পাচেংয়ের আতিথেয়তা যে ভোলার নয়!

শ্রয়ণ সেন

“আপনারা খুব শুভ দিনে এসেছেন। এখানে বসুন।”

আমাদের সাত জনের দলটাকে ঢুকতে দেখেই এগিয়ে এলেন লিম্বু দোর্জি ইয়োলমো। এমন ভাবে আমাদের স্বাগত জানালেন, মনে হল আমরা কত দিনের পরিচিত। দেখলাম, আশেপাশে যাঁরা রয়েছেন সবাই আমাদের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

কিঞ্চিৎ অস্বস্তিও লাগছে। একটা ছোট্টো গ্রামের ছোট্টো একটা মনেস্ট্রিতে এসেছি শুধুমাত্র পরিবেশটাকে উপভোগ করব বলে, এমন আপ্যায়ন তো আশা করিনি। এটাই হল পাহাড়ি মানুষের সারল্য। অপরিচিত মানুষকে দেখলে তাঁরা এমন ভাবেই স্বাগত জানান।

পাচেং সফরের দ্বিতীয় দিন আজ। উঠে পড়েছি খুব ভোরে। পাহাড়ের হোমস্টেতে থাকতে হলে সেই বাড়ির নিয়মকানুন মেনে চলা আমাদের, অর্থাৎ ভ্রামণিকদের একান্ত কর্তব্য। তাই বিমলদাজুর কথামতো কাল ন’টাতেই নৈশভোজ সেরে ফেলেছি। ফলে, ঘুমও হয়েছে অনেক তাড়াতাড়ি। সে কারণেই ভোর ৫টাতেই উঠে পড়া।

বৃষ্টি হয়েছে সারা রাত। সেটা কটেজের চালে জল পড়ার শব্দই বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে সাংঘাতিক ভারী কিছু হয়নি। এই বৃষ্টির কারণেই ঘুম থেকে উঠে চারিদিকটা আরও যেন সবুজ মনে হল। সেই সিরুবাড়ি ভিউ পয়েন্ট থেকে প্রাতঃভ্রমণ করে এলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এল প্রাতরাশ। গরম গরম আলুর পরোটা, দই আর আচার দিয়ে পেট ভরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আশেপাশের কিছু দর্শনীয় স্থান দেখতে।

দিন দশেক আগে পাচেংয়ের এই চিয়াবাড়ি হোমস্টে সম্পর্কে যখন খোঁজখবর নিচ্ছিলাম, তখনই দ্রষ্টব্য স্থানের একটা তালিকা দিয়েছিলেন বিমলদাজু। তবে সব সময় তো তালিকা ধরে মিলিয়ে মিলিয়ে ঘোরা হয় না। গাড়িতে যেতে যেতে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে অপার সবুজ উপভোগ করাও কিন্তু দ্রষ্টব্য স্থানের তালিকাতেই পড়ে।

যাই হোক, আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল একটি অসাধারণ জায়গা, নাম গ্রোটো (Grotto)। পাচেংয়ের একদম গায় লাগানো একটি গ্রাম নালিচৌর। সেখানেই রয়েছে এই গ্রোটো। মূল রাস্তার ওপরেই গেট। সেই গেট দিয়ে ঢুকে খাড়াই পথে কিছুটা উঠে পৌঁছে গেলাম একটা ভিউ পয়েন্টসুলভ জায়গায়।

এখানে ধাপে ধাপে সিঁড়ি করা রয়েছে। সেই সিঁড়ির একদম শেষে রয়েছে ক্রুশবিদ্ধ জিশুর একটা বিশাল মূর্তি। সিঁড়ির প্রত্যেকটা ধাপে রয়েছে ক্রস ও তার সঙ্গে কয়েকটি মূর্তি।

এগুলোর একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। এখানে জিশুর জীবনের অন্তিম যাত্রাপথের বর্ণনা আছে। এটা ‘ক্রুশের পথ’ নামে অভিহিত। গুড ফ্রাইডে’র দিন খ্রিস্টীয় উপাসনার সময় এই পথের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য আলোচনা করা হয়। খ্রিস্টান জীবনে এর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জায়গাটা দেখলেই অপার শান্তি আসে। বর্তমানে জায়গাটার দেখভাল করছেন থমাস লেপচা, চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে যিনি নিজেকে প্রভু জিশুর কাজে সঁপে দিয়েছেন।

পরিষ্কার দিনে এখান থেকে আশেপাশের চা-বাগানগুলির অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। তবে সে দিন মেঘবৃষ্টির যুগলবন্দির কারণে আমরা কিছুই দেখতে পাইনি। যদিও এখানে যতক্ষণ ছিলাম, অসাধারণ লেগেছিল।

গ্রোটো দেখে ফের পথ চলা শুরু। এ বার গন্তব্য ইন্দ্রেনি জলপ্রপাত। সোনাদার দিকে কিছুটা গিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে জনবসতি কার্যত উধাও। জঙ্গল বেড়ে গেল। আকাশ থেকে মেঘ নেমে এসেছে। সেই সঙ্গে নানা রকম পোকার ডাক। চারিদিকে একটা রহস্যময় ব্যাপার।

ক্রমশ নীচে নেমে চলেছি। দার্জিলিং পাহাড়ের সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একটি জায়গা দিয়ে আমরা চলেছি। বর্ষায় পাহাড়ি প্রপাতের রূপ কেমন হবে, সেটা ভেবেই শিহরণ জাগছে। কিন্তু প্রপাতটাকে আদৌ দেখা যাবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। কারণ আমরা এখন পুরোপুরি মেঘের মধ্যে ঢুকে রয়েছি। সামনের কয়েক পা রাস্তা ছাড়া কিছুই যে দেখা যায় না।

এ ভাবেই বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আচমকা মেঘের আস্তরণ উঠতে শুরু করল। ম্যাজিকের মতো সব মেঘ উধাও হয়ে গেল। খেয়াল করলাম আমরা ইন্দ্রেনি প্রপাতের একদম কাছাকাছি এসে গিয়েছি।

অসাধারণ একটা জলপ্রপাত। বেশ উঁচু থেকে নামছে। তবে তাকে দূর থেকেই উপভোগ করতে হচ্ছে, কারণ তার কাছে যাওয়ার রাস্তাটি কিছু দিন আগে নামা ধসের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে।

নেপালিতে ‘ইন্দ্রেনি’ শব্দের অর্থ রামধনু। আন্দাজ করতে পারলাম রোদ থাকলে এই প্রপাতে রামধনুর রঙ ধরে। তখন গোটা ব্যাপারটি আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। প্রপাতের কাছাকাছি যেতে পারলাম না ঠিকই, কিন্তু দূর থেকে যা উপভোগ করলাম, সেটাই বা কম কী।

পাচেং ফেরার পথে সারথি বাপিদার জন্যই মনেস্ট্রিটার সন্ধান পেলাম। রাস্তা থেকে কিছুটা নীচে মনেস্ট্রিটা দেখেই মনে ধরল। তাই বেশি অপেক্ষা না করে ঢুকে পড়লাম। সেখানে গিয়ে যা অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল, তা বলে বোঝানো যাবে না।

মনেস্ট্রিতে গিয়ে শুনলাম আজই গুরু পদ্মসম্ভবের জন্মতিথি। তাই বিশেষ প্রার্থনাসভার আয়োজন করা হয়েছে।

ছোট্ট একটা গ্রাম। নাম ইয়োলোগাঁও। সেখানেই রয়েছে এই মনাস্ট্রি, নাম তার ‘স্ন্যাং চোইলিং গুরুং গোম্পা।’ আজকের বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে গোটা ইয়োলমোগাঁও নেমে এসেছে এই মনেস্ট্রিতে। একজন লামা রয়েছেন, তাঁর নেতৃত্বে প্রার্থনাসভা চলছে। আমরাও সেই প্রার্থনায় একটু যোগ দিলাম।

লিম্বু দোর্জি ইয়োলমো এই গ্রামের বাসিন্দা। তবে চাকরি সূত্রে মেদিনীপুরে অনেক বছর কাটিয়েছেন। কলকাতাতেও থেকেছেন বেশ কয়েক বছর। ঝরঝরে বাংলায় কথা বলছেন তিনি আমাদের সঙ্গে।

তাঁর চায়ের আবদার ফেরানো গেল না। গরম ধূমায়িত এই চায়ের মধ্যে স্থানীয় গ্রামবাসীদের যে ভালোবাসা মেশানো ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রায় মিনিট কুড়ি কাটিয়ে দিলাম এই ছোট্ট মনেস্ট্রিতে। এ বার চললাম পরের গন্তব্যে। না, এ বার কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য কিছু ছিল না। ইচ্ছে ছিল চা-বাগানের মাঝে কোথাও একটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে চারিদিক উপভোগ করব।

পাচেংকে ছাড়িয়ে এ বার চললাম নীচের দিকে। গ্রামটা পেরিয়ে চারিদিকে শুধু চা-বাগান আর চা-বাগান। ওই যে বললাম সাত চা-বাগানে ঘেরা এই পাচেং। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু যা দেখা যায়, তাই বা কম কী!

এই চা-বাগান উপভোগ করতেই দু’টো দিন দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায় পাচেংয়ে। বর্ষা বলে চা-বাগানে কাজ করছেন স্থানীয় মহিলারা। চা-পাতা তোলা হচ্ছে। এই সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এবং মেঘ। চারিদিকে অদ্ভুত একটা মাদকতা বিরাজ করছে। এই রাস্তাটাই সোজা নেমে গেছে বালাসোন নদীর তীরে। তবে এখন বর্ষার শেষের কিছুটা রাস্তা বেশ খারাপ, তাই বিমলদাজু সেখানে যেতে নিষেধ করেছেন।

ফিরে এলাম হোমস্টেতে। এ বার বাকি দিনটা শুধুই চিয়াবাড়িতে কাটিয়ে দেওয়া। আজই শেষ সন্ধ্যা পাচেংয়ে, তথা চিয়াবাড়িতে। এই দু’ দিন বিমলদাজু আর তাঁর পরিবারকে যে ভাবে পেলাম তা এক কথায় মনোমুগ্ধকর। মাত্র ৩০ ঘণ্টার আলাপে কেউ এতটা আপন হয়ে যেতে পারে, সেটা সম্ভবত পাহাড়ে না এলে বিশ্বাসই করা যায় না।

কাল রওনা বিজনবাড়ির পানে। কিছুটা মন খারাপ আবার অনেক বেশি আনন্দ। কারণ বিমলদাজুর সঙ্গে যে সম্পর্কটা তৈরি হল, সেটা এখন চলবেই। আমাদের পরিবারেরই সদস্য হয়ে গেলেন বিমলদাজু। 

চিয়াবড়িতে আপনি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পাবেন না। কিন্তু আশেপাশের সবুজ আপনার মন ভুলিয়ে দেবে। বর্ষা হোক বা শীত, বসন্ত হোক বা গ্রীষ্ম, সব সময় একগাল হাসি নিয়ে আপনাকে স্বাগত জানাতে তৈরি বিমলদাজু ও তাঁর পরিবার। (চলবে)

পাচেং-এ থাকা

বিমল ছেত্রীর চিয়াবাড়ি হোমস্টেতে রাত্রিবাসের যাবতীয় আয়োজন করে দিতে পারে ট্র্যাভেলিজম (Travelism)। যোগাযোগ করুন: 8276008189 অথবা 9903763296 নম্বরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *