করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/শেষ পর্ব: বিদায় ব্রহ্মকুণ্ড, বিদায় হর কি পৌড়ী

অশোককুমার কুণ্ডু

এমন সুযোগ কদাচ মেলে। সুবর্ণ সুযোগ। হ্যাঁ, একজন জৈন দিগম্বর দাঁড়িয়ে আছেন। আমজনতার স্নান দেখছেন। উদাস দৃষ্টি। জনস্রোত আর গঙ্গার স্রোত মিশে বয়ে চলেছে ব্রহ্মকুণ্ড থেকে অরূপকুণ্ডে। এই জৈন দিগম্বর মুনিজি মাস্কহীন, মুখ উন্মুক্ত। দক্ষিণ হস্তে ছোট্ট একটি মৃত্তিকাপাত্র। গায়ে একটি ছোট্ট শুভ্র চাদর। মুখে ধর্মীয় ঢাকনাও অনুপস্থিত। দিগম্বরের সঙ্গে বাক্যালাপ করে আমি তাঁকে বিব্রত করিনি। কিছুক্ষণ স্থির থেকে, ধীর পদক্ষেপে উনি চললেন আপন আশ্রম সুখীনালার নিকটবর্তী। ওঁর নাম সংযম সাগর (দিগম্বরজি)। সামনের তিথিতে হেঁটে যাবেন গোমুখে, উনি একাই। এত শত জানলাম কেমন করে, একটি শব্দও বিনিময় না করে? সংযোগে সাহায্য করেছিলেন ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু, জৈন মন্দির বিশেষজ্ঞ পুরুলিয়া-চেলিয়ামার সুভাষ রায়। অপূর্ব সব তথ্য পেলাম তখুনি রাজস্থানে ফোন করে। সিনিয়ার দিগম্বর মণীষ ব্রহ্মচারীজির কাছে। ইউপি-র মানুষ।

মন খিঁচড়ে গেছে। কুম্ভমেলা টাল খেয়েছে। আমার ফেরার টিকিট এপ্রিলের শেষ দিনে। ক্লান্তিকর চুপচাপ একা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ঘরে এখনও প্রায় দু’ হপ্তা। ফুয়েল (সদ্‌ অর্থে) বাড়ন্ত। হাঁটতে পারব না। চড়া ভাড়ায় রিকশা/অটো নিতে পারব না। শরীরের চার্জারও ডাউন। সন্ধ্যায় সুসংবাদ, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কোটায়, গ্রুপ টিকিটে আমারও স্থান হয়েছে। জয় গুরুমহারাজ।

‘বাঙালি হাসপাতাল’কে প্রণাম

হরিদ্বারে এলে কনখলে এই হাসপাতালে অন্তত এক বার আমাকে দর্শন দিতেই হয়। ২০১০ সালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভমেলা কভার করতে এসে জ্বর-সর্দিতে কাবু হয়ে গেছিলাম। এখানকার চিকিৎসাতেই সুস্থ হয় উঠি। হাসপাতালের নাম ‘রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম’। সাধারণের কাছে রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতাল। রিকশা, অটো এবং টাঙার ঘোড়াও জানে-চেনে ‘বাঙালি হাসপাতাল’। অবশ্য রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতাল/সেবাশ্রম বললেও চিনবে।

গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী অসুস্থ হলে তাঁদের চিকিৎসা পরিষেবা কে দেবে? সময়টা ছিল বিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিক। তখনকার হরিদ্বারে কোনো হাসপাতাল ছিল না। এই সংকটে স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশে তৈরি করা হয় এই হাসপাতাল। ১৯০১ সালে কল্যাণানন্দজি স্থাপন করেন। শুরুতেই কল্যাণানন্দজির সঙ্গে সাথ দেন নিশ্চয়ানন্দজি। ভারতে হসপিটাল সার্ভিসের ইতিহাসে এই হাসপাতাল এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত।

এখন তো এখানে সাধু-সন্ন্যাসী ছাড়াও আমজনতা পরিষেবা পেয়ে থাকেন। সেখানে গেলাম। আমার এবং প্রহরীর, দু’ জনেরই মুখে মাস্ক। করোনাবিধি। কাউকে বিরক্ত না করে গেটে মাথা ঠেকালাম। নিশ্চিত আমি, আমার এই প্রণাম আমার দেশের মানুষ কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণদেব এবং জয়রামবাটীতে আমার মায়ের কাছে পৌঁছোবে।

কনখলে অন্যত্র ঘোরাঘুরি

অনেক দূরে, প্রায় প্রান্ত কনখলে পাইলটবাবার শুনসান আশ্রম। খুব সকাল সকাল হাজির হলাম। করোনার কারণে একা কুম্ভ রক্ষা করে বসে আছেন নীলকণ্ঠানন্দজি। আমার বিশেষ পরিচিত। আদি দেশ বেহালা থানা সংলগ্ন। সামান্য কথা হল। বাইপাস হয়ে গেছে ওঁর। পালিত কন্যা শিউলি পুত্র-সহ মথুরায় সংসার পেতেছে। বড়ো নিঃসঙ্গতাবোধে আক্রান্ত উনি। জলদি বেরিয়ে এলাম। লকডাউন শুরু হবে একটু পরেই। অনেক ভাড়ার কড়ারে পথে বের হওয়া রিকশা আমার অপেক্ষায়। গেটে হর্ন বাজিয়ে আমায় ডাকছে।

কনখলের আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমের বন্ধ গেটের সামনে এই আটসকালে এক দল দণ্ডীস্বামী সন্ন্যাসী এবং সন্ন্যাসিনীরা গেট খোলার অপেক্ষায়। করোনা-কাল বলেই এই কনখলে শ্মশানের স্তব্ধতা। গেটেই মাথা ঠেকাই। করোনার চক্রান্ত না থাকলে অন্য সব আশ্রমের মতোই মা আনন্দময়ী মায়ের সংসার গমগম করত। আমিও সকালের নাস্তা পেতাম।

যেতে পারলাম না। অসম্পূর্ণ আমার এ বারের করোনাক্রান্ত হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভ ভ্রমণ। কলকাতার ‘সংবাদমন্থন’ পত্রিকার (সম্পাদক জিতেন নন্দী) ভ্রাতৃপ্রতিম লেখক-সাংবাদিক সমস্ত ঠিকানা দিয়েছিলেন। তবুও যেতে পারলাম না কনখলে শিবানন্দ সরস্বতীজির মাতৃসদন আশ্রম। এরা গঙ্গা-মাফিয়ার বিরুদ্ধে নীরবে আন্দোলন করে চলেছে প্রায় সিকি শতক ধরে। সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। নীরব প্রতিবাদ। অনশন করে চলেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে পাঠ নিয়েছেন শিবানন্দজি। স্কুলে পড়াতেন। কেশরাম কটন মিলে একদা জীবিকা। পরে সন্ন্যাসীজীবন এবং গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনে নিবেদিত অন্যান্য আশ্রমিককে নিয়ে। লড়ছেন শিবানন্দ সরস্বতীজি।

উদাসীন আশ্রমের বন্ধ গেটে

চলেছি হরিদ্বারের লালতারা পুল পেরিয়ে জুগতরাম মিশন মার্গে উদাসীন আশ্রমে, গঙ্গাদাস উদাসীনের কাছে। এঁরা সস্ত্রীক আশ্রম করেছেন এবং আশ্রমেই থাকেন। গুরু গ্রন্থসাহেব পাঠ করেন শিষ্যদের নিয়ে। বন্ধ গেট থেকেই দু’ জনে কুশল বিনিময়। জানালেন, “বাহার সে কোই অন্দর না আ সকে।” ফেরত-পথে পরের পংক্তি মনে মনে, “অন্দর সে কোই বাহার না জা সকে।”

“কে এই গঙ্গাদাস উদাসীনজি?” আমার প্রশ্ন।

উত্তর দিল ধর্মাশোক – “গুরু জুগতরাম এবং শিষ্য গঙ্গাদাসের দেশ ছিল অবিভক্ত ভারতের সিন্ধু প্রদেশের সকুর জেলায়। ১৯৪৭-এ বাস্তুচ্যুত হয়ে ইন্ডিয়ায়। অবশ্য গঙ্গাদাসের জন্ম পাকুড়ে (ঝাড়খণ্ড) এবং কর্ম কলকাতায়। পুত্র মহেশলাল এখন সাঁই মহেশলাল। ছত্তীসগঢ়ে রায়পুরের লাখিনগরে ১৯৯৮ সালে গড়েছেন স্বামী জুগতরাম মিশন। সস্ত্রীক সেখানেই অবস্থান করছেন। উদাসীন সম্প্রদায় গুরু নানক-আশ্রিত এবং গুরু গ্রন্থসাহেব-পঠিত।”

কিন্তু এ সব তো সাধারণ ব্যক্তিক তথ্য। আসলে ঠিক কী বলতে চাও তুমি, ধর্মাশোক?

বলতে চাই, সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো মহান্ত বা মহামণ্ডলেশ্বর মূল সংগঠনে থেকেই নিজের (ব্যক্তিগত) এক বা একাধিক আশ্রম গড়তে পারেন। মূল আখাড়ার অনুমতি নিয়েই। অনেক আখাড়া সম্মতি দেয়, অনেকে দেয় না। আখাড়ার অনুমতি সাপেক্ষে এবং শর্তা সাপেক্ষে একজন মহান্ত বা মণ্ডলেশ্বর দীক্ষা দেন, নিজস্ব সম্পদও বানান। কুম্ভমেলায় এলে এই বৈভব চোখে পড়ে। এ ব্যাপারে গুজরাতি সন্ন্যাসীরা সবার থেকে এগিয়ে। তবে দিন বদলাচ্ছে। অতি উচ্চশিক্ষিতা মহিলা মাতাজি এবং উচ্চশিক্ষিত বাবাজিরা অনেকটা এগিয়ে। এঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, এঁরা কর্পোরেট সন্ন্যাসী বা কর্পোরেট স্যাফ্রন।

ওরে বাপস! আমার চোখ পানিপুরি হয়ে ওঠে।

ধর্মাশোক যোগ করল, সাঁই মহেশলালের এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন? স্কুলিং হরিদ্বার ডিপিএস। আইএমএস দেহরাদুন। এমবিএ গুরুকুল কাংড়ি। একাধিক ভারতীয় ভাষা জানেন। এই নয়া পিঁড়ির (প্রজন্ম) তরুণ-তরুণীরা নিজের সংগঠনকে ধনে-মানে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ফান্ড রেজ করবেন। আশ্রমের নানা শাখা গড়বেন। ক্ষতি কী? একটা শিক্ষালয় গড়লে সার্বিক উন্নতি। এমপ্লয়মেন্ট হবে কত কত!

জুলুসে বৈভবের প্রদর্শনী

পূর্ণকুম্ভ স্নানযাত্রার ঠিক আগে চলে বর্ণময় পদযাত্রা, যা জুলুস (জৌলুস) নামেই পরিচিত এবং ধর্মীয় গুরুদের তা স্টেটাস। অথবা এ ভাবেও বলা চলে, বিত্তের প্রদর্শন। বহু ব্যয়ে, বহু বাজি ফাটিয়ে আখাড়ার পুণ্যস্নানের ঘোষণা, অমৃতময় বাতাসকে ধোঁয়া ও গরলে ভরে দেয়। ভিন্ন আখাড়ার সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা। অবশ্য হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে দু’টি বৈভবাক্রান্ত আখাড়াকেই একাধিক তোপধ্বনি, অসংখ্য বাজি ফাটাতে দেখেছি। মনে হয় কোনো বিয়ে উপলক্ষ্যে হবু গর্বী বর চলেছে নিরীহ কনের বাড়ির দিকে। এই বছরে বাজির উৎপাত ছিল না। ছিল না অসংখ্য জুলুসের বর্ণময় সুসজ্জিত ট্রাক্টরের সংখ্যাধিক্য। কিন্তু ছিল, কম হলেও। তিনমুখো ডিজে বক্স শব্দদূষণ ছড়ায়নি বোধ করি। কারণ উহা ঈশ্বরের শব্দময় সচল পদযাত্রা।

জ্বালাপুরে মুসলিমদের আছে একাধিক ব্যান্ড, বিখ্যাত। নানা রকম জুলুসে তাঁরা বাজনা বাজান। দলের প্রধান কণ্ঠশ্রী একটি গান দু’ রকম স্বরে গেয়ে গণপথ, স্নানযাত্রার পথকে বিশেষ মাত্রা দেন। বেশ লাগে। তবে তখন আমার মনে পড়ে যায়, বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম সোনাপলাশির নবদ্বীপ হালদারের কথা। সে যুগের বিখ্যাত কমেডিয়ান, একাধিক স্বরে গেয়েছিলেন ‘খাওয়াদাওয়া’।

“তবে তো দেখতেই পাচ্ছ বন্ধু, পৃথিবীতে যা কিছু সবই পুরাতন, প্রাচীন। শুধু ফিরে ফিরে দেখা হয় নয়নের মণিতে, কনীনিকায় ফেরে জন্ম-মৃত্যু, ঈশ্বর-পৃথিবী ও ভালোবাসা”, উদাস চয়ন, উদাস বচন ধর্মাশোকের।

কুম্ভমেলার উৎস সন্ধানে

আমি শান্ত স্বরে কই, “আচ্ছা একটা কথা বুঝিয়ে কও তো ধর্মাশোক। কুম্ভমেলা কত দিনের পুরোনো? আখাড়া-মঠপ্রধানদের অনেকেই বলে থাকেন, হাজার-লক্ষ বছরের। এমনকি বৈদিক যুগের সময় থেকেই চলে আসছে। সত্যিই কি তা-ই?”

ধর্মাশোক: এটা কেমন করে সম্ভব? সমুদ্রমন্থনের কাহিনি সুখপাঠ্য, বিস্ময়কর, মধুচিত্রিত এক ফ্যান্টাসি। শাস্ত্রে দেব-দানবদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অমৃত, সমুদ্রমন্থন, হলাহল, নীলকণ্ঠ শিবের উপস্থিতি কল্পমায়ায় আবেশিত। বেদ-উপনিষদ বা মহাকাব্যের যুগে এমন কাহিনি অনুপস্থিত। পৌরাণিক যুগে সমুদ্রমন্থন নেই। সমুদ্রমন্থনের যে কাহিনি-কাঠামো তাতে করে অনুমান, কালিদাস, ভবভূতির সাহিত্যের স্বর্ণযুগের পরে এর উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে। আবার বলি, আমি পাথুরে প্রমাণ, শিলালিপিতে পাইনি। সমুদ্রমন্থনে উঠে আসা অমৃতের হাঁড়ি নিয়ে অসুরদের বঞ্চনা করে পালানোর একাধিক মিথ রচিত। সেটিই বা হয় কেমন করে? সত্য এক, সত্য অবিচল।

সমুদ্রমন্থনের যে গল্প, তাকে কেন্দ্র করে পুণ্যকুম্ভের স্নানমেলা, এমনকি অর্ধকুম্ভের স্নানমেলার শাস্ত্রীয় সত্য কোথাও পাইনি। তা ছাড়া, অসুরদের যৌন লালসায় ভোলানোর জন্য বিষ্ণুর নারী-শরীর ধারণ, লাস্যনৃত্য – এই সবে আমার জ্ঞান–রুচির অনুমোদন নেই। আর মানুষের ভাবাবেগ, যুক্তিহীন বিশ্বাস আমি থামাবার কে? তাঁরা থামবেনই বা কেন?

যদিও ঐতিহাসিক সত্যতা আছে ‘মেলা’র ভিন্ন একটি রূপে। স্থান ইলাহাবাদ সংগমতট। এবং তা কুম্ভমেলা বলে পরিচিত নয়। এই মেলার সঙ্গে হর্ষবর্ধনের নাম জড়িয়ে আছে। তিনি পাঁচ বছর অন্তর রাজকোষাগারে সঞ্চিত অর্থ দান করতেন টানা চার দিন। প্রাপকেরা হলেন ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী, বৌদ্ধ ভিক্ষুক এবং গরিব প্রজা। প্রয়াগের সংগমস্থলে মেলা বসত। চার দিন ধরে একটানা দান-অনুষ্ঠান চলত। ‘মহামোক্ষ পরিষদ’ নাম ছিল ওই মেলার। কুম্ভ, সমুদ্রমন্থনের মিথ এখানে অনুপস্থিত। এই সমস্ত মেলা-বিবরণ চৈনিক পরিব্রাজক হিউসেন সাঙ (৬০২-৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে।

সম্রাট হর্ষবর্ধনের জীবনকাল (৫৯০–৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ)। এখন এই তারিখের সঙ্গে বেদ-উপনিষদ-মহাকাব্যের সময়কাল এবং আদি শংকরাচার্যের জীবনকাল মেলালে আজকের কুম্ভমেলার পুরোনো ইতিহাস যা মৌখিক, তা স্থাপিত হয় না। ধর্মাশোকের দীর্ঘ বিবরণে আমার মাথা হিন্দুস্তান-পাকিস্তান। হাওড়া-শেয়ালদা। নাইব, না গা ধোব। তাজ্জিম মাজ্জিম করছে।

আমি বেবাক বোবা হয়ে পাঁচ মিনিট পরে বোতলের জল পান করি। গলা শুকিয়ে কাঠ। দম নিই। প্রশ্ন করি ধর্মাশোককে, তার চোখে চোখ রেখে – “তা হলে এত শ্রম, এত সংঘর্ষ, মঠ-মিশন, মসজিদ-মক্তব চার্চ – এগুলো কেন? ঈশ্বর তো এক কল্পিত বাসনার উড্ডীন ধ্বজা। এক ঈশ্বর অন্য ঈশ্বরের আবাসস্থলে অগ্নিসংযোগ করে এবং সেই ভস্ম উড়িয়ে উল্লাস করে। জীবনের কী পরিহাস! বুঝতে পারিনি বুঝেও। আজও কাঁদে কাননে।”

ধর্মাশোক: চলো হে। এত কর্কশ কোলাহলে ঈশ্বর নেই। এত বৈভবে ঈশ্বর থাকতে পারেন না। চলো গঙ্গার পুব পারে। ওখানে নাগরিক হরিদ্বার অনেকটাই অনুপস্থিত। গাছের তলে ভবঘুরে ঈশ্বর-ঈশ্বরীরা বসে – কেউ জটার জট ছাড়াচ্ছে, কেউ বড়ো চিমটে বাজাচ্ছে। বরং চলো ও দিকটায় হাঁটা যাক। ধর্মাশোকের পিছু নিই আমি।

আবার এক যুগ পরে

পার হই লালতারা পুল। একই গঙ্গার ঘাটে ঘাটে কত কত বিচিত্র জীবনের সচল ছবি। ওই তো কত কত চেনা মুখ। সামান্য একটু দূরে দেখো – এক মা পা মেলে সুখাসনে। সামনে তার মাধুকরীর পাত্র। কোলের শিশুটিকে বক্ষসুধা, অমৃতের অধিক, পান করাচ্ছে। আমাদের অবিবেচনার পাপ, ‘সভ্যতা’র গরল আবর্জনা, মা গঙ্গা বহন করে চলেছে। তিনিও ক্লান্ত। অবসন্ন। পশ্চিম পাড়ে ব্রহ্মকুণ্ড ঘিরে পুণ্যের জলকেলি – বাসি চৈত্রসংক্রান্তির স্নান, যা শাহিস্নানের একটি, গতকাল ছিল। আজও তার জের চলছে উন্মাদ পঞ্জিকালিপিতে। মাস পয়লা, বছর পয়লা, বাঙালির বিশেষ দিনের স্নান। যাহ! জীবন থেকে একটা বাংলা বছর চলে গেল, চলে গেল ১৪২৭। এল ১৪২৮। আমরাও তবে এগিয়ে চলেছি মৃত্যুর দিকে, আবার ধেয়ে আসতে পারে মৃত্যুর তৃতীয় ঢেউ, করোনার তৃতীয় ঢেউ।

কারা এই করোনা জীবাণু ছড়াল বিশ্ববাতাসে? চিন চিন করে ওঠে বুকের বাম অলিন্দ। ক্রোধে রক্ত ওঠে মাথায়। কত কত বন্ধু, ‘অচেনা’ বান্ধব, সুজন স্বজন মিলিয়ে গেল ব্যোমে। কিছুই হারায় না। এক্ষণে তারা ঘুরছে মহাকাশে, সপ্তাকাশে। যাচ্ছি বন্ধু। আবার দেখা হবে। নিয়ে আসব তোমাদের সকলকে। এই মৃত্যু-উপত্যকায় আবার আমরা রচিব নব পত্রবিন্যাস। আমি শ্রমিক। তোমাদের সকলের বোঝা, ক্লেদ-গ্লানি-ঘাম-কান্না এবং হাস্যকৌতুকের ভার আমি বয়ে নিয়ে চলব সংগমে, কাবেরী ও শিপ্রার জলে করব তর্পণ। আমি হব ভগীরথ। বাজাব দক্ষিণাবর্ত। তোমাদের বিলিয়ে দেব অমৃতভাণ্ড।

গঙ্গার জলে অঞ্জলি ডোবাই। তাকিয়ে দেখি, সচল মালুপাতার বাটি, ভেসে চলেছে। ভেসে চলেছে জ্বলন্ত কর্পূর-দীপশিখা। কে ভাসিয়েছে কার উদ্দেশে? হয়তো আমারই উদ্দেশে তোমার প্রেমজল। কোভিডে প্রয়াত সুজন স্বজন চিকিৎসক সেবিকা গৃহী ভোগী যোগী – সচল মা গঙ্গার স্রোতের উদ্দেশে সকলের জন্যই বলি:

ওগো মা গঙ্গা মাগো মা গঙ্গা/ দিনু ভাসায়ে মোর স্বজনে/তুমি দেখো তারে।…

বিদায় হরিদ্বার। বিদায় ব্রহ্মকুণ্ড। বিদায় হর কি পৌড়ী। বারো বছর পরে। আবার এক যুগ পরে। কে রয়! কে ভেসে যায় ব্যোমে! সাষ্টাঙ্গ প্রণমি। নমামি, উর্বর এই দেশমৃত্তিকার অপূর্ব মিথাশ্রিত সমুদ্রমন্থন।(শেষ)    

আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন                               

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *