নদী আপন বেগে… বিজনবাড়িতে

শ্রয়ণ সেন 

কটেজের অবস্থান দেখেই পথের সমস্ত ক্লান্তি, সমস্ত রাগ এক লহমায় দূর হয়ে গেল। খরস্রোতা ছোটা রঙ্গিত নদী কটেজের গা ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে। বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিলেই মনে হচ্ছে নদী আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এই হল বিজনবাড়ি। এই হল এখানকার ব্যাম্বু রিসর্টের সৌন্দর্য। 

দারুণ সুন্দর ছবির মতো একটি জায়গা। আর সেখানেই খুব সুন্দর থাকার জায়গা ব্যাম্বু রিসর্ট।

কিছুক্ষণ আগেও মহাবিরক্তি এসে গিয়েছিল। পাচেং থেকে রওনা হয়েছি সাড়ে দশটায়। মাত্র ৩২ কিলোমিটার রাস্তা। ভেবেছিলাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাব বিজনবাড়ি। কিন্তু কোথায় কী! পাক্কা তিন ঘণ্টা লাগল।

ঘুম থেকে বাঁ দিকে সুখিয়াপোখরির দিকে কিলোমিটার খানেক গিয়ে ডান দিকে বিজনবাড়ির রাস্তা ধরলাম। রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। যত নীচে নামছি, ততই উধাও হয়ে যাচ্ছে রাস্তা। তার বদলে দখল নিচ্ছে কাদা। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিচ্ছে বর্ষাকাল। গাড়ির চাকা সেই কাদায় মাঝেমধ্যে ফেঁসেও যাচ্ছে।

এ ভাবেই নেমে এলাম অনেক নীচে। সমুদ্রতল থেকে মাত্র আড়াই হাজার ফুট উচ্চতা। ছোটা রঙ্গিত নদীর ওপরে একটি ব্রিজ পেরিয়েই ঢুকে গেলাম বিজনবাড়ি।

ছোট্ট এবং ঘিঞ্জি শহর এই বিজনবাড়ি। তাকে পেরিয়ে ছোটা রঙ্গিতের ধার ধরে কিছুটা এগিয়েই এসে পৌঁছোলাম এই রিসর্টে।

বিজনবাড়িকে দেখলে মনে হয় কিছুটা অবহেলিত। পর্যটন মানচিত্রে খুব বেশি দিন এর আগমন হয়নি। তবে জায়গাটা এক কথায় অসামান্য। 

বলতে গেলে, রিসর্টের ক্যাম্পাসের মধ্যে দিয়েই বয়ে চলেছে ছোটা রঙ্গিত। অপার নির্জনতা ভেদ করে বয়ে আসছে সে। প্রথম দর্শনে মুগ্ধ এখানে হতেই হবে। সমস্ত ক্লান্তি এবং শহুরে ব্যস্ততাকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে।

এই নদীটার নাম জেনেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। একটি টিভি কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রশ্ন ছিল, “দার্জিলিংয়ের নীচ দিয়ে যে নদী বয়ে যাচ্ছে, তার নাম কী?” প্রতিযোগী সঠিক উত্তর দিয়েই বলেছিলেন ‘ছোটা রঙ্গিত।’

এর পর বেশ কয়েক বার দার্জিলিং এলেও ছোটা রঙ্গিত দেখার সুযোগ হয়নি। সেই সুযোগটাই এখন এসে গেল। দার্জিলিং শহরটা এখান থেকে অত্যন্ত কাছে। মাত্র ২২ কিলোমিটার।

কম উচ্চতার কারণে এখানে গরমও রয়েছে ভালোই। ঘরে পাখা চলছে বনবন করে। আরামকেদারায় গা এলিয়ে ঘরের ভেতর থেকেই দেখতে থাকলাম নদীটাকে।

ক্লান্তিহীন ভাবে প্রবল গর্জন সহকারে ওপর থেকে বয়ে আসছে সে। ভেসে চলে যাচ্ছে আরও নীচে, জোরথাংয়ের দিকে যেখানে রঙ্গিতের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে।

এখানে বলে রাখা ভালো যে রঙ্গিত আর ছোটা রঙ্গিত কিন্তু এক নদী নয়। তিস্তাবাজারের কাছে ‘ত্রিবেণী সংগম’ অঞ্চলে তিস্তার সঙ্গে যে নদীটার সংগম হয়েছে সে রঙ্গিত। সে আসছে সিকিম থেকে। আর এই ছোটা রঙ্গিত আসছে নেপালের দিক থেকে। এর দৈর্ঘ্য বেশি নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও গোটা বিজনবাড়ির প্রাণ এই ছোটা রঙ্গিত।

ঘরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি খরস্রোতা নদী দেখতে দেখতেই দুপুরটা কেটে গেল অবলীলায়।

বিকেলে রিসর্টের চৌহদ্দিতেই হাঁটাহাঁটি। বেশ অনেকটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রিসর্টের কটেজগুলো। দু’খানে সুইমিং পুলও রয়েছে। পাচেংয়ের মতো এখানেও সবুজের সমারোহ। তবে উচ্চতা কম বলে বৃষ্টি নেই। ওপরের পাহাড়ের গায়ে লেপটে রয়েছে বর্ষার মেঘ।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই নদীর গর্জন যেন আরও বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে রিসর্টের নদী লাগোয়া রেস্তোরাঁয় গরম চা আর পকোড়ার সঙ্গে জমে ওঠে আমাদের আড্ডা।

কিছুক্ষণ পরেই পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে চাঁদ। তিন দিন পরেই পূর্ণিমা। তার জ্যোৎস্নায় যেন নিজেকে আরও মেলে ধরে ছোটা রঙ্গিত।

বৃষ্টিমাখা ভোরে ঘুম ভাঙতেই চমকে যাই ছোটা রঙ্গিতকে দেখে। গর্জন আরও বাড়িয়ে ভয়াল রূপ নিয়েছে সে। আগের দিন যে পাথরগুলো বেরিয়ে ছিল, সব এখন জলের তলায় চলে গিয়েছে। কিছুটা হতচকিত হয়ে যাই।

বর্ষার নদীর জল বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি একটা থাকেই। এই জল কোনো ভাবে রিসর্টের ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়বে কি না সেই খোঁজ নিই কর্মীদের কাছে। ওঁরা আশ্বস্ত করেন, বেলা বাড়লেই নদী জল আপসে কমে যাবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি থামল। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সূর্য। অদ্ভুত ভাবে ছোটা রঙ্গিতও কিছুটা শান্ত হয়ে গেল। ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়তে লাগল পাথরগুলো।

বিজনবাড়ির এই রিসর্ট মানেই খালি বিশ্রাম আর হাঁটাহাঁটি। একটা দিন বাঁধা গতের কোনো সাইটসিয়িং না করে স্রেফ বিশ্রামে কাটিয়ে দিতেও যে কী ভালো লাগে, সেটা বোঝা যায় এই রিসর্টে এসেই। 

এখানে নেই দূষণ, আওয়াজ ও বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। পাহাড়ের নির্জন, শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশে দু’-তিন দিন অনায়াসেই কেটে যাবে। সঙ্গে অপরূপ দৃশ্যপট একদম ফ্রি।

এই দৃশ্যপটেই মুগ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়ি, প্রাতরাশ সেরে। রিসর্টের সামনেই একটা কংক্রিটের ছোটো সেতু। মাইলফলকে লেখা আছে এই সেতু তৈরির বছর – ২০০৩। সেতুর মাঝখানে দাঁড়ালে বহমান ছোটা রঙ্গিতকে দুর্দান্ত ভাবে উপভোগ করা যাবে। যতটা চোখ যাবে, দেখা যাবে ও দুরন্ত শিশুর মতো ছুটে আসছে। 

সেতু পেরিয়ে ওপরে উঠি। একটা ছোট্ট গ্রাম। বাসিন্দারা নিজেদের মতো করে কাজকর্মে নেমে পড়েছেন। গ্রামটার সঙ্গে লেপটে রয়েছে চা-বাগান। সকালবেলায় এই চা-বাগানের ব্যস্ততাও রয়েছে। পাতা তোলার কাজে নেমে পড়েছেন গ্রামের মহিলারা। হাঁটতে থাকি উদ্দেশ্যহীন ভাবে। রাস্তা খাড়াই নয়। নদীর ও পারে আমাদের রিসর্টটাকে দেখতে অসাধারণ লাগছে।

ছোটা রঙ্গিতের ভরসাতেই এখানকার জীবন চলছে। কারও বাড়িতে জলের চাহিদা মেটাচ্ছে সে। কেউ কেউ আবার তার বুকে নামছে পাথর ভাঙতে। এই পাথর ভাঙলে কিছু টাকাপয়সা রোজগার হবে।

কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এখান থেকেও পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার বদলে যে সবুজ রয়েছে, যে খরস্রোতা নদীটা রয়েছে তা আপনার মন ভুলিয়ে দেবে।

বেশ কিছুটা হাঁটাহাঁটি করে ফিরে আসি রিসর্টে। নদীতে জল এখন বেশ কম, তাই তার জলে পা ডোবানোর জন্য কিছুটা নামি। একটা পাথরের ওপরে বসে পা ডুবিয়ে দিই জলে। কনকনে ঠান্ডা জল উপভোগ করতে বেশ লাগে।

তবে জল বেশি থাকলে নদীতে নামা উচিত নয়। তা হলে পাথর দেখা যাবে যা, যেটা বেশ কিছুটা ঝুঁকির হয়ে যেতে পারে। এমনিতে শীতকালে এলে অবশ্য নদীতে নামা নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত নয়, তখন নেমে যাওয়াই শ্রেয়। বর্ষাতেই সাবধানতা দরকার।

এর পর বাকি দিনটা ছোটা রঙ্গিতের কাছে উৎসর্গ করি নিজেকে। পাহাড়ি কোনো নদীকে এত কাছ থেকে উপভোগ করার সুযোগ খুব একটা পাই না আমরা। সেই সুযোগটাই কিন্তু বিজনবাড়ির এই ব্যাম্বু রিসর্ট করে দিচ্ছে।

ইস, আমার বাড়িটা যদি এখানেই কোথাও একটা হত, তা হলে কী ভালোই না হত! নদীকে দেখতে দেখতে কেটে যেত গোটা দিন। নদীর যেমন ক্লান্তি নেই, তেমনই আমারও কোনো ক্লান্তি আসত না জীবনে।

অবশ্য এখানে বাড়ি হলে কি ভ্রামণিক হতে পারতাম? আমার নিজের রাজ্য, নিজের দেশকে কি ঘুরে দেখার সুযোগ পেতাম? কালকেই যে নতুন একটা জায়গায় যাব, সে সুযোগটাও কি আসত আমার কাছে?

বিজনবাড়িতে থাকা

বিজনবাড়ির ব্যাম্বু রিসর্টে রাত্রিবাসের যাবতীয় আয়োজন করে দিতে পারে ট্র্যাভেলিজম (Travelism)। যোগাযোগ করুন: 8276008189 অথবা 9903763296 নম্বরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *