সবুজের সাগরে ভেসে পৌঁছোলাম পাচেং

শ্রয়ণ সেন

“কাঞ্চনজঙ্ঘা তো অনেক বার দেখেছেন, এ বার শুধু সবুজটা দেখুন।”

মধ্যাহ্নভোজনের পর সিরুবাড়ি ভিউ পয়েন্টের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। মনে পড়ে গেল কিছুক্ষণ আগেই বিমলদাজুর বলা কথাগুলো। চারিদিকে এত সবুজ যা স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না।

এটা স্বর্গরাজ্যের থেকে কম কী! যে দিকে চোখ যাচ্ছে শুধু চা-বাগান আর চা-বাগান। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধাপে ধাপে নেমে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে মেঘ এসে ঘিরে দিচ্ছে চারিদিক। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে সরে যাচ্ছে, আবার বেরিয়ে পড়ছে সবুজ বাগিচাগুলো।

মনকে বলতে ইচ্ছে করছে যে শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে, ঝুঁকি নিয়েও এই অদ্ভুত সময় পাহাড়ে বেড়াতে আসার সিদ্ধান্ত সার্থক।

মধ্যাহ্নভোজনের ঠিক আগেই এসে পৌঁছেছি বিমলদাজুর আস্তানা চিয়াবাড়ি হোমস্টেতে। তাঁর এই আস্তানাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুঁজে বের করেছিলাম। সেখানেই জানতে পারি যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের দাপট কমতে তিনি তাঁর হোমস্টে পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছেন। ব্যাস, সেটা দু’ দিনের জন্য বুক করতে এক মুহূর্তের জন্যও দেরি করিনি।

এই প্রথম কার্যত নিজের দায়িত্বে ৬ জনের একটা গ্রুপকে বেড়াতে নিয়ে এসেছি। সবাই প্রবীণ। সেকেন্ড ওয়েভের দাপট কমলেও এখনও অনেকেই বেরিয়ে পড়তে ভয় পাচ্ছেন।

কিন্তু আমাদের কাছে মন ভালো রাখার সব থেকে ভালো ওষুধ তো এই বেড়ানো। তা ছাড়া সবারই দু’ দফার টিকাকরণ হয়ে গিয়েছে। কিছুটা ভয় কাজ করলেও তাই সবাইকে রাজি করাতে পারলাম। কথা দিলাম, ভিড়ভাট্টা হতে পারে, এমন জায়গার বাইরে নিয়ে যাব।

তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউই যে শুধু ভয়ের ব্যাপার ছিল, তা কিন্তু নয়। আরও একটা ঝুঁকি ছিল বর্ষায় পাহাড়ে আসা। একাধিক বার উত্তরবঙ্গে এলেও জুলাইয়ের ভরা বর্ষায় কখনও পাহাড়ে যাইনি।

যা-ই হোক, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আর জগৎজননী মা সারদার নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউয়ের কারণে এখন পর্যটনস্থলগুলিতে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেড়াতে গেলে তাই হয় দু’ ডোজ টিকার সার্টিফিকেট লাগবে, কিংবা কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট।

আমাদের গ্রুপের মধ্যে শুধুমাত্র আমারই টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া হয়নি, অগত্যা কোভিড টেস্ট করাতে হয়েছে। নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়েই পাহাড়ে এসেছি। দার্জিলিং পাহাড়ে ওঠার আগে রোহিণীতে সে সবের ওপরে কড়া নজরদারি চালাচ্ছে পুলিশ।

পুলিশ চেকিংয়ের পর পাহাড়ে ওঠা শুরু। সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল গোটা রূপ। এই রোহিণী রোড ধরে বেশ কয়েক বার দার্জিলিং গিয়েছি। কিন্তু এ বারের মতো রূপ আগে কোনো বারই চোখে পড়েনি। মেঘবৃষ্টি তো আছেই, সেই সঙ্গে যে সবুজটা এখন দেখছি তা কল্পনারও বাইরে।

— “দাদা দাঁড়াব?”

সারথি বাপিদার কথায় সংবিৎ ফিরল। এতক্ষণ সবুজের সাগরে ভেসে কার্যত কল্পনার জগতে চলে যাচ্ছিলাম। বাপিদার কথা শুনেই ডান দিকে তাকিয়ে দেখি একটা ঝরনা।

এটাই বর্ষার সৌন্দর্য। এর আগে কখনও এইখানে এমন ঝরনা দেখিনি। প্রবল বেগে, কানফাটানো শব্দ নিয়ে সে নেমে আসছে ওপর থেকে। আবার সেই বেগেই সে নেমে যাচ্ছে নীচে। হয়তো কোনো পাহাড়ি নদীতে গিয়ে শেষ হয়েছে তার যাত্রা।

কার্শিয়াং পৌঁছোতেই মিলিত হলাম বিখ্যাত হিলকার্ট রোডের সঙ্গে। এই রাস্তাটাকে দেখলেই আবেগে ভেসে যাই। পাশ দিয়ে যাচ্ছে টয় ট্রেনের লাইন। তবে ট্রেন এখন চলছে না।

ঠান্ডার লেশমাত্র নেই। হতে পারে বর্ষার কারণেই। মেঘে ঢাকা কার্শিয়াংকে অতিক্রম করলাম। ধীরে ধীরে পেরিয়ে গেলাম কার্শিয়াং স্টেশন এবং বাজার এলাকা। তার পর পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের কার্শিয়াং টুরিস্ট লজ পেরোতেই শেষ হয়ে গেল শহরটা।

কিছুক্ষণের জন্য সবুজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আবার পড়লাম সবুজের সাগরে। বৃষ্টি হচ্ছে মাঝারি, গাড়ির কাচে যে জল আসছে সেটা সরিয়ে দিচ্ছে ওয়াইপার। কিশোরের গান চলছে গাড়িতে। আহ, এক মায়াবী পরিবেশ।

ছোট্ট স্টেশন টুং পেরিয়ে গেলাম। টয় ট্রেনের লাইনটা কখনও আমাদের বাঁ দিকে আসছে, কখনও চলে যাচ্ছে ডান দিকে। এ ভাবেই এগোতে এগোতে পৌঁছে গেলাম সোনাদা। হিলকার্ট রোডের ওপরে অন্যতম ব্যস্ত এক শহর এই সোনাদা। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ৬ হাজার ১৪৩ ফুট। বাঙালির অতিপ্রিয় এই সোনাদা থেকেই হিলকার্ট রোড ত্যাগ করলাম। ঘুরলাম বাঁ দিকে, পাচেংগামী পথে।

রাস্তা এ বার ক্রমশ নামতে শুরু করল। দশ মিনিট এ ভাবেই টানা নেমে যাওয়ার পর একটা বাজার এলাকা পড়ল। দোকানের সাইনবোর্ড দেখেই বুঝে গেলাম এসে গিয়েছি আমাদের প্রথম গন্তব্যে। এ বার আমাদের আস্তানাটা খুঁজে বের করতে হবে।

তবে বেশি হ্যাপা পোহাতে হল না। আমাদের অবস্থান সম্পর্কে সব সময় অবগত করে যাচ্ছিলাম বিমলদাজুকে। তাই তিনিও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষাই করছিলেন। সঠিক আন্দাজ করেই হাত দেখিয়ে আমাদের গাড়ি দাঁড় করালেন। সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে।

নিজের দু’ তলা বাড়ির ওপরের তলাটাকে হোমস্টে করেছেন বিমল ছেত্রী। এ ছাড়াও তাঁর বাগানের ওপরেই আরও দু’টো কটেজও তৈরি করেছেন তিনি। এর মধ্যে একটি কটেজে দু’ জন, অন্যটায় চার-পাঁচ জন আরামে থাকতে পারেন।

এই দুটো কটেজেই আমাদের সকলের ঠাঁই। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলেন বিমলদাজুর স্ত্রী আমিনা। চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী খাদা পরিয়ে আমাদের হোমস্টেতে স্বাগত জানালেন তাঁরা।

বছরখানেকও হয়নি তাঁর বাড়িতে হোমস্টে তৈরি করেছেন বিমলদাজু। এই চত্বরে এটি একমাত্র হোমস্টে। নাম দিয়েছেন চিয়াবাড়ি হোমস্টে।

নেপালিতে চিয়া অর্থাৎ চা। তা হলে কি হোমস্টের সঙ্গে চায়ের সম্পর্ক আছে?

আলবাত আছে। বিমলদাজুই আমাদের মনের কৌতূহল দূর করে দিলেন। আসলে সাতটা বাগানে ঘিরে রেখেছে এই পাচেংকে। তাই নিজের বাড়ির নামও এমন করেছেন তিনি।

পাহাড়ের হোমস্টেতে একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য হল সুস্বাদু খাবারদাবার। দীর্ঘ সময়ের জার্নির পর খিদেও পেয়েছিল প্রচণ্ড। আমিনার হাতের অপূর্ব রান্না এক লহমায় এই খিদে আরও বাড়িয়ে দিল।

গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, ডাল, স্কোয়াশের তরকারি আর আলুভাজার সঙ্গে ছিল চিকেন। অপূর্ব তার স্বাদ। এমনকি যে স্কোয়াশের তরকারিকে কলকাতায় বিস্বাদ লাগে, সেটাকেই পাহাড়ি রান্নায় মনে হল অমৃত।

পেট ভরে খাওয়ার পর একটু হাঁটতে মন চায়। বিমলদাজুই সিরুবাড়ির কথা বললেন। রাস্তা খাড়াই নয়, তাই হাঁটাহাঁটি করতেও খুব ভালো লাগবে। আমরা এগিয়ে গেলাম সেই দিকেই।

পাচেং বাজারকে ডান দিকে রেখে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। এখন বৃষ্টি নেই, তবে মেঘে ঢাকা চারপাশ। আশেপাশের জঙ্গল থেকে নানা রকম পোকামাকড়ের শব্দ। সে শব্দগুলোও শ্রুতিমধুর। এর মধ্যেই রয়েছে হরেক রকম পাখির ডাক। আমাদের দলে কোনো পক্ষীবিশারদ থাকলে ডাক শুনে এখনই বলে দিতেন পাখির নাম।

আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই চলে এল সিরুবাড়ি ভিউ পয়েন্ট। চা বাগানের দৃশ্য করছে মুগ্ধ। চারিদিকে এত সবুজ দেখে চোখের তো আরাম হচ্ছেই, মনেরও হচ্ছে।

আহ! এমন একটা সময়, এমন একটা জায়গাই তো চাইছিলাম। গত দু’ তিন মাসের সেই দুর্বিষহ সময়টা পেরিয়ে এসেছি। বাড়ি বসে বসে কর্মব্যস্ততার মধ্যে প্রহর গুনেছি কবে এই ছুটিটা পাব। পাহাড় ডেকে যাচ্ছিল সব সময়, মনে হচ্ছিল এক ছুট্টে চলে যাই তার কাছে। কিন্তু সম্ভব হচ্ছিল না।

অবশেষে সুযোগটা এল। জানি না দু’ তিন মাস পর করোনার নতুন করে ঢেউ আসবে কি না। চারিদিকে ভয়ের আবহ এখনও রয়েছে। কিন্তু সেই ভয়কে দূর করে এখন আমাদের কাছে শুধুমাত্র একটায় চাওয়া – এই সবুজ যেন সঙ্গে থাকে পরবর্তী দশ দিনও।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *