করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/৯: ব্রহ্মকুণ্ডের ব্রিজে দাঁড়িয়ে এক দিগম্বর জৈন মুনি

অশোককুমার কুণ্ডু

আমারই দুর্ভাগ্য। বরফানি কুম্ভ, হরির দুয়ারে পূর্ণকুম্ভ, মায়াপুরীর পূর্ণকুম্ভ আমার মনে যে দগদগে ঘা দিয়েছিল, তা আজও মনে পড়ে যায়। বেদনা হয় বই-কি! ১৯৯৮ সালে বিংশ শতাব্দীর শেষ পূর্ণকুম্ভে অধ্যাত্মবাদীদের রক্তাক্ত লড়াই। তার স্মৃতি এখনও টাটকা। ২০১০ সালে, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম পূর্ণকুম্ভে, শেষ শাহিস্নানের দিনই সকালে ঘটেছিল দুর্ঘটনা। এক শিশু-সহ পাঁচ জনের মৃত্যু পদপিষ্ট হয়ে। লালতারা সেতুর রেলিং ভেঙে অন্তত জনা ছয়েকের গঙ্গাপ্রাপ্তি। আহত কত কে জানে। আবার এই বছরে বিশ্বভুখ, ‘সুপারস্প্রেডার’ করোনা-আক্রান্ত পূর্ণকুম্ভ চলাকালীন একাধিক সন্ন্যাসীর মৃত্যু। কুম্ভ চলাকালীন একাধিক আখাড়ায় করোনা বাসা বেঁধেছে সন্ন্যাসীদের হেঁশেলে। খুব কাছে থেকেই এ সবের সাক্ষী থেকেছি।

পুণ্যক্ষেত্রে ধর্মীয় লড়াই

কুম্ভমেলার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, পুণ্যস্নানকে কেন্দ্র করে শৈব্য বনাম বৈষ্ণব লড়াই সর্বাধিক ঘটেছে এই হরিদ্বারের পুণ্যক্ষেত্রে। মঠ বনাম আখাড়ার লড়াই। এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হল, নাগাবাবারা তথা নাঙ্গাবাবারা (ফৌজ) পরস্পর লড়েছেন হিন্দু-হিন্দু বা হিন্দু-মুসলমান বাদশাদের ভাড়াটে সৈন্য হয়ে। রাজা-বাদশারা হাজার প্রজা ও সাতগুষ্টি নিয়ে পুণ্যস্নানে এসে ক্ষমতা দেখাতেন সে যুগে। ওই একই অধিকারবোধ – কে আগে পুণ্যস্নানে ডুব দেবেন। পুণ্য নয়। ত্যাগ নয়। স্রেফ রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন। লড়াইয়ে মারা যেতেন নাগা ফৌজ এবং পুণ্যকামী পদাতিক আমজনতা। হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে স্নানমেলা আমার কাছে পুণ্যের হলেও তা শঙ্কার। পুণ্যস্নান ও সংঘাত যেন যমজ।

এ বছর কোভিড-কুম্ভ আরও বেশি শঙ্কার। ইতিমধ্যে মৃত্যুর খবর পাচ্ছি হৃষীকেশ এবং হরিদ্বার-কনখল থেকে। আর যাঁরা স্নান করে ফিরে যাবেন? তাঁরা ভালো থাকুন, এই প্রার্থনা। আমাকেও সুস্থ শরীরে ঘরে ফিরতে হবে। কথা দিয়েছি পরমাত্মীয় ধর্মাশোককে। ফিরতেই হবে। কুম্ভের ওপর বইটি শেষ করতে হবে। ‘আর নাই রে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে…’।

করোনা-আক্রান্ত কুম্ভমেলার স্নান কত দিন চলবে, তা নিয়ে আমাদের ভারতীয় হিন্দু ধর্মগুরুরা যে ভাষ্য, ‘প্রবচন’ দিচ্ছেন এবং (অফ দ্য রেকর্ডে) আমায় যা বলেছেন, পরস্পরের প্রতি যে হলাহল-মিশ্রিত ক্রোধ উগরে দিয়েছেন, তা কল্পনাতীত বিরক্তির। আসলে এ সব ক্ষোভ, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষের সঙ্গে মিশে আছে বস্তু প্রাপ্তি – যা ধর্মগুরুরা স্বীকার করবেন না। বস্তুপ্রাপ্তি নিয়ে যেমন ভাইয়ে ভাইয়ে লাঠালাঠি, মামলা ইত্যাদি ঘটে। একই চিত্র একটু ভিন্ন রঙে, ত্যাগের প্রতীক-বর্ণ গৈরিকেও মেলে। তা না হলে, কোন দর্শন, কোন বিশ্বাস থেকে এক আখাড়া থেকে আপাত তেরো আখাড়া? এবং বৈষ্ণব পরম্পরায় এক থেকে চার প্রধান সম্প্রদায়? অবশ্য আদিগুরু শংকরাচার্যের অদ্বৈতবাদকে চ্যালেঞ্জ করে আরও চার বিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত, বিষ্ণু উপাসকদের।

কত বার নিজেকে প্রশ্ন করেও উত্তর মেলেনি। বস্তুবাদ, সংসার পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়ে কোর্টে আসা-যাওয়া! আখাড়া-মঠ-মিশনের কত শত মামলা! হরিদ্বারেই দেখতাম একটি স্থল বাল্মীকি চৌক পেরিয়ে, আগেকার কোর্টপাড়া। একাধিক ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসী মামলার আবেদন টাইপ করাচ্ছেন। হয়তো এটাই বিধিলিপি। এই জীবন তাঁদের ‘নয়া’ সংসার। অবশ্য মঠ-মিশনের বস্তুসম্পদ না বাড়ালে, না বাঁচালে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বাঁচে না।

শিমূল ফুল আর পদ্মের শিকড়ের চপ, সঙ্গে রাবড়ি

“আরে তুমিও পড়লে এ সব গাড্ডায়? অত বিচারে বসলে চিনির সোয়াদ পাবে না। ‘মুলো খেলে মুলোর গন্ধ বেরোয় গা থেকে’। মনে জিজ্ঞাসার এত বস্তা চাপালে তুমি বিদ্ধ হবে। চলো বিষ্ণুঘাটের চৌমাথার ছোট্ট গুমটিতে। শিমূল ফুলের কুঁড়ি-ফুল আর পদ্মের শিকড়ের গরমাগরম চপ খাব দুই বন্ধুতে। চপের পরে, একটু পরেই ঘণ্টাওয়ালির, তোমার পুরোনো বন্ধুর দোকানের রাবড়ি। চপের অম্বল চাপা দেবে ওই রাবড়ি”, বলল আমার পরমাত্মীয় ধর্মাশোক।

ঝোলা ব্যাগে টান দিয়ে আমার মনের ভার কাটাল ধর্মাশোক। বাস্তবিকই সে লাঘব করল আমার মাথার ভার। হরিদ্বারের চুটকিওয়ালার (ছোট্ট টিকি, ভুঁড়িওয়ালা ব্রাহ্মণ) হোটেলের খাবার আজও বিখ্যাত। চললাম ধর্মাশোকের পিছূ পিছু। আমাকে চিনতে পারলেন ঘণ্টাওয়ালি। সামনে ঝুলছে বড়ো পিতলের ঘণ্টা। বাজাল। বলল, “দাদাশ্রী, কলকাতে বাবু কব আয়া কুম্ভে?” ঘণ্টা বাজিয়েই খদ্দের ডাকেন রাবড়িবালা।

আমায় রাবড়ির গামলায় বসিয়ে রেখে ধর্মাশোক চলে গেল। নির্দেশ দিল, ফিরবে তুরন্ত। ফিরবেই জানি। মৃদু হাসিই তার সংকেত। এবং আমার জন্য নিয়ে আসবে, নিশ্চিত আনবে কড়া পাকের সন্দেশ। সন্দেশ শব্দের এখানে অর্থ হল সুসংবাদ। এবং তা সংবাদপত্রের পরিভাষায় হিউম্যান ইন্টারেস্ট স্টোরি। আজকাল যাকে বলা হচ্ছে, ‘কালার কপি’। যার মনযোগী পাঠক আমি নিজেও। বর্তমানে মুদ্রিত সংবাদপত্রের জগতে বা বৈদ্যুতিন মিডিয়ায় অধিক রক্তাক্ত পৃষ্ঠা, রাজনৈতিক কামড়াকামড়ির দুর্গন্ধ উদ্‌গারে ভিজে যায় ড্রয়িং রুম, ছোটো পর্দা, খাট-বিছানা ও রুচি। তবুও আমরা তা-ই দেখি। আমরা ক্রেতা। সাংবাদিকরা বিক্রেতা। ধর্মাশোকের ফেরার আশায়, ওর সুসন্দেশের আশায় বসে থেকে পা ঝিমঝিম।

‘একটু আসছি’, ঘণ্টাওয়ালিকে বললাম। যাচ্ছি পাঁচ মিনিট দূরত্বে কুশঘাটে পারলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ডের কান্ডারি পণ্ডিত নরেন্দ্র শর্মাজি এবং পণ্ডিত রামকুমার শাস্ত্রীজির গদিতে। নিজের শ্রাদ্ধটা আজ নিজেই করাব। নিজের পিণ্ডি আপন হাতে চটকাব। কুশঘাটের ওই স্থল শ্রাদ্ধ-পিণ্ডদান খ্যাত। এই করোনার বাজারেও এক দল শোকার্ত পরিবার কোভিড ১৯-এর দ্বিতীয় পর্বে সমস্ত বিধি ভেঙে, দুমড়ে, মুছে, আওড়াচ্ছেন নমঃ বিষ্ণু… এতে গন্ধে পুষ্পে ওঁ জলনারায়ণায় নমঃ’। পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের গাদ, বর্জ্য সব হাতের কাছেই স্রোতময়ী গঙ্গার সর্বাঙ্গে ঢালছে। পাকা শেডের নীচে একাধিক দল শ্রাদ্ধকর্মে ব্যস্ত। করোনা আপাতত ‘ফরিনার’। হিন্দুধর্মের এই সব কাণ্ডকারখানা দেখে ভয়ে আসতেই পারবে না। সামান্য দূরে, ওই তো গঙ্গার পুব পাড়ে স্বর্গ দেখা যায়। কুশঘাটে সবৎসা গাভীও আছে। তার লেজ ঘটির জলে ডুবিয়ে বৈতরণি পার। বৈতরণি পার হতে চায় উপস্থিত একাধিক পরিবার। সবৎসা গাভীমাতার জেরক্স চলবে? জয় তারা মা!

এখনও কত কাজ বাকি

কত কত কাজ বাকি। দেহরাদুনে বাড়ি করে বসে আছেন এবিপি (আনন্দবাজার) গ্রুপের ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ ডেলির প্রাক্তন চিফ রিপোর্টার নান্টুদা। এ বারেও দেখা হবে না। দু’ জনেরই যা বয়স বেড়েছে, ভবিষ্যতে আর কি কখনও দেখা হবে? প্রণাম জানাতে যেতে হবে কনখলে, ‘আনন্দময়ীর মা’-এর আশ্রমে। কত আদরযত্ন পেয়েছি ওখানে। আশ্রমের গুরুত্বপূর্ণ প্রাক্তন কর্মী পানুদা প্রয়াত।

আপার রোডে থানার কাছে, প্রিয় আমার, গৌড়ীয় বৈষ্ণব আশ্রমে যেতে হবে। আসলে সঠিক নাম সারস্বত গৌড়ীয় মঠ – শতবর্ষ পেরিয়ে এক যুগ হল। ওখানে আছেন পরম বৈষ্ণব সনাতনদাসজি। এখানে মিষ্টি ডাল দিয়ে নিম-বেগুন পরম উপাদেয়। সুখীনালার কাছে জৈন মন্দির। ওর কাছাকাছি লোকনাথবাবার গঙ্গাঘাটে বসে অখণ্ড নীরবতা খুঁজব। কনখলের পথে ওঁকারনাথজির আশ্রম। অত বড়ো সংস্কৃত পণ্ডিত! জ্ঞান–ভাষা-দর্শন মিলিয়েছিলেন মহামিলন মঠে। যেতে হবে কনখলে, পাইলটবাবার আশ্রমে। ওখানে আমার জন্য অপেক্ষায় থাকবেন শ্রীনীলকণ্ঠানন্দ গিরিজি। উনি বারে বারে কলকাতার টুপি আনতে বলেন। টুপির সঙ্গে ব্রাহ্মণ-দক্ষিণা বড়ো গামছা, পাঞ্জাবি – সবই গৈরিক। সন্ন্যাসী মানুষ। যাবার সময় কিছুটা গৈরিক রঙের ফল? পাব কি কিনতে?

ঘরে ফেরার আগে ভোলাগিরি আশ্রমের সাইকেল মহারাজের সঙ্গে বিদায়-সাক্ষাৎ। যিনি সাইকেলে হরিদ্বার চক্কর দেন। পরনে, নিম্নাঙ্গে একটা গৈরিক গামছা এবং হরিদ্বারে, বিস্ময়ের বিস্ময়, বারো মাস নগ্ন গাত্র। যোগগুরু বাবা রামদেব ওঁকে দেখলে চমকে যাবেন। নমস্কার জানাতে হবে ওখানকার সহকারী সম্পাদক সুপ্রকাশানন্দ গিরিজি মহারাজকে। কনখলের হরিহর আশ্রমেই এখন অস্থায়ী ভাবে আছেন জুনা আখাড়ার পীঠাধীশ্বর, মহামণ্ডলেশ্বর স্বামী অত্তধেশানন্দ গিরিজি। উনি ওঁর আশ্রমের পত্রিকা পাঠান আমাকে, নিয়মিত। এমন কোনো কুম্ভমেলায় আসিনি, যে বার অত্তধেশানন্দজিকে নমস্কার করতে যাইনি।

এ দিকে খবর পেলাম শ্রীনিরঞ্জনী আখাড়া করোনা-কুম্ভের ‘প্রতিমা’ নিরঞ্জন ঘোষণা করে বিজয়ার মিষ্টি বিলোচ্ছেন। তা-ই শুনে শ্রীনির্বাণী অনির মহান্ত ধর্মদাসজি ক্রোধিত স্বরে, কে বট হে আপুনি? মেলার সমাপ্তি ঘোষণার অধিকারী সরকারি আধিকারিক। এ দিকে জুনার সর্বোচ্চ পদাধিকারী অত্তধেশানন্দজি আদরণীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীজির স্বকণ্ঠের অনুরোধ মেনে, সমুদ্রমন্থনের হর কি পৌড়ীতে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গেয়ে দিয়েছেন।

এক দাবড়ানিতে চমকে উঠলাম। উদ্বেগ নিয়ে দেখি সুসন্দেশ-সমাচার এনেছে বন্ধুবর ধর্মাশোক। প্রথম চটকায় খুব বকল। তার পর দু’টি মুখ্য সংবাদ শোনাল। নাগাবাবারা ছোট্ট ঝোলা স্বহস্তে বুনে থাকেন। এটি আর্ট পিস, রঙিন সুতো (আজকাল উল) দিয়ে বোনা। অপূর্ব। নাম ততোধিক সুন্দর, ‘অলখঝুলি’। গাঁজায় কম পড়লে বাবারা অতিরিক্ত ঝুলি বেচে দেন। হরিদ্বারেই মেলে। ধর্মাশোক জানাল, একটি দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, দাম প্রতি পিস ৬০০।

আর একটি সুসংবাদ। আমার কুম্ভ ঘোরার জীবনে তা প্রথম ঘটতে চলেছে। দিগম্বর জৈন মুনি, একজনই, ব্রহ্মকুণ্ডের ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছেন। জনতার স্নান দেখছেন। কোনো কুম্ভেই এঁদের দেখা পাইনি। জয় পার্শ্বনাথ। একটু পা চালিয়ে ভাই, ধর্মাশোক। (চলবে)    

আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন                        

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *