করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/৫: ডুবকি লাগাও, বচন শোনো, করোনা ভাগ জায়েগা

অশোককুমার কুণ্ডু

সকাল ৭টা-সাড়ে ৭টায় সংগীতানন্দজির আখাড়ায় গিয়ে লাভ নেই। বসে থাকতে হবে বা মূল গেটের বাইরে পায়চারি করতে হবে। করোনার কারণে সমস্ত আখাড়া-আশ্রমের মূল গেট বন্ধ। প্রহরী প্রহরায় নেই। থাকবেও না কেউ। অথচ কোভিড অতিমারি না থাকলে, আজ এই পর্বে, পূর্ণকুম্ভ পর্বে, দেবনগরী হরদুয়ার, বাঙালির হরিদ্বার, পুরোনো সন্ন্যাসীদের বরফানি কুম্ভ, মহাপ্রস্থানের পথে সমতলের শেষ ধরম-ধ্বজা হরিদ্বার গমগম করত। সেই গমগমানিতে হরিদুয়ারের রাজাজি ন্যাশনাল পার্কের অরণ্য থেকে হিরণ ভয়ে বাইরে আসত না। এলেও, লেজ গুটিয়ে ‘বাপরে-মারে’ করে পালাত।

দূরত্ববিধি গঙ্গায় ভাসিয়ে ডুবকি

সংগীতানন্দজির আখাড়া-আশ্রম যেতে হলে ব্রহ্মকুণ্ড পার হতে হবে। ওখানে চার দিকটা দেখে নিলাম। সাপে কাটলে যেমন মানুষ, ধর্মবিশ্বাসীরা গুনিন ডাকে, রোগীর চোখ উলটে গেলেও মা মনসার মূর্তির পা-ছোঁয়ানো ‘বিষ কাটানো’ জল মুখে দিয়ে দেয়, তেমনি এই ভোরে কোভিডের দূরত্ববিধি গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে মানুষ ডুবকি মারছে। কোমরজলে, দুরন্ত স্রোতে শিকল ধরে কত্তা-গিন্নি পরস্পরকে ডোবাচ্ছে, ভাসাচ্ছে। এমনিতে তো সংসারে ডেলি চুলোচুলির ডিসি কারেন্ট। তথাপি পুণ্যস্নানে মা গঙ্গার স্রোতে এই যৌথ অবগাহন, সত্যই মধুর স্মৃতি। ‘ধরা’ বেঁচে থাক স্মৃতি ও সুধায়। কিন্তু দুগ্ধপোষ্য বাচ্চার তো পাপ-পুণ্য নেই। মা-বাবার পাপ-পুণ্য থাকে যদি থাকুক। কিন্তু ওই শিশুকে কোলে নিয়ে, ওই কৃত্রিম খরস্রোতে পুণ্যস্নান! যদি শিকল ফসকায়! ভয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। ভাবাবেগের এত জোরালো স্রোত মা গঙ্গার বরকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সাধ্য কার, রোধে তার গতি।

ব্রহ্মকুণ্ডের লাগোয়া দোকানে মশালা দোসা ও এক গ্লাস লস্যি মেরে ক্ষুধাগ্নি সামলে হাঁটা। দেখতে দেখতে, ধীরে ধীরে হাঁটা। হরিদ্বারের গঙ্গার দু’ দিকের পাড়ে বাঁধানো মেঝে জুড়ে দূরত্ববিধি রক্ষার্থে অসংখ্য গোলাকার, নিখুঁত বৃত্ত। একটিও মোছেনি। কে জানে কী দিয়ে এঁকেছে লক্ষ্মণের গণ্ডি।

জনতার বয়ে গেছে। স্নানের পরে ভিজে কাপড় থেকে জল গড়িয়ে গণ্ডি পার হয়ে, গঙ্গার পানি গঙ্গায় চলেছে। পুণ্যস্নান সেরে কাপড় বদলে মুখে মাস্ক পরে কোভিড থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এ বার দোকানে গরমাগরম ফোলা ফোলা, কথা-বলা পুরি, টোকা মারলেই গরম শ্বাস ফেলবে এবং তার সঙ্গে হালুয়া। পাতে সবুজ লঙ্কা-সেদ্ধ, মশলা মিশেল, থাকবে গোটা দু’-চার। শেষে রসগুল্লা, জলেবি আর লাড্ডু। তার পর কুকুর-চমকানো উদ্‌গার তুলে সপরিবার ঘরের পথে তথা ধরমশালায়। অথবা দামি দম্পতি এক্সট্রা কটওয়ালা গঙ্গা ফেসিং ডবল বেডরুমে। ওরা ভিজে জামাকাপড়ের পলিপ্যাক খুলে বুঝতে পারবে ভিজে শাড়িটা ফেলে এসেছে।

না, না। সে শাড়ি এখন নীলধারার পাড়ে শুকোনো হচ্ছে। নিয়ে পালিয়েছে ঘাটে ঘোরা, পথের, ঠিকানাহীন, মা-বাপে খেদানো কিশোর-কিশোরীরা হাত সাফাই করে। গোটা দু’-চার এমন অপারেশন দেখলাম। অন্যায় বিশেষ কিছু মনে হল না। কারণ যুগ যুগ ধরে আমরা ওদের মায়েদের দ্রৌপদী করেছি। ওদের খাবার নিয়ে ভাঁড়ার ভরেছি। জয় গুরু।

ফুলকো পুরি ডাকছিল। অনেক কষ্টে সামলালাম। আমার লিভারটার অনেকটা গেছে (মদ্যপান না করেও)। ডা. অভিজিৎ চৌধুরীর নির্দেশ, নুন-মশলা-তেল-ঝাল, দূর হটো। পালিয়ে এলাম দোকানের সামনে থেকে। আর নয়। মনে করালো ধর্মাশোক, এ বার দেরি হলে কিন্তু বিরক্ত হবেন সংগীতানন্দজি। চলো তবে ত্বরা করি।

অগ্নি আখাড়ার গেটে

বড়ো গেটে সংকোচ নিয়ে ঠকঠকাই। লাঠি কাম বর্শা হাতে সুবেশ দ্বাররক্ষী গেটের ছোট্ট চৌকো জানলা খুলে, ‘কোন হ্যায়?’ একটু আগে বন্ধুবর ধর্মাশোক মিথ্যা ‘সদাচার’ শিখিয়ে দিয়ে আপাতত ভ্যানিশ। কী মিথ্যে! কী পাঠ দিল ধর্মাশোক!

আমি সকাল আটটা নাগাদ এসেছিনু। গেটে কলিংবেল বাজানু। শুনতে পায়নি হয়তো কেউ। কেন না সকালের পূজাপাঠের আরতি ও ঘণ্টাধ্বনিতে শুনতে পায়নি কেউ। সেই কারণেই ব্রহ্মকুণ্ডে মা গঙ্গাকে এক বার পরশ-প্রণাম করে এলাম, তাই এত দেরি। (এর পর কোভিড দূরত্ববিধি মেনে প্রণাম।)। সাত খুন মাফ।

জোরেই বললাম সঙ্গী, বন্ধু, পরমাত্মীয় ধর্মাশোককে – ধর্মস্থানে অধর্ম হবে না? পাপ হবে না এই মিথ্যে বাক্যে?

ধর্মাশোক হাত নাড়ল। সংকেত দিল, হবে না।

আমার মন বলল, পুণ্যক্ষেত্রে, কুম্ভনগরীতে সব পাপ ধুয়ে দেয় মা গঙ্গা। ভাসিয়ে নিয়ে যায় খরস্রোতে সব পাপ। এমনকি মন্ত্রী, গেরুয়াজীবী, ধর্মধারীরাও বলছেন, করোনার জীবাণুও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মা গঙ্গা। ‘তৃতীয় নেত্রে’ ওঁরা দেখতে পাচ্ছেন, ভেসে যাচ্ছে সুপারস্প্রেডার করোনার বীজ-বীজাণু। তা হলে গোমূত্র, গোবর? ওগুলো প্রাইমারি ভোজ ছিল। এখন কুম্ভ এসে গেছে, পূর্ণ এবং পুণ্য ডুবকি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ? সুপার-ডুপার স্প্রেডার করোনাকে কবরে এবং চিতায় ফেলবে গঙ্গামাঈয়ার স্রোতে ভেসে যাওয়া ওই সব তুচ্ছ জীবাণূ।

হায় স্বদেশ! হায় মা গঙ্গা! হায় হিন্দু ধরম! এত অসম্মান তোমাদের হতে দেখিনি এতটা বয়সে। বেবাক বোবা হয়ে যাই। চোখ মুছি রুমালে। সামান্য চোখের বারিশ-বুঁদে মন ভিজবে না এই সব অবিবেচক ধর্মধ্বজাধারীর। তারা হোমাগ্নি ছুঁয়ে বলবে, রাতে ঈশ্বর এসে আমার কানে কানে বলে গেছে এই সব অমৃতবাণী। এসো, ডুবকি লাগাও। বচন শোনো। করোনা ভাগ জায়েগা।

গেট খুলল সুবেশ বর্শাধারী। চোগা-চাপকান, কোমরে জরির কোমরবন্ধনী ঝকমকাচ্ছে। দ্বাররক্ষী খুব সম্মাননীয় পদ আখাড়ায়। নানা ধর্মীয় উৎসবে এরা সুসজ্জিত হয়ে ধর্মের পয়লা প্রবেশপথ রক্ষা করে। কুম্ভমেলা ছাড়াও সর্বভারতীয় নানা মেলায় দেখেছি। এরা ঘোষকের কাজও করে। প্রধান কর্তার নির্দেশ এরা আমজনতাকে বাতলে দেয়। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমের পূর্ব যুগ। সুকণ্ঠ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হয়। চাপা দাড়ি, মোচ থাকা চাই। বিশ্বাসী এই দ্বারীর পোস্ট বংশ পরম্পরায় রক্ষিত।

ভাঙা ও ভুল হিন্দিতে বাতচিত

হিন্দিতে লিখলে বহু ভুল হবে। তাই মাতৃভাষার স্মরণ নিলাম। যদিও কথা বলেছিলাম ভাঙা ও ভুল হিন্দিতেই। পহেলা প্রণাম আখাড়া কো আরাধ্য কে লিয়ে। প্রণাম দুয়ারবান। প্রণাম বিশ্বাসী, ধর্মীয় দ্বারী। সক্কলের শুভ হোক। আমি বাংলা থেকে এলাম।

গলে গেল দ্বারী। কিসকো মিলনা হ্যায়? আপনি তো দু’ বার এখানে এসেছেন। এক বার তো ধুতি পরে। শুভ নাম আপকা? ভুল গিয়া ম্যায় নে।

অশোককুমার। মুম্বই কা নহি, কলকাত্তা কা। মিলনা চাহে তো সংগীতানন্দজি কো। উনি ভেট করার জন্য আজ টাইম দিয়েছেন।

জরুর। সাক্ষাৎ হয়ে যাবে। বসুন।

এত বছর কুম্ভের, আখাড়ার, সন্ন্যাসী-বৈরাগী-উদাসীন, এঁদের কাছে পৌঁছে পয়লা ধাপের এটিকেট সম্পর্কে সতর্ক থাকি। প্রতিটি আখাড়ার উপাস্যদেবের (দেবী শুধু অগ্নি আখাড়ার, গায়ত্রীমাতা) নাম মনে রেখে পয়লা দানেই তাঁকে প্রণাম জানাই। সুকণ্ঠে, স্থির চিত্তে উপাস্যকে স্মরণ করলে সম্মান বাড়ে ভক্তের। উপস্থিত পত্রকার/লেখক/কবির প্রতি তখন সন্ন্যাসীরা বিশেষ মনোযোগ দেন। এগুলো পাঠ্যবইয়ে নেই। জীবন-গ্রন্থ, পথের পুথিতে জমে আছে। ঘাম ঝরাতে হয়। শরীর ক্ষয় হয়। আলসার হয়। কিডনি ও লিভার ক্লান্ত হয়। তবেই অমৃত মেলে। তার পর অমৃত-অভিজ্ঞতার ধুসর পাণ্ডুলিপি রেখে চলে যেতে হয়। ‘রাম নাম সচ হ্যায়’।

সুসজ্জিত, একেবারে দশনামী, শ্রীপঞ্চদশনাম পঞ্চাগ্নি আখাড়া, সংক্ষেপে অগ্নি আখাড়ার ড্রেস কোডে। এই আখাড়ার সন্ন্যাসীরা অন্য দশনামীদের মতন পোশাক পরেন না। এবং অন্য দশনামী আখাড়ার সন্ন্যাসীরা গেরুয়াধারী হলেও, এঁরা, অগ্নি আখাড়ার সকলেই ব্রহ্মচারী। তাই ব্রহ্মচারীর বেশ। গৈরিক বসন নয়। সাদা কাছামুক্ত ব্রহ্মচারী।

ইতনা দের কিঁউ?

সাড়ে সাত পৌনে আটটায় এসেছিলাম। তখন পূজার ঘণ্টা-আরতি-শিঙার শব্দে কেউ শুনতে পায়নি হয়তো। তখন গেটম্যান মন্দিরে গিয়েছিল। তাই আমি গঙ্গামাঈকে পরশ-প্রণাম করে এলাম। কাজে বেরিয়েছি কিনা।

বহত অচ্ছা কিয়া। তুরন্ত আ যাও। প্রেসিডেন্ট মহারাজ কো সাথ ভেট করো। ম্যায় নে পুজ্যপাদ স্বামীকে পাশ তুমার লিয়ে ইনফরমেশন দে দিয়া। জলদি চলো। আধা ঘণ্টা বাদ মিটিং শুরু হো জায়েগা। উসি টাইম বাহার কা আদমি অ্যালাও নহি।

জয়গুরু। (চলবে)

আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *