করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/৪: হাঁটি বহতা গঙ্গার পাড় ধরে, ঘুরে আসি ভীমগোড়া, কনখল

অশোককুমার কুণ্ডু

কুম্ভের পাঠকদের কষ্ট দিয়েছি। তিন সত্যি। তিনটি পর্বে তত্ত্বের আলোচনা। অমৃতকুম্ভের যাত্রা-বিবরণ ছিল সামান্যই। তত্ত্বমসি না হলে দুধে ছানা কাটবে না? কুম্ভ নিয়ে কত যে ভুলভ্রান্তি আম-জাম-রাধে-শ্যামদের। অথচ বাউলের রূপকাশ্রিত দেহতত্ত্বের গান তো মন-প্রাণ-হৃদয় দিয়ে শোনে পাঠক। তা হলে আমরা যারা কুম্ভমেলা নিয়ে লিখি, তাদের লিখনে কোথাও খামতি, ঘাটতি থেকে যাচ্ছে কি?

বেশির ভাগ গ্রন্থে, বাংলা ভাষায় লেখা গ্রন্থে, গদগদে অধ্যাত্মের নালা-ঝোলা। লেখকের পরিষ্কার ধারণা নেই কিছুই, বিষয়বস্তু সম্পর্কে অজ্ঞ। পাঠক নাকি এই ভাবাবেগের মাখো মাখো ‘রসা’ পচ্ছন্দ করে। একদম ভুল। অনেক ক্ষেত্রে বানানো অলৌকিক ঘটনার বিবরণ। এ তো পাঠককে ঠকানো। এবং আমি বিশ্বাস করি আজও, এমন গদগদ অকারণ বিনয় প্রয়াত মহাত্মাদের অসম্মান।

ঘন ঘন ফোনের হানা

ফোন আসছে প্রায় আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ছাড়া ছাড়া। আমি পথে হাঁটন্ত অবস্থায় মোবাইল দেখি না। হয় ঘরে ফিরে বা রাস্তায় কোনো নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে দেখে নিই। কার ফোন। কী বলতে চায়। মানুষের এত ধৈর্য কেড়ে নিয়েছে এই যান্ত্রিক যন্ত্র, মোবাইল। কিছু বলার নেই। ফোন দেরিতে ধরলে ও প্রান্ত থেকে অভিমান। অভিমান থেকে ক্রোধ। ক্রোধ থেকে আক্রোশ। ফোনে প্রতি-উত্তর দিতে চাইলে তিনিও ফোন ধরবেন না। গৃহিণী হলে, পারলে এসএমএস-এ ডিভোর্স।

অচেনা ফোন সাধারণত ধরি না। নানা ফ্যাঁকড়া। হাউস লোন, কার লোন ইত্যাদি প্রভৃতি। আরে আমি নিজের সঙ্গেই লোনলি হয়ে আছি।

শরীরে টান ধরছে, অর্থাভাবে ‘ডবল হাফ’ ফেভারিট কেবিনে। কোনোক্রমে মাইল চার হেঁটে অকুস্থলে। ফেরার সময় ক্লান্ত দুপুরে কুকুর-ধোঁকা। রিকশায় ফেরা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে। মেলা মরশুমে প্রচুর ভাড়া রিকশায়। তা ছাড়া রাস্তায় রিকশার সংখ্যাও অত্যন্ত কম। অটো (এখানে বলে বিক্রম), বেশ বড়ো। আট জন যাত্রী ধরে। পুরো রিজার্ভ করতে হবে। তা না হলে সাত জন সওয়ারির পরেও অপেক্ষা করতে হবে অষ্টম জনের জন্য। ঘোড়ার গাড়ি বেরিয়েছে কিছু, পথে পথে ঘুরছে যাত্রীর জন্য।

উপদেশ, সতর্কবাণী, চাহিদা

বারে বারে নানা জনের ফোন। পাঁচ ধরনের চরিত্র। একদল পরিচিত। একদা সহকর্মী, বন্ধুজন। তাদের গালাগাল, উপদেশ বা সতর্কবাণী। এই বয়সে এই করোনা-আক্রান্ত কুম্ভে কেন গেছ হরিদ্বারে? না গেলে অমৃতকুম্ভের, হরিদ্বারের বা যে কাগজের মৌখিক অনুমতি নিয়ে গেছ, কার কী ক্ষতি হত? করোনায় মরতে চাও? এক বার তো করোনা হয়ে গেছে। শহিদ হতে চাও? এত বার কুম্ভে গিয়েও আশ মেটেনি?

আর এক দলের সতর্কবাণী, টেক কেয়ার। সাবধানে, সতর্ক থেকো। তবে সতর্ক থেকেও করোনা হতে পারে। একমাত্র মহৌষধ, বাড়িতে থাকা। কোথাও না বেরিয়ে। সত্যিই কি তা-ই?

তৃতীয় দল কুম্ভের বিবরণ শুনতে চায়, জ্যান্ত প্রতিবেদকের কণ্ঠে। তা-ই দিয়ে, হরিদ্বার সূত্রে জানা গেল বলে বা সূত্রের নাম উল্লেখ করে ফেসবুকে চমকানো আঠারো কাহন।

চতুর্থ দলের গভীর আগ্রহ, হোটেলের ঘর, আশ্রমের বুকিং ইত্যাদি নিয়ে। খাবার কী পাওয়া যাচ্ছে। অথবা রাঙামাসির বড়ো ছেলে তিন বন্ধু মিলে হরিদ্বার গিয়েছে। আপনার/তোমার/তোর ফোন নম্বর দিয়েছি। ওরা যোগাযোগ করবে।

পঞ্চম দলের আবেদন – এটা তো মোবাইলের যুগ, ‘এই সময়’ ডেলি আমরা শুধু সানডেতে নিই। যে দিন যে দিন লেখা বের হচ্ছে, তার লিঙ্কটা পাঠিয়ে দেবেন/দেবে/দিস প্লিজ।

কুম্ভমেলা নিয়ে সামান্য কিছু তত্ত্ব-তথ্য জানি হয়তো বা। কিন্তু ঘর পাওয়া, হোটেল ভাড়া, কোথায় ভালো খাবার মিলবে, এ সব জানার প্রয়োজন আমার পড়ে না। হরিদ্বারে হোটেলের ঘরভাড়া, একেবারে ব্রহ্মকুম্ভের নাকের ডগায় বা গোড়ালির কাছে – কেমন করে জানব? অনেক ক্ষেত্রে সেকেন্ড ওপিনিয়নের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ। আসলে কেউ পরিশ্রম করবে না। সব্বার ফিডিং বোতল চাই। আমার পকেট থেকে টাকা দিয়ে ঘর বুকিং করলাম, তিনি আসতে পারলেন না। পাছায় ফোঁড়া। ছোটো ছেলেটার ধুম জ্বর। বড়ো মেয়েটার পেট ছাড়ল। কত্তার অফিস ছুটি ক্যানসেল করে দিল। কিন্তু এক বারও জানাল না, বুকিং-এর টাকা যে আমার পকেট থেকে দিলাম, তার কী হবে। অনেকের ধারণা, আমরা তো থাকিইনি। বুকিং ক্যানসেল করেছি। তা হলে টাকা কেন?

এ রকম কত কত তিক্ত অভিজ্ঞতা এত বছর কুম্ভে জমেছে। এ বারে হরিদ্বারের হোটেল ও ধর্মশালার অঘোষিত সিদ্ধান্ত, নতুন বুকিং আর নেওয়া হবে না। এটা প্রশাসনেরও সিদ্ধান্ত – জানিয়ে দিলাম সকলকে।

গরম কেমন? বৃষ্টি হবে কিনা? ছাতা নেব কিনা? একজনাকে বললাম, ভোর রাতে বড্ড শীত, একটা কাঁথাও আনবেন সঙ্গে। হরিদ্বারে সুপার স্প্রেডার করোনার পূর্ণকুম্ভে এই সব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ঘাট থেকে ফিরি ছাতা মাথায়। যাই খুব সকালে।

আট সওয়ারির ‘বিক্রম’-এ

কোনো দিন হাঁটি বহতা গঙ্গার পুব পাড়ে। কোনো দিন পশ্চিমে। একদিন বাজার ঘুরি। ইচ্ছে ছিল একদিন যাব উত্তরে, হৃষীকেশে। পারিনি, খুব বেশি ভাড়ার কারণে। তবুও একদিন গেলাম ভীমগোড়ায়। আট সওয়ারির অটো, থুড়ি ‘বিক্রম’-এ চড়ে। কনখলে দু’ দিন গিয়ে আশ মেটে না। বড়ো শান্ত স্থল, বিশেষত গঙ্গার পাড় এবং দক্ষযজ্ঞের মন্দির।

যদুনাথ সরকারের লেখা ‘আ হিস্ট্রি অব দশনামী নাগা সন্ন্যাসিস’, প্রথম প্রকাশক: শ্রীপঞ্চায়েতী আখাড়া, দারাগঞ্জ, ইলাহাবাদ। এরই পেপারব্যাক এডিশন দেখলাম, সামান্য কপি বিক্রি হচ্ছে। এক তরুণ ব্রহ্মচারী বিক্রি করছেন। আসল দামের উপরে চিপ্পু। আসল দাম ছিল দশ টাকা। বর্তমানে কাগজের চিপ্পু মেরে একটা অতিরিক্ত শূন্য ডাইনে। মানে একশো টাকা। সাব্বাস ব্রহ্মচারীজি। বৈরাগ্যের শুরুতেই তোমার মোক্ষলাভ করতলগত। ভারতীয় অধ্যাত্মের পরম্পরা? প্রিন্টার্সের পাতাটা আলোর দিকে ধরলে পুরাতন দাম পড়া যায়। তবুও কিনলাম এক কপি।

ঘরে ফিরে উপহার দিয়েছি সাংবাদিক বন্ধু কুবলয়কে। এবং বাইরের দাম দু’ নম্বরি করে বাড়ানোর জন্য মহানির্বাণীর উপাস্য (আরাধ্য) দেব কপিল মুনিজির (সাগরমেলার মন্দির‍) কাছে বিচার চেয়ে রাখলাম। জানি, ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় রায় পেতে বাদী-ফরিয়াদি-বিচারকদের না স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে!

কুম্ভমেলার সঙ্গে যতই দিন যাচ্ছে ততই তার ক্লেদ-গ্লানি-গাদ দেখতে পাচ্ছি। আখাড়ায় আখাড়ায় আক্রোশ। ভাষা ও বাক্যেও হিংস্রতার ‘পান’ দিচ্ছে। কোথাও শান দিচ্ছে। দেব-দেবী নয়, টাকাই ঈশ্বর। টাকাই উপাস্য-উমানাথ-শংকর। এত টাকা টাকা করলে সন্ন্যাসজীবনের ধরম-করম কখন করেন হে সন্ন্যাসী?

সবাই এক লপ্তে একই রকম নন, এ কথা বলাই বাহুল্য। তাই তো এখনও মানুষ ঘাম ঝরায় কলকে ফুলের শিকড়ে। ফুলের আশে। ফুল ফোটে। ভোরে ব্রাহ্মমুহূর্তে, ওহে জীবন। জীবনদেবতা, তোমারে সুর শোনায়ে বেঁচে থাকে প্রেমিক পতঙ্গ। পাখি গান গায়। জলে ফোটে লাল ফুল।

হঠাৎ ডাক, কলকাত্তা কা বেটা?  

থমকে দাঁড়াই। পায়ে পায়ে জড়ায়। কে ডাকল না? “রিপোর্টার, তুম কব আয়ে, কলকাত্তা কা বেটা?”

প্রণাম মহারাজ, শ্রীমৎ সংগীতানন্দজি। পহেলে প্রণাম ইষ্টদেব। প্রণাম গিরনারিবাবা। এক হপ্তা হো গিয়া। হালচাল সব ঠিক হ্যায় না? গ্যারা এপ্রিল আয়া।

বিলকুল ঠিক।

করোনা কা টাইম মে এক এক কাঠ্ঠা হো কর ক্যায়সে পুণ্যস্নান হোগা। কুম্ভমেলা পুরা দেড় মাহিনাতক চলেগি?

জরুর চলেগি। তব অফসর লোগ মেলা কো সংকোচন কর দিয়া। এপ্রিল মাস পুরা চলে গা। এক মাহিনা।

বছর পাঁচেক আগে শিবরাত্রির মেলা দেখতে গুজরাতের ছোট্ট জনপদ গিরনারে গিয়েছিলাম। সংগীতানন্দজি তাঁর আশ্রমে অনেক যত্নআত্তি করেছিলেন। সন্ন্যাস- আখাড়া-কুম্ভমেলা নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছিলেন। মনে আছে দু’ জনের দু’ জনকে। আমার এই আড়াই দশকের অধিককাল কুম্ভভ্রমণের কারণে খুবই স্নেহ করেন। প্রতি বার কুম্ভে দেখা করি। উনি আমাকে দু’ টাকার আশীর্বাদী কয়েন দেন এবং নানা গুজরাতি প্রসাদ (খাবার) দেন।

কাল সুবে সাত বাজে হমারি টাইম। তুমহারি রিপোর্টিং কা যাদা রসদ মিল যায়েগা।

প্রণাম করলাম। কোথাকার মাস্ক কোথায় পরেছে বাবাজি (মনে মনে বললাম)। শুভ্র সফেদ কৌপীন যৌনাঙ্গে। মুখ খোলা। (চলবে)

আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *