করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/৮: সুদৃশ্য বর্ণময় জুলুস ধর্মীয় নেতাদের, দূরত্ববিধি শিকেয়

অশোককুমার কুণ্ডু

কুম্ভমেলার অমৃত, স্নানমেলার পুণ্যডুবকি ঘেঁটে ‘ঘ’। ধনে-মানে নাগা (নাঙ্গা) সন্ন্যাসীরা (ফৌজ) সংখ্যায় (প্রাচীনতায় নয়, প্রাচীনতম হল শ্রীপঞ্চদশনাম আবাহন আখাড়া, প্রতিষ্ঠাবর্ষ ৫৪৭ খ্রিস্টাব্দ) গরিষ্ঠ। তারা হু-হুংকার ছাড়ছে করোনা-কুম্ভমেলা নিয়ে। দাবি বৈরাগীদের, মেলা চলবে মেলার স্থায়িত্ব রামনবমী অর্থাৎ ২১ এপ্রিল পর্যন্ত। শ্রীরামজি, রামমন্দির এখন কট্টর হিন্দু ভারতীয়দের নাভিকুণ্ড। সুতরাং রামনবমীর আগেই কুম্ভমেলা, কুম্ভস্নান রোধে কার সাধ্য! তাই মেলা যেমন চলত তেমনি চলছে, চলবে। অমৃত, সমুদ্রমন্থন অমর রহে। যুগ যুগ জিও।

প্রায় হাজার কোটি রুপির মেলা-মচ্ছব-মালসাভোগ। এ দেশ ঋষিপ্রধান। এ দেশ কৃষিপ্রধান। কৃষকেরা বসে আছেন রাস্তায় ২০০ দিন হল (এই কপি যখন লিখছি তখন আন্দোলনকারী কৃষকদের দু’শো দিন পার হল)। ধর্মগুরুদের ফুৎকারে উড়ে যেতে পারে রাজ-মসনদের পায়া। সামনেই ভারতের সব চেয়ে বড়ো রাজ্য ইউপিতে নির্বাচন, যে রাজ্যটি আবার ভারতের অন্যতম প্রাচীন শৈব্যপন্থী কর্তৃক পরিচালিত। এবং তার পরেই, পর পর একাধিক রাজ্যে ‘পবিত্র’ গণতন্ত্রের ফাইনাল গেম। উত্তপ্ত লাভার ওপরে বসে আছেন দেশের শাসকেরা, যাঁরা আবার কট্টর হিন্দু-আশ্রিত। কড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে, করোনাবিধিকে মান্যতা দিয়ে, তাঁরা কুম্ভমেলা সংক্ষিপ্ততম করতে পারেন? আলবাত না। প্রায়াসম্ভব। একশো তিরিশ কোটির মধ্যে ওই সামান্য সংখ্যা মরে-হেজে গেলে কার কী? তারা প্রাণহীন হয়ে গঙ্গায় ভাসল তো বয়েই গেল। তীরে কোলাহল তীব্র হবে না। বরং শাল-শোল-বোয়াল-মাগুর-সিং মাছেদের মহোৎসব হবে। জয় গুরু।

স্নানমেলা নিয়ে সংশয়-সংকোচ-শঙ্কা  

আমার ধারণা তৈরি হয়েছিল হরিদ্বারে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে বসেই, কুম্ভস্নান পুরোটাই হবে। যেমন হয়ে থাকে, হয়েছে আগের বছর, তার আগের আগে, অমৃতকুম্ভে। নানা রকমের সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারের, কেন্দ্রীয় সরকারের, স্থানীয় প্রশাসনের এবং আমজনতার। ফলে সংশয়-সংকোচ-শঙ্কায় মাখো মাখো স্নানমেলার সিদ্ধান্ত। মহাশিবরাত্রি (১১ মার্চ) থেকে রামনবমী, তা থেকে চৈত্রপূর্ণিমা – ক’ দিন হয় কাকা? দেড় মাসের অধিক। এই বলছ সংকুচিত কুম্ভমেলা এক মাসের। কখনও বলছ প্রতীকী ডুবকি। আবার বলছ ভার্চুয়াল স্নান। পাগল না পেটখারাপ?

এক বার দেখে নেওয়া যাক কুম্ভমেলার ক্যালেন্ডার, যা উত্তরাখণ্ড সরকার প্রচারিত এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্ট্যাম্প মারা। সঙ্গে আছে গুগুল জ্যাঠা। হবে জয়।

১৪.০১ থেকে হরিদ্বারে কুম্ভস্নানযোগ অর্থাৎ পুণ্যস্নানের যোগ লাগছে। ১৪.০১ থেকে ১৩.০৩ পর্যন্ত চারটি পুণ্যস্নানের দিন। এই স্নানগুলিকে বিশেষ অভিধায় বলা হয়েছে ‘প্রমুখ স্নান’। অর্থ হল, আরম্ভ বা সূত্রপাত। সূত্রপাত কীসের? পুণ্যস্নানের নিশ্চয়ই। হরিদ্বারের পূর্ণকুম্ভের সময়ে যখন এই তথ্য প্রকাশ করছে সরকার, তখন তা অবশ্যই কুম্ভস্নান সম্পর্কিত। তাই তো?

সকল সন্ন্যাসীই গেরুয়াধারী। কিন্তু সব গেরুয়াধারীই সাধু নন। সজ্জন নাও হতে পারেন, সে তো জানি। তেমনি সব নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি দেশসেবক নন। ঠিক তেমনি সব স্নানই পুণ্যের। কিন্তু সব স্নানই কুম্ভস্নান নয়। একটা উদাহরণ: ১৪.০১ মকর সংক্রান্তি, সমগ্র ভারতবর্ষে পুণ্যস্নান। এবং এটি বিশেষ, রয়্যাল বা শাহিস্নান। কিন্তু এটি ইলাহাবাদ কুম্ভমেলার সঙ্গেই যুক্ত। এটি কোনো ভাবেই হরিদ্বার কুম্ভমেলার স্নানের সঙ্গে যুক্ত নয়। তা হলে হরিদ্বার কুম্ভমেলার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে কেন? ট্যুরিজিম প্রোমোশন? আমদানি-রফতানির হিস্যা? এর চেয়ে বলো না কেন জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত গামছা পরে ব্রহ্মকুণ্ডের গলা জলে বসে থাকো। এমনিতে সমগ্র সভ্যতাটা তো ‘বেনের পুঁটুলি’তে, লাভ-ক্ষতির জাবেদা খাতায় কুম্ভসংস্কৃতি ভরে ফেলেছ কাকা। থাক না ওইটুকু ভূখণ্ড। ওই সাড়ে তিন হাত মিট্টি।

সেই প্রতি দিনের পথ হাঁটার ছবি

হরিদ্বার ২০২১-এর করোনাক্রান্ত কুম্ভ থেকে ঘরে (কলকাতায়) ফিরে লিখছি, রিপোর্ট বা প্রতিবেদন নয়। সে তো হরিদ্বারে বসে মেলার নিত্যদিনের প্রতিবেদন, যা গরমাগরম লিখেছি। পাঠিয়েছি। ছাপাও হয়েছে সেই সময়ে। ছেপেছে ‘এই সময়’ সংবাদপত্র। তা তো চুকেবুকে গেছে। এখন লিখছি গরলামৃত, গ্রন্থের জন্য। দীর্ঘ লেখা, ইন ডিটেল। জায়গার অভাব বা শব্দসংখ্যার সংকোচন নয়। ভাবছি আর দেখছি চোখের পিছনে, সামনে, সেই প্রতি দিনের পথ হাঁটার ছবি। নিজের সঙ্গে কথা বলার পিকচার গ্যালারি – হাওড়ার পুল দেখো, কালীঘাট দেখো, উত্তমকুমারের পকেটে সুচিত্রা সেন দেখো, দক্ষিণেশ্বর দেখো, মহারানি ভিক্টোরিয়া দেখো, আর দেখো পরেশনাথ মন্দির…। গ্রামিক মেলায় দেখা রহস্যময় বাক্সের ভিতরের সচল ফোটো। গোলাকার কাটা অংশে চোখ ডুবিয়ে, শৈশবের অমৃত।

বারে বারে এই বর্ণনা লিখতে বসে ভাবছি, মানবসভ্যতার সংকটে ধর্ম বুঝি পিছিয়ে নিয়ে যাবে ভারতকে। শৃঙ্খলিত করবে, কারাগারে বন্দি করবে ইন্ডিয়াকে। তবে কি মানবমন নবাগতকে ভয় পায়? ভয় পায় বিজ্ঞানকে? পায় বই-কি। শাস্ত্রবাহক পুরোহিতরা কি পুড়িয়ে মারেনি বিজ্ঞানীকে, সমাজসংস্কারকদের! মন ভার হয়। তাই যদি সত্য হয়, তো কী হবে এই সব লেখালেখি করে? কী হবে শব্দের, বাক্যের সমিধ জ্বেলে? কী হবে আপন হাড়ে আগুন জ্বেলে?

অথচ একদা সমস্ত ধর্মই অতীতে এই সভ্যতাকে দিয়েছিল যথাসর্বস্ব। সংগীত, সাহিত্য, অঙ্কন, চিত্র-স্থাপত্য…। এখন সকল ধর্মের ইজারাদাররা মানবসভ্যতাকে দিচ্ছে শুধুই গরল। গরলই অগতির গতি। বন্ধ্যার পতি। আহাম্মকের চালকুমড়ো।

হরিদ্বারের পথঘাট স্বাভাবিক কারণেই (তীর্থযাত্রীর সংখ্যা কম) পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন। তবে করোনার কারণে কি আরও সতর্ক হওয়া উচিত নয়? সতর্ক হওয়া কি যেত না? যত্রতত্র মুখ দিয়ে রক্তবমন, গুটখার থুথু, পান পরাগের বমি। ফুটপাত অধিকৃত খাটাল, ভগবতী মায়ের সঙ্গে কচি বাচ্চা। মা ডাকল হাম্বা। ‘বেশ করছি। আমরা এখানে মলমূত্র ত্যাগ করি। খুব দোষের না? আর কুম্ভস্থলে যে তোমাদের আশ্রমের ক্যান্টিলিভার গঙ্গার কোলে বসে আছে, তার বেলা? হাম্বা। আমরা নিরীহ বলে তোমাদের গাত্রজ্বালা! হাম্বা হাম্বা হাম্বা’।

সচল বিষ্ঠা পড়ছে টাঙার ঘোড়া থেকে। কাটা ফলও বিক্রি হচ্ছে, সংখ্যায় কম হলেও। ওদের ঠ্যালাগাড়িতে যে মোটা কালো ধূপ জ্বলে তা আমার কাছে আনন্দ, সুগন্ধে ভরপুর। আপেল-বেদানার থেকে কম মিষ্টি নয়। এ বছরও যাযাবরী-বেদেনি সুন্দরীরা উপস্থিত, তবে সংখ্যায় কম। রঙিন পাথর-সহ একমুখী থেকে বহুমুখী রুদ্রাক্ষ। সুন্দরীদের শুধু আমি একলাই দেখি না, বুড়ো সন্ন্যাসী, ছোকরা ব্রহ্মচারীরাও দেখেন। জপমালা কেনার ছলে। যাযাবরীরা বড্ড গুটখার ছিবড়ে ফেলে, থুতু-সহ। শুধু হরিজনরাই, বিশেষত কুম্ভমেলার সময়, সড়ক পরিষ্কার রাখে ৭X২৪ ঘণ্টা। করোনার বয়ে গেছে বিদায় নিতে।

নেই মাস্ক, খুলে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে

ধর্মীয় নেতাদের স্নানযাত্রার জুলুস, বর্ণময় মিছিল অতীব সুদৃশ্য। কিন্তু কোভিড-কুম্ভে দূরত্ববিধি কোথায়? গৃহী-সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীদের মিছিল যেমন প্রতি বার হয়, পূর্বেও যেমন হয়েছে, এ বারেও হচ্ছে সংখ্যায় কম হলেও। সচল জুলুসে অনেকেরই মুখে নেই মাস্ক। খুলে যাচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে। গায়ে গায়ে ঠেকে যাচ্ছে লরির মধ্যে। চামর দোলাচ্ছে গুরুর মাথায়। এবং মাস্ক পরে আপনআপন সম্প্রদায়-ইষ্টদেবের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে মজা নেই। খুলে রাখো। আপাতত পকেটে রাখো মাস্ক।

‘… তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না,/করে শুধু মিছে কোলাহল…’।

বাল্মীকি চৌকের আগের চৌমাথায় শিবমূর্তি হলাহল পান করেছেন। শুভ্র পাথরের শিবমূর্তি নিজের মাথায় নিজেই জল ঢালছেন। বিষে, অমৃতকুম্ভের বিষে জর্জরিত শরীরে, তিনি নিজেই দু’ হাতে জলপূর্ণ কলস ঢেলে আসছেন, সেই সত্যযুগ থেকে। ভোলেভালে মহেশ্বর। মা দুগ্গার টাইম নেই। রান্নাঘরে ডালে ফোড়ন দিচ্ছেন। এই সব ভাবছি আর দেখছি শান্তিতে। ভিড় তো বিশেষ নেই, হরিদ্বারের করোনা- কুম্ভে, ২০২১-এ।

ভোলাগিরি আশ্রমে

চলেছি ভোলাগিরি আশ্রমের দিকে, হরিদ্বারে আমার প্রিয় স্থানে। আয়তনে বিপুল। আশ্রমপ্রধান দেবানন্দ সরস্বতীজি প্রয়াত। পরবর্তী প্রধান, তরুণ সন্ন্যাসী গহনানন্দজিও (বর্ধমান জেলার মানুষ) প্রয়াত। পরমানন্দজিও (দক্ষিণী মানুষ) প্রয়াত। এঁরা সকলেই আমার পরিচিত। প্রথম দু’ জনের প্রয়াণের কথা জানতাম। আশ্রমে গিয়ে ফুলের বাগানের দিকে তাকিয়ে আছি মুগ্ধতায়। সাইকেল মহারাজের কাছে জানলাম পরমানন্দজির প্রয়াণের কথা। ঝুপ করে গোটা ফুলের বাগানে আঁধার নেমে এল মধ্যদুপুরে।

সামলে নিলাম। ‘…তবু অনন্ত জাগে…’। সাইকেল মহারাজ, কোন মরুভূমির কে জানে, রসালো খেজুর দিয়ে বললেন, “প্যাকেটটা রাখুন। টং টং করে ঘোরেন। কিছু না জুটলে দু’টো মুখে ফেলবেন। পিত্তি পড়বে না। আপনার লিভারটা বাঁচবে।” কোষাধ্যক্ষ মহারাজ নির্মলানন্দ সরস্বতীজি ছড়া কাটলেন। দেবানন্দজির কাছে শোনা: ‘কুম্ভ হল টাকার খেলা/মহাকুম্ভ ভক্তের খেলা’ (ভক্তরা টাকা না দিলে কুম্ভের বৈভব চুপসে যাবে)। কত যে ছড়া বলতেন দেবানন্দজি! বর্তমান প্রেসিডেন্ট মহারাজ তেজসানন্দজি মিঠে হেসে বললেন, “বাব্বা, মিডিয়ার মানুষকে আশ্রয়-অন্ন, দু’টোই দিতে হয়। তা না হলে বিপদ। কবে আসছেন, অগ্রিম জানাবেন।” (চলবে)

আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *