজিয়ে দিয়ে আপন গতিতে বাঁ দিকে নেমে যাচ্ছে। জলস্রোতকে অনুসরণ ক‍রতেই চোখ চলে গেল পাহাড়ের মাথায়। গাছগাছালি উপচিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে গলানো রুপো। এই জলপ্রপাতের নাম ‘ইন্দ্রেনি ফলস’। নিচু বস্তি অঞ্চলে এটি।

ইন্দ্রেনি ফলস।

নেপালি ভাষায় ‘ইন্দ্রেনি’র অর্থ রামধনু। এক দিকে সবুজের গালিচা। অন্য দিকে ঔদ্ধ‍্যতের সীমা ছাড়িয়ে পাহাড়ের কোলে কোলে পাইনের সার। গম্ভীর। পাহাড়ি পথে সবুজের মাঝে যে যার মতো হারিয়ে যায়। এখানেই একা হওয়া। এখানেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া। চেয়ে দেখি সবাই একা একা হাঁটছে।

ফিরতি পথে দূর থেকে শুনতে পেলাম বাজনার শব্দ। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি একটি বৌদ্ধ গুম্ফায় পুজো চলছে। সেখানের দায়িত্বে থাকা লিম্বু দোর্জি ইয়োলমো এগিয়ে এলেন। উপস্থিত সকলে ব‍্যস্ত হয়ে পড়লেন অতিথিদের জন‍্য। গুম্ফার সামনে ফাঁকা জায়গায় চেয়ারে বসিয়ে গরম চা-বিস্কুটে আপ‍্যায়ন করলেন। নানা কথায় জানা গেল দরজি পশ্চিম মেদিনীপুরে কর্মরত ছিলেন।

গুম্ফায় খুদে পুণ্যার্থীরা।

ভ্রমণতালিকার প্রথম বিট পাচেংকে বিদায় জানাতে হবে। দু’টি রাতের নির্জনতা, দিনে মুক্ত বায়ু সেবনের প্রয়াস, বৃষ্টির নানা পোকার সখ‍্য নিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বিজনবাড়ি।

আসছি পরের লেখায়।

পাচেং-এ থাকা

চিয়াবাড়ি হোম স্টে, যোগাযোগ: ট্রাভেলিজম, ফোন: 8276008189, 9903763296।

ছবি: লেখক 

আরও পড়তে পারেন

ভয়কে জয় করে দু’ দিনের সফর করে এলেন ১২ সাহসিনী

পর্যটক এখন ব্রাত্য, তবু ছুটে যাওয়া পাহাড়ে

সাহস করে শিকল ভেঙে — দারোন্দার আঙিনায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *