বেলুর-হালেবিডু-বেলাওয়াড়ি: পাথর যেখানে কথা বলে

শ্রয়ণ সেন

বৃষ্টি ভেজা মোরামের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছি। গ্রামটার নাম বেলাওয়াড়ি। গ্রামের একদম শেষপ্রান্তে বীরনারায়ণ মন্দির। পেছনে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে পশ্চিমঘাটের সুবিশাল পর্বতমালা। পাহাড়ের মাথাগুলো বৃষ্টির মেঘে ঢাকা।

গাড়ি থেকে নামতেই গ্রামবাসীদের কৌতূহলী চোখ নজর কাড়ল। আমাদের তিন জনকে ওঁরা এমন ভাবে দেখছেন যেন মনে হচ্ছে বাইরের পর্যটকদের ওঁরা কখনও দেখেননি। আন্দাজটা যে ভুল ছিল না, সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারলাম প্রশান্তের কথায়। প্রশান্ত এই মন্দিরের পূজারি। ইংরেজিতে চোস্ত কমবয়সি এই পূজারি আমাদের জানালেন যে এই মন্দির দেখতে বাইরের পর্যটকরা খুব বেশি আসেন না।

আমরাও হয়তো আসতাম না যদি না সকালে বেলুরের চেন্নাকেশব মন্দিরের গাইড রমেশ আমাদের এই মন্দিরের সন্ধান দিতেন। আমাদের ঘুরিয়ে দেখানোর সময় রমেশ বলেছিলেন, “আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে স্বল্পচেনা জায়গাগুলোয় ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। তা হলে একবার বেলাওয়াড়ির বীরনারায়ণ মন্দির থেকে ঘুরে আসুন।”

একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া হোয়সল সাম্রাজ্য বিখ্যাত তার মন্দির স্থাপত্যের জন্য। কর্নাটকের হাসন জেলায় অবস্থিত বেলুর, হালেবিদু আর বেলাওয়াড়ি এবং মহিশূরের কাছে অবস্থিত সোমনাথপুরের মন্দিরগুলি হোয়সল স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

মন্দিরগুলো দর্শন করলে মনে হবে এখানে পাথর যেন কথা বলছে। চারটে মন্দিরই প্রাণের মতো প্রস্ফুটিত। ঠিক সেই কারণেই সব ক’টা মন্দিরই নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল একশো বছরেরও বেশি।

হোয়সল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয় ১০০৬ সালে। এই রাজবংশের প্রথম রাজধানী ছিল দ্বারসমুদ্র, যা এখনকার হালেবিডু। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা বিষ্ণুবর্ধন। তিনি তাঁর রাজধানী হালেবিডু থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের বেলুরে (বেলুড় নয়) সরিয়ে আনার পর এখানে প্রথম মন্দিরটি তৈরি করার নির্দেশ দেন।

১১১৬ সালে বেলুরের চেন্নাকেশব মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১২১৯ সালে শেষ হয় কাজ। অর্থাৎ ১০৩ বছর লেগেছিল এই মন্দির তৈরি করতে। তিন প্রজন্ম লেগেছিল এই মন্দির নির্মাণে।

কেন এত সময় লেগেছিল, তা অবশ্য মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়। পাথরের ভাস্কর্যে পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে রাজসভার দৃশ্য, যুদ্ধজয়ের উল্লাস, সমাজজীবনের নানা উচ্ছ্বাস প্রতিফলিত। অপূর্ব কারুকাজ, সব কিছুই পাথর কেটে।

আপনি মোহিত হয়ে দেখবেন মন্দিরের ভাস্কর্য। ঠিক এই ভাবেই মোহিত হয়েছিলেন ইরানি পর্যটক আব্দুর রাজাক। ১৪৩৩ সালে এই মন্দির ঘুরে তিনি বলেছিলেন, “যা কিছু লিখবেন, লোকে অতিশয়োক্তি বলবে।”

চেন্নাকেশব মন্দির দর্শন শেষে হালেবিডুর হোয়সলেশ্বর মন্দির চত্বরে এসে মনে হল কারুকার্যে কেউ কারও থেকে কম যায় না। এটা হোয়সল সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ মন্দির। এই মন্দিরের দুটো অংশ, হোয়সলেশ্বর এবং সান্তালেশ্বর। দু’ জনেই শিব। বেলুরের মন্দিরের আরাধ্যা দেবতা কৃষ্ণ, এখানে শিব।

মন্দিরের বাইরে গোটা দেওয়ালে হিন্দু দেবদেবীদের ২৮০টি মূর্তি খোদিত। পাথরে খোদাই করা রয়েছে স্বর্গের দেবসভা।সত্যি কথা বলতে কী, এই মন্দিরগুলোয় এলে আপনি আধ্যাত্মিকতা ভুলে নজর দেবেন শুধুমাত্র মন্দিরে কারুকাজে। এত সূক্ষ কাজকর্ম এই হোয়সল সাম্রাজ্যের মন্দিরগুলোর বাইরে সম্ভবত আর নেই।

হালেবিডুর মন্দির দর্শন করে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে এসে পৌঁছোলাম বেলাওয়াড়ির বীরনারায়ণ মন্দিরে। আমাদের দেখেই এগিয়ে এলেন প্রশান্ত। কলকাতা থেকে এসেছি শুনে প্রচণ্ড খুশি হলেন। তার পর ঘুরিয়ে দেখালেন গোটা মন্দিরটা।

বেলুর আর হালেবিডুর জনপ্রিয়তার কাছে অনেকটাই আড়ালে পড়ে রয়েছে এই মন্দিরটা। কেন এই মন্দিরের প্রচার নেই, বুঝতে পারিনি। প্রচার সে ভাবে নেই বলে এর ইতিহাসটা পুরোটা জানাও যায় না। তবে যেটা জানা যায় যে বেলুর আর হালেবিদুর মন্দিরের মতো এটাও দ্বাদশ শতকেই তৈরি।

এই মন্দিরে তিন দিকে পূজিত হচ্ছেন তিন দেবতা, যথাক্রমে বীরনারায়ণ, বেণুগোপাল এবং যোগ নরসিংহ। এই মন্দিরের চূড়া আছে যা বাকি দুটি মন্দিরে নেই।

প্রশান্তের থেকেই সুন্দর একটা তথ্য পেলাম। বেলুরের চেন্নাকেশব মন্দিরের ভীতের ওপরে একজন দেবতা। তাই সেই মন্দির ‘এককূট।’ হালেবিডুতে দুই দেবতা, তাই সেটা ‘দ্বিকূট।’ আর এই মন্দিরে যে হেতু তিন দেবতা, তাই এটা ‘ত্রিকূট।’

বীরনারায়ণ মন্দিরেও পাথরের কারুকাজ বেলুর আর হালেবিডুর মন্দিরের মতোই সুন্দর। আদতে এই তিনটে মন্দিরই সোপস্টোন দিয়ে নির্মিত। এর জন্যই মন্দিরগাত্রে এত সূক্ষ্ম কাজ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।

এক এক সময় ভেবে পাচ্ছিলাম না যে সারা দিনে যে তিনটে মন্দির দেখলাম, তাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দর! পরক্ষণেই ভাবলাম কী দরকার এই তুলনা টেনে, এই তিন মন্দিরই সৌন্দর্যের দিক থেকে একে অপরের পরিপূরক।

প্রশান্তকে বিদায় জানিয়ে বেলুর ফেরার পথ ধরলাম, সেখানেই আমাদের রাত্রিবাস। আজ গোটা দিনটা স্বপ্নের মতো কাটল যেন। পাথর খোদাই করে যে ভাবে তাদের প্রায় জীবন্ত রূপ দেওয়া হয়েছে সেটা কল্পনা করেই শিহরিত হতে হয়। আধুনিক কোনো প্রযুক্তি ছিল না, তবুও আজ থেকে হাজার বছর আগে শিল্পীরা এমন অসাধ্য সাধন করলেন কী ভাবে? ভাবতে থাকি, উত্তর পাই না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *