করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/৭: সরকারি ঘোষণার পরে লেগে গেল স্নান-রাজনীতি

অশোককুমার কুণ্ডু

কে আর হাঁটে এই চড়া রোদে। পঙ্গতে সম্মাননীয় অতিথি হয়ে ধর্মগুরুদের বিপরীতে লাইনে দূরত্ব রেখে বসেছিলাম। এটাই কানুন। এবং এ-ও কানুন, ভোজন শেষে সম্মানী-খাম সকলের হাতে দেন আয়োজক মঠপ্রধান। কিন্তু তা বলে এতটা! দু’টো কড়কড়ে পাঁচশোর নোট। চলো মুরারি, হিরো বন গয়া!

“এই রিকশা, নীলধারা জায়েগা?” ম্যায় তো শাহা বন গয়া। একটু টিপে চললে রাহা খরচাটা দিন চার চলবে। “কী বলো ধর্মাশোক?”

“সে আর বলতে? খুঁজে পেতে আরও খান তিন-চার পঙ্গত বের করে দিচ্ছি। স্মরণ রেখো ভাই। মাল কিন্তু বখরা হবে ফিফটি ফিফটি।”

আমি এমন উত্তরে অবাক। এই পুণ্যভূমিতে আধাআধি হিস্যা? তুমি আমার কত আপন, অন্তরঙ্গ জন।

ধর্মাশোকের বাস্তব ও হৃদয়হীন উত্তর – কেন? রাজা হরিশচন্দ্র শ্মশানে আপন স্ত্রীর কাছে মৃত সন্তানের দাহকাজে ঘাট-খরচ মকুব করেছিল? শৈব্যার অশ্রুসিক্ত কাতর অনুনয়, বিদ্যুৎ চমকে দেখতে পাওয়া পুত্রের মৃত মুখ কি হরিশচন্দ্রকে আপ্লুত করেছিল?

নীলধারার আদি প্রবাহের পুব দিকে চিতা জ্বলছে। আমি সেই দিকেই চলেছি রিকশা ছেড়ে দিয়ে। এই স্থল আমার বড়ো প্রিয়।

হরিদ্বার ভ্রমণে দু’-এক দিন এখানে অবশ্যই আসি এবং এখানকার চড়ায় শুয়ে পড়ি, পাই ‘পাথুরে বিশ্রাম’। কোনো শ্মশান-বৈরাগ্য না। জন্ম-মৃত্যু-জীবন-যৌবন কেমন করে গ্রাস করে অগ্নি! সে স্মৃতি খায়। প্রীতি উগরে দেয়। ব্যোমে বিলীন হয়। বীজ-সূত্র-সম্পর্ক রেখে যায় সন্তানের করতলে। এই তো জীবনমন্থন। অমৃত পরম্পরা। এই সব ভাবি বিশ্রামের মধ্যে।

ধর্মাশোক চলে গেছে কিছুটা দূরে কেশব আশ্রমে। ওখানে সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে লাহিড়ী, শ্যামাচরণজির শ্বেতমর্মর মূর্তির পদতলে। ওই স্থানটিও শান্ত। আমার হরিদ্বার ভ্রমণে বিশেষ দ্রষ্টব্যস্থল। এত বড়ো ক্রিয়াযোগী আর কি আসবেন?

বাধানিষেধ না মেনে কুম্ভভ্রমণে  

এ বার প্রত্যেকের বাধানিষেধ না মেনে কুম্ভভ্রমণে এসেছি। ঘরসংসার, নিকটজন প্রত্যেকেই হতাশ হয়েছে আমার জেদে। শুধু এক তরুণ ভ্রামণিক পোর্টাল-সাংবাদিক ঋভুবুড়ো আমাকে সাহস দিয়ে বলেছিল, “তোমায় কুম্ভ ডাকছে, তুমি নিশ্চয়ই যাবে। মনের জোরই তোমার সেকেন্ড ডোজ। করোনার ফার্স্ট ডোজ তো নিয়েছ।” হরিদ্বারে এ বার পূর্ণকুম্ভে এসে ঋভুবুড়োর কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল – “কিচ্ছু হবে না। মনের জোরে তুমি পার হবে। অবশ্যই কোভিড-বিধি মেনো। একাধিক মাস্ক নিও। স্যানিটাইজার নিও। আর দূরত্ববিধি অবশ্যই মানবে।” আমি অবশ্য ঋভুবুড়োর নির্দেশ পালন করেছি সর্বত্র।

এত সংকটেও আমি পাঠক-পরিষেবার কাজে গাফিলতি করিনি। হরিদ্বারের আগেই নামা, জ্বালাপুরে করোনা টেস্টের জ্বলুনি। দুপুরে চৈত্রের রোদ, রিকশার গোলকধাম, পুলিশের হুজ্জতি। পিঠের বোঝা-সহ আরেক সচল বোঝা (ট্রলি) টেনে আশ্রমে পৌঁছে কুকুর ধোঁকা। তার পর এন্ট্রি। ঘরের অ্যালটমেন্ট। আশ্রমের আই কার্ড নিয়ে দোতলায় ঘরে ঢুকে, হাত ধুয়ে, স্যানিটাইজার স্প্রে করে বিছানায় চিতপটাং। থ্রি বেডেড রুম উইথ অ্যাটাচড বাথ দেখে মন খুশ। করোনার জন্য আশ্রমে যাত্রী কম। বিছানায় শুয়েই মড়া। ঘণ্টাখানেক পরে ঘুম ভাঙল বন্ধুর ফোনে। নিরাপদে পৌঁছোনোর সংবাদ জানতে চাইল। আমার হাত-পা তখনও সামান্য সামান্য কাঁপছিল – জার্নি আর তৎসংক্রান্ত ধকলে।

লিখতে বসে গেলাম। এপ্রিলের ১২ তারিখে সোমবতি অমাবস্যার স্নান তো হয়ে গেছে সকালের পুণ্য লগ্নে। এটি দ্বিতীয় শাহি স্নান। প্রথম শাহি স্নান তো হইচই করে কবেই হয়ে গেছে – ১১ মার্চে, মহাশিবরাত্রিতে। প্রসঙ্গত জানাই, মহাশিবরাত্রির স্নানে কোভিডবিধি শিকেয় তুলে জলে ডুবকি দিলেন হাজার হাজার নাগাবাবা, যাঁরা প্রতিটি আখাড়া-প্রধানের অনুগামী হয়েছিলেন। সেই স্থানে অনুগামী হয়ে সন্ন্যাসীদের পরেই ডুবকি মেরেছিল বুভুক্ষু পুণ্যলোভী ভারতবর্ষ। কোথায় করোনা? স্নান করা, না-করা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বচসা, লাঠালাঠি, মৃদু চার্জ – সংবাদে আসেনি। হৃষীকেশের বাঙালিবাবা সূত্রে প্রাপ্ত। মার খেয়েছিল পুলিশই।

১২ এপ্রিল, সন্ধ্যা ৭টায় কপি গেল। ছাপা হল ১৩ এপ্রিলের দৈনিকে। কপি পৌঁছোনোর পরে হাঁফ ছাড়া। কাল আবার দেখা যাবে। আশ্রমের বেসমেন্টে নামলাম হাত-মুখ ধুয়ে। পূজারতি দেখে শরীর কিছুটা ধাতস্থ হল। বড়ো রাস্তায় কিছুটা পায়চারি করে প্রসাদের (রাতের খাবার) ঘণ্টার অনুসরণ করলাম। স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই চেনা মুখ। অসীম, গণেশরা এসেছেন। বাবু গায়েনের আধমণি ভুঁড়ি কমেছে। বাবু হেড কুক। অনেক দিন, মাস, বছর পরে আবার দেখা। পেট পুরে খেয়ে এক ঘুমে কোকিল ডাকল। ভোরের কোকিল।

চৈত্রসংক্রান্তির পুণ্যস্নান

১৪ এপ্রিল বুধবার, মহাবিষুব সংক্রান্তি। সহজ কথায় চৈত্রসংক্রান্তি। লোকউৎসবে বিশেষিত এ দিন, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে গাজন-চড়ক উৎসব। এবং কুম্ভমেলায় এ দিন পুণ্যস্নান। সর্বভারতীয় সন্ন্যাসী-বৈরাগী-উদাসীন ও সমস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে মহাবিষুব সংক্রান্তি এবং এই স্নানযোগ একটি শাহি বা বিশেষও বটে।

ভোরেই পৌঁছে গেছি স্নানঘাটে। কে বলবে হরিদ্বার নামক তীর্থের কুম্ভে করোনা এসেছিল নীরবে। থাকছেও নীরবে। মহাপ্রস্থানের পথে নিয়েও গেল একাধিক প্রাণ। ঠিক কত জনকে? তার সঠিক হিসাব সরকারি সিন্দুকেও নেই। নিন্দুকে বলছে, মৃতের সংখ্যায় সরকারি বেনোজল। চ্যাংড়া ফাজিলরা বলছে, মড়া ইজ মড়া। ওরা কি কথা বলবে? জানান দেবে, করোনায় খেয়েছে মোদের পরমায়ু-প্রাণ? কী হবে মড়ার হিসেবে? তা-ই দিয়ে কোন পঞ্চশালা হবে? ছোড়ো না ইয়ার।

শৈব্য-বৈরাগী বাহাস-বিতর্ক

হরিদ্বারে আখাড়ায়, সাধু-সন্ন্যাসীদের ডেরায়, পরীক্ষিত সত্য, করোনা নীরবে ঢুকে পড়েছে। এর পরে ভারতীয় অন্ধ ধর্মবিশ্বাসীরা বলবেন, গোমূত্র এবং গোবর দিয়েই করোনা করব জয়। ও সব করোনা-টরোনা ফালতু। শাহিস্নানে ডুবকি মারো। ‘রমতা সাধু, অওর বহতা পানি’। করোনা মরবে। ওর বাপ মরবে। ওর চোদ্দো পুরুষ মরবে। মা গঙ্গার বহতা পানি করোনার মৃতদেহ লীন করে দেবে পুণ্য নীরে। ‘লাগ ভেলকি লাগ, ঘুরে ফিরে লাগ’।

লেগে গেছে ভেলকি। বাচ্চালোগ তালি বজাও। সরকার ঘোষিত নীতি: সংক্ষিপ্ত হয়েছে কুম্ভের সময়। মাত্র ৩০ দিনের। ১১ মার্চের মহাশিবরাত্রির পর থেকে এক মাস মানে তো ১১ এপ্রিল পর্যন্ত, সে তো পেরিয়ে গেছে। এর পর ১২ এপ্রিল সোমবতি অমাবস্যার স্নান তো হল। পরের দিন নীলপুজো, সে স্নানও হল, হল চৈত্রসংক্রান্তির স্নানও। সরকারি ঘোষণা মোতাবেক পূর্ণকুম্ভ তো শেষ। তা হলে বৈরাগীদের (বৈষ্ণব) গুরুত্বপূর্ণ স্নান – রামনবমী (২১.০৪.২১) এবং চৈত্রপূর্ণিমার (২৭.০৪.২১) স্নান বাতিল? শৈব্যদের (সন্ন্যাসী) মুখ্য স্নানগুলোর শেষে এই ঘোষণা কেন? কুম্ভমেলাটা কি শুধু শৈব্যদের (সন্ন্যাসী)? ভারতবর্ষের অধাত্ম্যবাদের এরাই শুধু রক্ষক-প্রচারক? বৈরাগীরা (বৈষ্ণব) কি ভেসে এল পাকিস্তান থেকে, সিন্ধু-স্রোত ধরে?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীজি জুনা আখাড়ার প্রধান আচার্য-মহামণ্ডলেশ্বর স্বামী অত্তধেশানন্দ গিরিজিকে অনুরোধ করেছেন, স্নানমেলা সংক্ষিপ্ত করতে। মোদীজির অনুরোধকে সম্মান জানিয়ে অত্তধেশানন্দজি টুইট করে পুণ্যলোভী, পুণ্যপ্রেমিক ভক্তদের এই পরিস্থিতিতে স্নানে না আসতে অনুরোধ করেছেন।

বৃন্দাবনের বৈরাগী (বৈষ্ণব) সমাজের একাধিক বাবাজি ফোনেই উত্তর দিলেন, “করোনা-সংকটে দেশ ভুগছে, প্রায় ডুবতে বসেছে। ঠিক কথা। তা হলে তো অনেক আগেই, শুরুতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারত। এক্কেবারে মহাশিবরাত্রির আগেই কুম্ভ ভার্চুয়াল হতে পারত। ধর্মীয় সংগঠনের সব প্রধানই শুধু ডুবকি দিয়ে দেশবাসীকে বার্তা দিতে পারতেন (এক গলা জলে দাঁড়িয়ে?) কোভিড শর্তাবলি মেনে নিয়ে এই স্নান। তখন কি নাকে শেফলা তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন ওঁরা?”

লেগে গেছে স্নান-রাজনীতি। হরিদ্বারে অত্যন্ত পাওয়ারফুল বড়া ও নয়া উদাসীন। এখন বিতর্ক-বাহাস ভাষ্যে মার্জার-কলহ শুরু হয়ে গেছে নির্বাণী বনাম নির্মোহী। এ দু’টি সংগঠনই হরিদ্বার কাঁপাতে পারে। প্রতিযোগিতা চলছে কে কাকে রগড়ে দিতে পারে। ধুয়ে দিতে পারে। মিডিয়া এই সব নিয়ে পায়সান্ন রাঁধছে। এখন পাতে মুচমুচে নিম-বেগুন ভাজা দিচ্ছে।

জগতে, আমার মতে সেরা কাজ হল, নিরাপদ দূরত্বে বসে গৃহী-গেরুয়া-তিলকধারী এবং আপাত পণ্ডিতদের মূর্খামি দেখা ও শোনা। 

তবে সেরা লোকায়ত পুণ্যস্নানের খবর আমায় দিয়েছে ধর্মাশোক। শুনুন।

গঙ্গায় নায়ে পাপীতাপী/ভোরে নায়ে চোর। (তস্কররা ফিরে এসে ভোরে স্নান করে নিত। কারণ গায়ে সিঁধ কাটার ধুলো ও পিচ্ছিল তেল গায়ে লেগে থাকত)/কল-গঙ্গায় নায়ে বটে/বহুত পুণ্যের জোর।

এর সমান্তরাল পাঠ, ভিন্ন সুরে শোনাই –

গঙ্গায় নাইলে চার পো পুন্যি/নদীতে নাইলে আধা/পুষ্করিণীতে সিকি বটে/ডোবায় নাইলে গাধা।

আমার এক পাতানো মায়ের কাছে শোনা। প্রতিমা গায়েন, কাজিরহাট, পোস্ট- লাকুড্ডি, বিটি কলেজ মোড়, বর্ধমান। (চলবে)

আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *