শ্রয়ণ সেন
বর্ষায় পাহাড়কে অন্য রকম ভাবে চেনার জন্য এই সফর করছি আমরা। বেছে নিয়েছি এমন কিছু জায়গা যা বাধা গতের টুরিস্ট সার্কেলের বাইরে। এমনই দু’টো জায়গায় থাকার পালা শেষ হয়ে গেল। এ বার রওনা নতুন একটা জায়গার উদ্দেশে।
আজ পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ। যাব কালিম্পং পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটি গ্রাম মুনথুমে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন বিশাল গুরুং। আজ রাতটা তাঁর আতিথেয়তাতেই থাকব।
সকাল ৯টার আগেই বিজনবাড়ি থেকে রওনা হয়ে গেলাম। দার্জিলিং পাহাড়ের সম্পূর্ণ অন্য একটা দিক দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। ছোটা রঙ্গিতের বিজনবাড়িকে বিদায় জানিয়ে পুলবাজারের রাস্তা ধরলাম।
বিজনবাড়ি থেকে দার্জিলিং খুবই কাছে। শর্টকাট রাস্তাটায় দূরত্ব মাত্র ১৭ কিলোমিটার। এই অল্প দূরত্বেই রাস্তাটা প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট উঠবে। রাস্তার অবস্থাও বিশেষ ভালো না।
আর একটি রাস্তা আছে পুলবাজার হয়ে। সেটা দিয়ে দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। সেই রাস্তায় সুন্দর একটা টুরিস্ট স্পট যেমন আছে, তেমনই রাস্তার অবস্থাটাও ভালো।
ঘণ্টাখানেক চলার পর সুন্দর একটা জায়গায় এসে গাড়ি থাকল। জামুনি ব্রিজ। ছোটা রঙ্গিতের তীরে ভারী সুন্দর এই জামুনি। ছোট্ট একটা গ্রাম। উচ্চতায় বিজনবাড়ির থেকেও নীচে সে।

এই ছোট্ট মিষ্টি পাহাড়িয়া গ্রামটার মাঝখান দিয়ে নিজের মনে বয়ে চলেছে ছোটা রঙ্গিত নদী। এর ওপর আছে একটা লোহার ব্রিজ। এই সেতুটা এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। এখানে আছে একটা সুন্দর পার্ক ও একটা ছোট্ট লেক। লেকে বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে। রয়েছে মহাদেব শিবের বিশাল একটা মূর্তি।
এটা দার্জিলিং শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। তবে এর পরিচিতি এখনও সে ভাবে হয়নি। ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি এই সেতু উদ্বোধন করেছিলেন দার্জিলিং পাহাড়ের তৎকালীন সর্বেসর্বা সুবাস ঘিসিং। সে কারণে এই ব্রিজটার নাম ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার ব্রিজ।’ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার শিলান্যাসও তিনিই করেছিলেন।
বর্তমানে এখানে একটি পর্যটক আবাস তৈরি হয়েছে। রয়েছে কয়েকটি কটেজও। তবে এখন করোনাকাল বলে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এই আবাস এবং কটেজগুলি।
ব্রিজ পেরিয়ে এ বার ক্রমশ ওঠা শুরু। জামুনি ব্রিজের উচ্চতা হাজার দুয়েক ফুট হয়তো হবে। পরবর্তী ১৫ কিলোমিটারে আমাদের উঠতে হবে প্রায় পাঁচ হাজার ফুট। রাস্তা অসম্ভব খাড়াই। কিন্তু পথের সৌন্দর্য অপরিসীম।
সম্পূর্ণ অন্য দিক দিয়ে দার্জিলিং প্রবেশ করলাম। পাহাড়ে যখন বিমল গুরুংয়ের চূড়ান্ত রাজত্ব ছিল, তখন যে জায়গাটার নাম সব থেকে বেশি শোনা যেত সেই পাতলেবাস জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি। এর পর সিংটাম চা বাগান, সিংমারি হয়ে পেছন দিক দিয়ে দার্জিলিং ঢুকলাম।
এক সম্পূর্ণ অচেনা দার্জিলিংয়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলাম। হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট আর চিড়িয়াখানার প্রবেশপথকে বাঁ দিকে রেখে এগিয়ে গেলাম চকবাজারের দিকে। রাস্তা অসম্ভব ফাঁকা। সকাল সাড়ে দশটায় মনে হচ্ছে বন্ধ চলছে। যে চকবাজারে ভিড়ের ঠেলায় কার্যত টেকা দায়, সেখানে সব দোকানপাট বন্ধ। রাস্তায় মানুষ হাতে গোনা।

তা হলে কিছু দিন আগে সংবাদমাধ্যমের একাংশ যে দাবি করছিল দার্জিলিংয়ের পর্যটকদের ভিড়ে টেকা দায়, তার প্রমাণ কই? হিমাচলের ভিড় দেখে দার্জিলিংকেও এক সরণিতে এনে ফেলেছিল ওই সংবাদমাধ্যমের একাংশ। নিজের চোখে দেখলাম পর্যটকশূন্য দার্জিলিংকে।
তবে যেটা খুব ভালো লাগল তা হল মানুষের মধ্যে কোভিড সচেতনতা। গত জানুয়ারিতেও দার্জিলিং এসেছিলাম। প্রথম ঢেউ তখন শেষ হওয়ার পথে। সংক্রমণ ক্রমশ কমছে। তখন কিন্তু মাস্ক নিয়ে মানুষকে এত সচেতন হতে দেখা যায়নি। তখন দশ জনের মধ্যে ৩-৪ জনকে মাস্ক পরতে দেখতাম। আর আজ এখন যাদের দেখছি সবার মুখে মাস্ক। একদম নাক পর্যন্ত টানা।
হিলকার্ট রোড ধরে দার্জিলিং থেকে ঘুম আসতে সময় লাগল মাত্র ৪-৫ মিনিট। পর্যটক ভরা মরশুমে এই রাস্তায় ৪-৫ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। তখন গাড়ির চাপ সামলাতে ওপরের জলাপাহাড়ের রাস্তাটাও খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু আজ সে সব কিছুই করতে হল না।
ঘুম থেকে ঘুরলাম বাঁ দিকে। পেশক রোড। দার্জিলিং পাহাড়ের অন্যতম প্রাচীন রাস্তা। দার্জিলিং-কালিম্পং সংযোগকারী। এই রাস্তাটায় চা-বাগান নেই। তবে পাইন-ধুপি-দেবদারু গাছগুলো এক অপরূপ মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। কেমন যেন ছায়া ছায়া লাগে। বাঁ দিকটা পুরোটা ফাঁকা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখানেই খিলখিল করে হাসে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
ইচ্ছে ছিল লামাহাট্টার ইকো পার্কটা দেখব, কিন্তু করোনার কারণে সেটা এখন বন্ধ। পর্যটনশূন্য লামাহাট্টার হোটেলগুলো এখন কার্যত মাছি তাড়াচ্ছে।
লামাহাট্টা পেরিয়ে যেতেই উতরাই। রাস্তা এ বার ক্রমশ নামছে। লামাহাট্টার উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ৬ হাজার ফুট। আর এই রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে, সেই তিস্তাবাজার হাজার খানেক ফুট। দূরত্ব মাত্র ১৩ কিলোমিটার।
লপচু এসে পৌঁছোতেই তীব্র গরমের কবলে পড়লাম। আধ ঘণ্টা আগেও লামাহাট্টায় ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল। লপচুতে সে সব উধাও। এখন আমরা সমুদ্রতলের প্রায় কাছাকাছি। আরও নামলাম। এসে পৌঁছোলাম লাভার্স মিট ভিউ পয়েন্টে।
দুর্দান্ত একটি ভিউ পয়েন্ট। গাছগাছালি ঘেরা রাস্তার সামনেই কয়েক ধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই অনেকটাই নীচে সেই সুন্দর দৃশ্য।

সোজাসুজি দূর থেকে বয়ে আসছে তিস্তা। আর বাঁ দিক থেকে আসছে রঙ্গিত। রঙ্গিত নিজেকে সমর্পণ করছে তিস্তার বুকে। এটা কিন্তু রঙ্গিত। বিজনবাড়িতে দেখা ছোটা রঙ্গিত এ নয়। সেই ছোটা রঙ্গিত জোরথাংয়ের কাছে রঙ্গিতে মিশছে।
লাভার্স মিটে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফের পথ চলা শুরু। আমাদের গন্তব্য তিস্তার অপর প্রান্ত, অর্থাৎ কালিম্পং পাহাড়ে। তিস্তাবাজারে জলে টইটম্বুর তিস্তাকে পেরিয়ে ফের পাহাড়ে ওঠা শুরু।
আবার একটার পর একটা হেয়ারপিন বেন্ড অতিক্রম করে উঠে আসা কালিম্পং শহরে। একই দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পাহাড়ের দুই বড়ো শহর দার্জিলিং আর কালিম্পংকে দেখার সুযোগ কিন্তু খুব বেশি কারও হয় না।
আজ রাস্তায় এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। বরং লামাহাট্টা থেকে যত নেমেছি রীতিমতো ছড়ি ঘুরিয়েছে রোদ। এমনকি এই ৪ হাজার ফুট উচ্চতার কালিম্পংয়ে এসেও বেশ গরমই লাগছে।
বিশাল গুরুংয়ের কথামতো কালিম্পং থেকে আমরা রেলিখোলার রাস্তা ধরলাম। উতরাইয়ে রাস্তা তবে অবস্থা ভালোই। বিশালজির স্ত্রী নিতা এ বার ফোন করলেন। আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানার পর ভালো করে রাস্তা বুঝিয়ে দিলেন। তাঁর নির্দেশমতো এগোতে থাকলাম।
চলে এলাম রেলিখোলা। বর্ষা ছাড়া অন্য কোনো সময়ে এখানে বিশেষ জল থাকে না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। খরস্রোতা রেলিখোলা পেরিয়ে আরও কিছুটা এগোলাম। এ বার এল আরও এক নদী, পালাখোলা। প্রবল গর্জনে নেমে আসছে সেও।
“মুনথুমে যাবেন তো।”
পালাখোলা পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই, ছোট্ট একটা রাস্তার মোড়ে আমাদের গাড়িদুটিকে দাঁড় করালেন এক যুবক। বুঝতে অসুবিধা হল না আমাদের আজ রাতের আস্তানাতেই কর্মরত তিনি।
ভালো কিছু উপভোগ করতে হলে একটু সমস্যা দেখা দেয়, একটু কষ্ট করতে হয়। সেটা আমাদের ক্ষেত্রেও হল।
বিশালজি আগে থেকেই বলে দিয়েছিলেন তাঁর ‘ভিলেজ হোমস্টে’-তে ঢোকার আগে শেষ চারশো মিটার রাস্তাটা অত্যন্ত খারাপ। বোল্ডারের রাস্তা। বোলেরো কোনো ভাবে সেই রাস্তা অতিক্রম করতে পারলেও ছোটো গাড়ির পক্ষে এখানে আসা সম্ভব নয়।
সে কারণে আমাদের ছোটো গাড়িটাকে মূল রাস্তার মোড়ের মাথায় রেখেই বোলেরোয় এগিয়ে চললাম ভিলেজ হোমস্টের দিকে। (চলবে)