করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/৬: শামিল হলাম অগ্নি আখাড়ার পঙ্গতে

অশোককুমার কুণ্ডু

সুপারস্প্রেডার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ২০২১-এর পূর্ণকুম্ভের হরিদ্বার ছিল বিশেষ সংকটের, অন্তত আমার কাছে। সকল পরিচিত-প্রিয়জনের নিষেধ না মেনে, অসুস্থ শরীরে, প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে আসা।

ছিল তিনটে প্রধান সংকট। এক: এ বার কুম্ভ ঘুরতে প্রচুর ব্যয় হবে জানতাম। দুই: কোনো সংস্থার পরিচয়পত্র হাতে ছিল না। এক জন ফ্রিল্যান্সার হিসাবে তা দাবি করি না। দাবি করতে পারি না। আমি বিখ্যাত লেখক বা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হলেও বা সম্মান, পরিচয়পত্র-সহ সাম্মানিক ও পাব্বুনির কলাটা-মুলোটা পেতে পারতাম। তিন: সংকট ও শঙ্কা ছিল, করোনাক্রান্ত হয়ে অমৃতশহরের কুম্ভে মরলে ঝামেলার একশেষ হত। কে দায়িত্ব নেবে? ঝামেলা আমার নয়। আশ্রয়দাতা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা অসুবিধায় পড়তেন। বেশি করে পড়তেন সঙ্ঘ সম্পাদক দিলীপ মহারাজ এবং সহকারী সম্পাদক ভাস্করানন্দজি। করোনার মুর্দা কুষ্ঠাক্রান্ত মৃতদেহের মতোই আতংকের।

অগ্নি আখাড়ায় পেলাম সন্দেশ

কথায় বলে, যে খায় চিনি/তাকে জোগায় চিন্তামণি। কোনো অমৃত-মজুরি ছাড়াই অমৃতের সন্ধানে মজে দু’ হপ্তার বেশি করোনাক্রান্ত হরিদ্বারে কাটিয়ে তো এলাম। লিখলাম। ডেলি রিপোর্ট ছাপা হল দৈনিকে। ‘এই সময়’ কাগজে। মহাকাল, অত্যাধুনিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে সব সাফ করে দেয়। থাকে শুধু কর্মের সুগন্ধ-সমাচার, ধরণির এক কোণে। মহাকাল তাকে ঝাঁটায় না। লাথায় না। মাথায় করেই রাখে। তা না হলে মহাকাল নিজেই অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। সবটাই সে খারাপ করে না। যেমন এই আজকে শ্রীপঞ্চদশনাম পঞ্চাগ্নি আখাড়া বা অগ্নি আখাড়ায় গিয়ে যে সন্দেশ (সংবাদ অর্থে) পেলাম, তা টেক্সট হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সব কথা লেখা যাবে না, উচিতও নয়। আমরাও কি জীবনের, সংসারের সব কথা বলতে পারি? স্বীকারোক্তিতেও কত কত বাধা-সংকোচ-সংশয় থেকে যায়। তা সব না বলেই চলে যেতে হয়। তা ছাড়া আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম সব কিছু লিখব না। ভাসা ভাসা লিখলেও তা, ‘সূত্র মারফত খবর পাওয়া গেল’ বলে লেখা যেতে পারে। যেমন লেখেন সাংবাদিকতায় যুক্ত মানুষরা। নিউজ সোর্সের নাম উল্লেখ করতে নেই। তাতে দু’ পক্ষেরই অসুবিধা।

সুরেশানন্দজি আলাপ করিয়ে দিলেন। দেখলাম বাছা বাছা মাথা, উচ্চপদাধিকারীদের মধ্যে আমার চেনা দু’-চার জন উপস্থিত। গুজরাতের গিরনারের সব চেয়ে বড়ো বাড়িটি অগ্নি আখাড়ার। ওখানে বিখ্যাত শিবরাত্রির মেলায় আশ্রয়-অন্ন পেয়েছিলাম এক সপ্তাহ। দায়িত্বে থাকা প্রেসিডেন্ট ব্রহ্মচারীজি, কাশীর মঠের কোষাধ্যক্ষ ব্রহ্মচারীজি এবং আরও দু’-চার জনের প্রশ্ন, “বাঙ্গাল কে বেটা, কিতাব কব নিকলেগা?” আমার গলায় ঝুলছে, এ যাবৎ পাওয়া নানা সনের চারটি কুম্ভের একাধিক প্রেসকার্ড।

সংগীতানন্দজি খুব গর্ব করে ছোটো করে আমার পরিচয় দিলেন। এবং বললেন, উনহোনে নোকরি ছোড় কর দো হাজার চার সাল সে আভি তক কুম্ভমেলা মে ঘুমতে রহে। স্রিফ এক কিতাব লিখনে কে লিয়ে।

সকলেই আশীর্বাদ জানালেন। আমি বললান, উপাস্যমাতা দেবী গায়ত্রীমাকে প্রণাম। সমস্ত অধিষ্ঠিত সন্ত, ব্রহ্মচারীকে প্রণাম। জয় গিরনারিবাবা। জয় বরফানি (বরফগলা জল হরিদ্বারে প্রথম সমতল পাচ্ছে, তাই এখানের কুম্ভকে বরফানি কুম্ভ বলে) কুম্ভ, প্রণাম গঙ্গাদেবী। আপনাদের আশীর্বাদে এই পুণ্যকুম্ভের গ্রন্থ যেন দ্রুত আমার মাতৃভাষা বাংলায় প্রথমে এবং পরে হিন্দি ও ইংরেজিতে প্রকাশ পায়। এই আমার জীবনের ব্রত।

মিটিং শুরু হবে শিগগির। সেখানে আখাড়া-আশ্রমের বিশেষ কিছু পদাধিকারী ছাড়া আর কেউ থাকতে পারেন না। এ বার কোভিড-কুম্ভের জটিলতা সম্পূর্ণ আলাদা। রয়েছে টেনশন, চলছে দড়ি টানাটানি ধর্ম বনাম ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতির। আর এই সবে বাজিগরের ভূমিকায় হরিদ্বারের কোভিড-কুম্ভ মেলা। এক বছর পরেই উত্তরাখণ্ড ও লাগোয়া উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। এই দুই রাজ্যের গদিতে এবং দিল্লির মসনদে আসীন শাসকদলের সামনের নির্বাচনে সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ভর করবে এই কোভিড-কুম্ভের উপর। এবং তাতে জল ঢেলে দিতে পারেন তেরো আখাড়ার প্রধানরা। ধর্মগুরুরা ফোঁস করলে রাজসিংহাসনের পায়া ভাঙবে। এই অবস্থা বরাবর ছিল। রাজতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মগুরুদের জোরালো সম্পর্ক বরাবরই ছিল। ছিল না এখনকার মতো ধর্মের শপিং মল, বেচাকেনা, কুটিল-জটিল লেনা-দেনার বেনেগিরি।

নিউজ স্টোরির পদধ্বনি

আমায় বসিয়ে (সদ অর্থে) দিয়ে গেলেন বেশ কিছুটা দূরে, বারান্দায়। নির্দেশ আখাড়া সভাপতির। আমাকে পঙ্গত (আখাড়ায় দুপুরের প্রসাদ গ্রহণের অনুষ্ঠান) করে যেতে হবে। মানে, আরও ঘণ্টা দুই-আড়াই। কোনো কাজ ছাড়াই। তবে নোজ ফর নিউজ থাকলে যে কোনো সাংবাদিক আন্দাজ করতে পারবেন বড়ো কিছু একটা ঘটবে। অন্তত নিউজ স্টোরির সূত্র-সন্ধান থাকবেই। তার পদধ্বনি পাচ্ছি।

দূর বারান্দার এক কোণে একটা চুপচাপ ভিজে বিড়াল হয়ে বসে আছি। বই পড়ছি। না, পড়ার ভানে। বড়ো বড়ো দামি গাড়িতে নানা ধর্মীয় মাথারা, থুড়ি গৈরিক সিইও, গৈরিক এমডি, সাদা কাপড়ের বাবাজি খড়ম খটখটিয়ে, কেউ গলায় বিশ ভরির সোনার হার (ভক্তের দেওয়া, গরিব সন্ন্যাসী পাবেন কোথায়?) ঝুলিয়ে, পারফিউমের ভুরভুর গন্ধ উড়িয়ে, আসছেন। আসছেন ভারতবর্ষের অধ্যাত্মবাদীরা অগ্নিতে সমিধ দিতে। প্রতি জনের সঙ্গে এক জন করে সেবক, কম্বলের আসন বগলে বা জলচৌকি হাতে – প্রভুজির জন্য। অন্যের পাতা আসনে, ফরাসে এমনকি পশমিনার আসনেও বসবেন না। আপনা আপনা বৈরাগ্যের শুদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রাখা। জয় গুরু।

দূর থেকে আলোচনার যে ‘মিউমিউ’ স্বর শুনতে পাচ্ছি তার সারাংশ হল, মেলা কত দিন চালানো হবে? বা চলবে? উত্তরাখণ্ড এবং কেন্দ্র, দু’টোই বিজেপিশাসিত। উত্তরাখণ্ড সরকার তো মেলা সংকুচিত করেছে। পয়লা এপ্রিল থেকে (এপ্রিল ফুল নয়তো?) এক মাস। তা তো নয়। করোনা না থাকলে তো দেড় মাস চলত। কিন্তু ৩২৫ কোটি টাকা কেন্দ্রের অনুদান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উত্তরাখণ্ডের ম্যাচিং গ্রান্ট। এবং কেন্দ্রের আপৎকালীন আরও গ্রান্ট। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার ছুঁই ছুঁই। অবশ্য খরচও বিস্তর। রাস্তাঘাট, লিঙ্ক ব্রিজ, কানেক্টিং রোড, হাজার হাজার তাঁবু আংশিক খরচ। কিছুটা পকেটে, কিছুটা ফোকটে।

বিশাল মেলামাঠ এ বার টেন্টহীন

কিন্তু এ বার কনখল থেকে হৃষীকেশ অবধি, এই বিশাল মেলামাঠে, কোভিডের কারণে কোনো তাঁবুই পড়েনি। বিশাল মেলামাঠ একেবারে টেন্টহীন। একটা বড়ো খরচ বেঁচে গেছে, রাজ্য সরকারের এবং আখাড়ার। বাজেট তো কমেনি। সে তো বেড়েছে। যে সমস্ত ধর্মীয় সংগঠনের হরিদ্বার হোমল্যান্ড অর্থাৎ স্থায়ী ঠিকানা, তাদের আশ্রমের ভিতরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকার। এবং সূত্র বলছে, মঠ-মিশন ও আখাড়ার জন্য সরকার মাত্র এক কোটি করে দিয়েছে। এতে আদৌ সন্তুষ্ট নন ভারতীয় ধর্মগুরুরা। সেখানেই লেগেছে পেটকাটি চাঁদিয়াল বনাম শঙ্খচিল বনাম তাগড়াই বাজের লড়াই। হরিদ্বার ‘কুরুক্ষেত্র’। ভক্ত-গুরু বনাম কোভিড। আখাড়া-রাজ্য সরকার বনাম সুপারস্প্রেডার করোনা-কুম্ভ। কেউ জিতবে না। যুদ্ধে ক্ষয় অনিবার্য। তা জেনে বুঝেও যুদ্ধ লাগায় মানুষ। শেষে, হালালনামা লেখেও সেই মানুষ। তা থেকেও এই গৃহত্যাগীরা, সংসারীরা কোনো পাঠ গ্রহণ করেনি। ‘খোদা অ্যায়সা চিজ/রুপিয়া কা পাশ উনিশ বিশ’।

প্রতিটি কুম্ভে নানা রকমের বখরা নিয়ে হল্লা, ঘাপলা শুনেছি, দেখেছি। কিন্তু এ বারের প্রেক্ষাপট, মৃত্যুর খাদে দাঁড়ানো মানুষ। করোনা-আক্রান্ত কুম্ভনগরী। হৃষীকেশ-মুসৌরি-হরিদ্বার করোনার চাপে ও টেম্পারেচারে। মারা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও লকডাউন দিনের কিছুটা। এবং সেই বিপদকালে ‘বিশুদ্ধ’ গঙ্গাজলে ধৌত গণতান্ত্রিক সরকার ও ধর্মীয় ভারতের ত্যাগী সন্তানেরা বখরা নিয়ে ব্যস্ত। হায় শংকর! হায় উমানাথ! হায় মায়াপুরী! হায় হরির চরণ! সতীর জঠর পড়েছিল এই পুণ্যপীঠে। তাই কি মানুষ – সন্ন্যাসী, বৈরাগী, মন্ত্রী-সান্ত্রীদের জঠর জ্বলে এখানে দিবারাত্র?

আমারও জঠর জ্বলছে। সাত সকালের একটি মশলা দোসা আর এক গ্লাস লস্যি মিলিয়ে গেছে। সংগীতানন্দজি নিচু স্বরে বললেন, “সামহাল কো লিখনা। নহি তো দোনো নাশ হো জায়ে গা। চলো পঙ্গত কো নিশানা।”

আরও এক দফা প্রণামপর্ব এবং খাবারের লাইনে। এক দিকে নামীদামি সন্তজন আর একটু দূরে আমার মতো গুটি কয়েক অতিথি। করোনার কারণে ভক্তজন প্রায় নেই। উঠে দাঁড়িয়ে করজোড়ে ইষ্টদেবী ও অন্নপূর্ণা মাকে প্রণাম। সমস্ত উপস্থিত সন্তজনকে প্রণাম।

মুগ্ধ হয়ে আমার শিষ্টাচার দেখে বাবাজিরা অবাক। গলায় ঝুলছে একাধিক প্রেসকার্ড। আমাকে নিয়ে চলছে গুঞ্জন। (চলবে)

(এই পর্বে কিছু সন্ন্যাসীর নাম পরিবর্তিত)

আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *