ধোতরে বনবস্তিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার সান্নিধ্যে

Kanchenjunga, Dhotrey
ধোতরে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা।

সায়ন্তন ধর

ভিউ পয়েন্টটা ঠিক কোথায় বলুন তো? ঠিক এই কথাটা শুনেই যেন ঘুম ভেঙে গেল। প্রতি দিনের মতো ফেসবুকটা খুলে একটু দেখে নিচ্ছি। এমন সময় চোখে পড়ল সদ্যপরিচিত শ্রয়ণদাদার একটা পোস্ট। ও ছোট্ট সফরে ছুঁয়ে যাবে সিটং আর ধোতরে।

ধোতরে আমার বড়ো প্রিয় জায়গা। এর আগে ধোতরের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল টুমলিং-এ গিয়ে। প্রাক-বর্ষায় অফিসিয়াল কাজে গিয়েছিলাম। কিন্তু সীমানা সংক্রান্ত অজ্ঞতার কারণে আমাদের যাত্রাপথে ভারতীয় গ্রাম সে ভাবে পাচ্ছিলাম না। তখন একজন পরামর্শ দিলেন টুমলিং থেকে ২.৮ কিমি দূরত্বের টংলুতে গিয়ে সেখান থেকে ছয় কিলোমিটার উতরাই পথে ট্রেকিং করলেই ধোতরে বনবস্তি মিলবে। মাত্র আশিটি পরিবারের বাস সেখানে। সে ভাবেই প্রথম ধোতরেকে চেনা।

ধোতরে থেকে রাতের দৃশ্য।

সে বারই ভিউ পয়েন্ট খুঁজতে বেরিয়ে আরও একদল পর্যটকের কাছে এই প্রশ্নটি শুনেছিলাম। এর পরেও একটি হিমশীতল সন্ধ্যা কাটিয়েছি এখানে। আবার নভেম্বরের হিমেল আমেজ নিতে ও দাদার সঙ্গে দেখা করার জন্য সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করলাম। আর সেখানে যাওয়ার অজুহাত হিসাবে কিছু অফিসিয়াল কাজও জুটিয়ে নিলাম।

সকাল সকাল তিস্তাপাড়ের জলপাইগুড়ি থেকে বাসে করে শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস। সেখান থেকে দার্জিলিং মোড়ে যেতে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম। মাত্র ১.৩ কিমি যেতে টোটো চাইছে ১০০ টাকা। বুঝলাম আমার সাথে ট্রলি ব্যাগ আমাকে এক লহমায় রাজধানীর নাগরিক বানিয়ে দিয়েছে। এ দিকে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে এটা আমার ডেলি প্যাসেঞ্জারির রুট ছিল। বাগডোগরাগামী লোকাল বাসে চড়ে বসলাম। গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে।

যাই হোক শিলিগুড়ি থেকে ধোতরে, রিম্বিক, শ্রীখোলা হয়ে রাম্মাম পর্যন্ত শেয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের মূল কান্ডারি হল সিনগো নেটওয়ার্কের তিনটি গাড়ি। তার মধ্যে একটা সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে শিলিগুড়ি ছেড়ে যায়। অন্যটি শিলিগুড়িতে সাড়ে দশটা-এগারোটায় পৌঁছে সাড়ে এগারোটা নাগাদ রওনা দেয় ধোতরের উদ্দেশে। এ দিকে অত দেরিতে রওনা দিলে ধোতরে পৌঁছোতে পৌঁছোতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই ব্রেক জার্নির মাধ্যমে শিলিগুড়ি থেকে মিরিক, মিরিক থেকে সুখিয়াপোখরি, আর সেখান থেকে মানেভঞ্জনে এলাম। সারলাম কিছু অফিসিয়াল কাজ।

সকাল হচ্ছে।

সিংগো নেটওয়ার্কের এই গাড়িগুলোর সাথে প্রথম ধোতরে সফর থেকেই আমার পরিচয়। ভীষণ ভদ্র ও হেল্পফুল হওয়ায় ধোতরে গেলে আমার একমাত্র ভরসা ওরাই। মানেভঞ্জনে এসে ওরা ফোন করে ডেকে নিল আমাকে। ওখানেই একসাথে লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়লাম। সূর্য তখন পাহাড়ের ওপারে চলে গেছে। দিনের আলো থাকলেও গহীন অরণ্যের মাঝে রাত নেমে এসেছে।

বিশ্বকাপ চলছে। পাহাড়ে ফুটবল একটা আলাদা মাত্রার উত্তেজনা এনে দেয়। প্রতিটি গাড়িতেই প্রিয় দলের ফ্ল্যাগ। সুমন অর্থাৎ এই টাটাসুমো গাড়ির চালকের প্রিয় টিম আর্জেন্তিনা। একটা বড়ো পতাকা পত পত করে উড়ছে গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। হিন্দি ও নেপালিতে একের পর এক হিট গান বাজছে বেশ জোরে। পরিচয় হল রাম্মাম-নিবাসী নির্মল রাই-এর সঙ্গে। রাম্মাম ঘোরার নিমন্ত্রণও পেয়ে গেলাম।

সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় ধোতরে পৌঁছে শেরপা লজে রুম নিয়ে নিলাম। বাড়িতে পৌঁছোনো সংবাদ দিয়ে শ্রয়ণদাদাকে ফোন করলাম। ফোনের রিংটোনই জানিয়ে দিলো ওরা আছে ঠিক আমার রুমের ওপরের রুমে। দাদা বেরিয়ে এল। এই প্রথম দেখা আমাদের, কিন্তু যেন কত কালের চেনা। একে একে পরিচিত হলাম দাদার পুরো টিমের সঙ্গে। দাদার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে প্রথমেই আসে ‘বনপলাশি’র নাম, একটি ম্যাগাজিন, যার জুলাই-সংখ্যা দেখে সম্পাদক ভার্গবীদিদি ও সুলেখক বীথিদিদির সঙ্গে পরিচয়। আর ওদের সূত্রে দাদার সঙ্গে পরিচয়। দাদা পেশায় ট্যুর অপারেটর। ছোটো থেকেই ভ্রমণ তার রক্তে। তাই আমার সাথে মনের মিল হতে দেরি হয়নি।

শেরপা লজের রেস্তোরাঁ থেকে।

আমি যখন প্রথম ধোতরে এসেছিলাম তখনও শেরপা লজেই উঠেছিলাম। তখন ছাদ ছিল না এই হোমস্টেতে। কুড়ির লকডাউনে ওরা ছাদ তৈরি করেছে। ছাদে গিয়ে যা দেখালাম তা এই ট্যুরের অন্যতম আকর্ষণীয় দৃশ্য হয়ে থাকল আমার কাছে। পূর্ব দিকে ঝলমল করছে দার্জিলিং ও কার্শিয়াং শহরের আলো। পাহাড়ের আড়ালে থাকলেও শিলিগুড়ির আলোর আভা ছড়িয়ে পড়েছে বায়বীয় মাধ্যমে। অমানিশার আকাশে সুস্পষ্ট আকাশগঙ্গা দৃশ্যমান। পূর্ণিমা হলে রাতেই দেখা মিলত শায়িত বুদ্ধের।

এরই মাঝে হঠাৎ শোনা গেলো শব্দবাজির আওয়াজ। আমার প্রিয় দল জার্মানির খেলা চলছিল। নেট অন করে স্কোরে চোখ রেখে দেখি গোল হয়েছে। আবারও ফুটবল উন্মাদনার আঁচ পেলাম। শেরপা লজের ছাদে উড়ছে পর্তুগালের পতাকা। কোনো কোনো বাড়ির ছাদে একসাথে উড়ছে ব্রাজিল, আর্জেন্তিনার পতাকা। কোনো বাড়ির অলিন্দ থেকে ঝুলছে ইংল্যান্ড, স্পেনের পতাকা। সিঙ্গালিলার চাঁপা-গুরাসের রূপ দেখেছি। রুবাস-গলথেরিয়া, প্রিমুলি-অ্যারিসিমায় সুসজ্জিত রূপও দেখেছি। এ বার দেখলাম দেশবিদেশের রংবেরঙের পতাকায় সজ্জিত রূপ।

রাতের ডিনার সারলাম ভাত, ডাল, স্কোয়াশের তরকারি, দেশি মুরগির মাংস, আচার করে রাখা ডোলে খুরসানি লঙ্কা ও কচি বাঁশের ডগার আচার দিয়ে। আয়েশ করে খাওয়া শেষ হলে আসল শাস্তিটা চলে এল অবধারিত ভাবে। সেটা হল হাত ধোয়া। হাত যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে ঠান্ডায়। তার পর আবার একটু ছাদে যাওয়া। ইচ্ছা ছিল অনেকটা সময় কাটানো। তবে ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে কিছু রাত্রিকালীন ছবি তুলেই নেমে যেতে হল। অবশ্য ঘরের কাচের জানলা দিয়ে দূরের সেই আলোকমালা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। দু’টো লেপ গায়ে দিয়ে উষ্ণতা পেলাম। সারা রাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ল শিশির।

সূর্য উঠতে তখনও ঘণ্টাখানেক বাকি, ঘুম ভেঙে উঠে পড়লাম। তৈরি হয়ে নিলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে আবছা। তার পর একাই চলে এলাম ছাদে। ফেসবুকে একটা পোস্ট করলাম। দাদাও চলে এল। একে একে চলে এল নবপরিচিত আঙ্কল, আন্টি ও দিদিরা। ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম’-এর সুরে পূর্ব দিকে অহনা আলোর রশ্মি, উত্তর-পশ্চিমে কাঞ্চনজঙ্ঘায় লক্ষ সোনার ভল্ট দেখতে লাগলাম। একটা ফোনকে টাইমল্যাপ্সে রেখে অন্যটি দিয়ে ছবি তোলা চলতে লাগল। হঠাৎ চোখ পড়ল নীচে ঘাসের ওপর। সাদা হয়ে রয়েছে প্রায়।

পাহাড় অনেক দেখলেও তুষারপাত, বরফ এগুলো আমার ভাগ্যে জোটেনি কখনও। ডিসেম্বরে ঘুম, বাতাসিয়া লুপে ক্রিসেনথিমাম, পোটেনটিল্লার পাতায় জমে থাকা শিশির অথবা হাইডোথোড নিঃসৃত জলবিন্দু জমে ফ্রস্ট হতে দেখেছি যদিও। কিন্তু গুরুদোংমার যাওয়ার সুযোগ হেলায় হারিয়েছি। তাই বরফ নিয়ে খেলার কোনো অভিজ্ঞতা আমার নেই। শিলাবৃষ্টির পর শিল কুড়িয়ে শিলগুলোকে কাপড়ে জড়িয়ে চাপ দিয়ে বরফের বলও বানিয়েছি, তার পরেও বরফ দেখা হয়নি। তাপমাত্রা ৪° সেলসিয়াসের আশেপাশে দেখালেও মাটি আপেক্ষিক ভাবে বেশি ঠান্ডা হয়ে হিমাঙ্কে নেমে যায় বলেই শিশিরকণা গুলো ফ্রস্টে পরিণত হয়।

গাছের পাতায় শিশির জমে ফ্রস্ট।

গাড়ির বনেট, বাইকের সিটের ওপরেও এ রকম ফ্রস্ট জমে আছে। আমি তো শুধু দর্শক। কিন্তু ওগুলোকে হাতে নিয়ে দেখার ইচ্ছা কিন্তু ষোলো আনা। ঠিক এই সময়ে দাদা হাতে এক টুকরো বরফ নিয়ে হাজির। ফ্রস্টগুলোকেই এক জায়গায় করে বরফখণ্ডের আকার দিয়েছে। সবাই ছবি তুলতে লাগলাম। দাদাও সবার শখ পূরণের জন্য ওই ঠান্ডায় বরফখণ্ডটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

সত্যি বলতে কি এই ছোট্ট ট্যুরটিতে এমন অনেক কিছু সুন্দর অভিজ্ঞতা হল, যা আগে হয়নি। আরও একটা অন্যতম বিষয় হল আমি এর আগের বার কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাইনি। এ বারে প্রায় ছয় ঘণ্টা টানা তার দেখা মিলল। এর পর একটু হেঁটে আসার লক্ষ্যে বাসবটে অভিমুখে চললাম। বাসবটেতে পোস্ট অফিস রয়েছে, আগের বার গিয়েছিলাম। সেখানে বয়ে চলেছে চঞ্চলা লোধোমা নদী। যাই হোক অতটা নয়, একটু, কয়েক পা হেঁটে এলাম। বাঁ দিকে পাইনের বন, না, ভুল, পাইন বন নয়, দার্জিলিং-কালিম্পং পাহাড়ে পাহাড়ে পাইন গাছ হাতে গোনা। বন সৃষ্টি করেছে ধুপিগাছ। যার বিজ্ঞান সম্মত নাম ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপোনিকা। এখানে এক হাজারটি ক্রিপ্টোমেরিয়া থাকলে দশটি পাইন দেখা যেতে পারে।

জাপান অরিজিনের এই গাছগুলোকে কাঠের জন্য ও সৌন্দর্যায়নের জন্য ব্রিটিশরা লাগিয়েছিল। তবে এই গাছ স্বাভাবিক গাছের বাড়বৃদ্ধি ধ্বংস করে। আর গোড়ায় ঘাস জন্মাতে দেয় না বলে ভূমিক্ষয়ও বেড়ে যায়। ক্রিপ্টোমেরিয়ার অরণ্য গাঢ় সবুজ হয়, কিন্তু পাইনের নিডল শেপ্‌ড পাতায় সূর্যালোক পড়ে চকচক করে, যেন মনে হয় সুবোধ বালকটি তেল মেখে, শিশিরের জলে স্নান সেরে, চুল আঁচড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র ছিলাম বলে সবাইকেই গাছ চেনানোর চেষ্টা করি। এখানেও তাই করলাম।

তার পর বুদ্ধিস্টদের একটা উপাসনাস্থল থেকে দেখলাম তুষারমুকুট পরিহিত কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিবার, আর শীতে রাজ্যাভিষেকের অপেক্ষায় থাকা টংলু, গৈরিবাস, কালিপোখরি, সান্দাকফুদের। এর পর হোমস্টেতে ফিরে কাচের জানালা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে ব্রেকফাস্ট।

ভিউ পয়েন্টে যাওয়ার পথে শিবমন্দির।

ব্রেকফাস্ট সেরে ভিউ পয়েন্ট দেখাতে হবে তো। আবার বেরিয়ে পড়লাম। এ বার উল্টো দিকে। মেডিসিনাল প্ল্যান্ট গার্ডেনের আগেই বাঁ দিকে খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে। বাঁ দিকে একটি শিবমন্দির, ডান দিকে মনাস্টেরি। তার পর আরও কিছুটা উপরে উঠলে ভিউ পয়েন্ট। অ্যারিসিমা গাছ ছিল এখানে অনেক। এ বার দেখতে পেলাম না। এই অ্যারিসিমা ফুল দেখলে যে কেউ সাপ বলে ভুল করতে পারে। গত বছর ধোতরেতে তুষারপাত হয়েছিল খুব। বারো ইঞ্চি বরফ জমে গিয়েছিল। ছবিও দেখেছি হোমস্টের ডাইনিং হলে। হয়তো সে কারণেই অ্যারিসিমাগুলোকে দেখতে পেলাম না। কুল পরিবারের সদস্য বলে ভুল করা স্মাইল্যাক্স মিউনিটাদের দেখলাম, একই ভাবে পথ দেখিয়ে দিল ভিউ পয়েন্টের।

এখানে বেশ কয়েকটা পাইন গাছ রয়েছে। পাইনের কোণ নীচে পড়ে থাকতে দেখলাম না তেমন। থাকলেও সেগুলো বেশির ভাগই নষ্ট। ভিউ পয়েন্টে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফোটোসেশন করে ফিরে এলাম। গোছগাছ করে দাদা আঙ্কল, আন্টি, তিন দিদি ও ছোট্ট প্রিন্সেসকে নিয়ে রওনা দিল। কাঞ্চনজঙ্ঘার এত দুঃখ হল যে সে মেঘের আড়ালে চলে গেল।

ধোতরের মাথার ওপরেও কালো মেঘেদের আনাগোনা। আমি একটু হাঁটতে বেরোলাম, গাছেদের সাথে আলাপ জমাতে। শেরপা লজের মালিক নোরবু আঙ্কল হারবেরিয়াম করার জন্য কিছু নিউজপেপার দিয়ে আমাকে সাহায্য করল বড়ো আন্তরিক ভাবে। ক্রসোসেফালাম, ক্যালসিওলারিয়া যা লেডিস পার্স নামে পরিচিত, পাষাণভেদ নেপালিতে পাখানবেড, চিম্পিং, রুমেক্স নেপালেনসিস, আর্টিমিশিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সোয়া বারোটা বাজল। এরপর লাঞ্চ করে গাড়ির অপেক্ষা।

শেরপা লজ, ধোতরে।

দেড়টায় গাড়ি এল। আবার সেই সিংগো নেটওয়ার্কের গাড়ি। তবে এ বারে বোলেরো। স্টিয়ারিং হাতে সাংগে। যাত্রী আমি একাই। ওর গাড়িতে ব্রাজিলের পতাকা। আমার সাথে গল্প জুড়লো ছেলেটি। জিজ্ঞেস করল, বিশ্বকাপে আমার প্রিয় দল কোনটি। এ ভাবে কথা চলতে চলতে এক জায়গায় একটি মেয়ে উঠল গাড়িতে। দু’ জনেই মাতৃভাষায় কথা বলতে লাগলো, আমি সাইড সিন দেখতে দেখতে চললাম। এক সময়ে সাংগে জানতে চাইল যে আমি নেপালি জানি কিনা। আমার তখন ঠিক যে শব্দটা বলা উচিত, তা আমার জানা ছিল, তাই বললাম, ‘অলিকাতি’। ওরা হেসে ফেলল। আমি বললাম, নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে অল্প চর্চা ছিল কিছু নেপালি বন্ধু থাকায়। মেয়েটি বলল, সে-ও ওখানে পড়েছে, ২০১৮-২০ ব্যাচ, পলিটিক্যাল সায়েন্সের স্টুডেন্ট। এ বারে বুঝলাম মাঝে মাঝেই যাতায়াত করতে করতে ওরা পরিচিত হয়ে গেছে একে অপরের।

এর মধ্যেই সূর্য তার তেজ হারাতে লাগল। মিরিকের কাছে একটা বেন্ড, গাছের আড়াল নেই। সেটাকেই ভিউ পয়েন্ট বানাতে ইচ্ছে হল। আমার অনুরোধে সাংগে গাড়ি থামাল। পেঁজা তুলোর মতো মেঘকে রাঙিয়ে দিয়ে একটা অসাধারণ সূর্যাস্ত হচ্ছে। এর পর শর্টকার্ট রাস্তা নোলদাড়া হয়ে নেমে এলাম। অসাধারণ তার ভিউ। তেমনি হেয়ারপিন বেন্ড। গাড়ির গতি বুঝতে স্পিডোমিটারে চোখ রেখে দেখি ৫০-৭০ কিমি/ঘণ্টা বেগে চলছে আমাদের যান।

দুধিয়া ব্রিজের আগে সাংগে আবার গাড়ি থামাল। আমি নামলাম না। ওরা দু’জনে নেমে একটা দোকানে গেল। দার্জিলিঙের কমলা কিনল। তার পর গাড়িতে উঠে একটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বালাসনের সরু ব্রিজ পেরিয়ে সঠিক সময়ে শিলিগুড়ি পৌঁছোতে পারব কি না চিন্তা করছি, এমন সময় আবার চোখ গেল গাড়ির স্পিডোমিটারে। প্রায় সমতল রাস্তায় ১০০-১১০ কিমি/ঘণ্টা বেগে গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে চলেছে সাংগে। কথা রেখেছে ও। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছে দিয়েছে শিলিগুড়ি।

তার পর? তার পর আর কী, তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস থেকে স্টেট বাস ধরে বাড়ি। ফেরার পথের নতুন কথা? ফোর লেনের রাস্তা যে, সেই পুরোনো গতি, পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার পঁয়তাল্লিশ মিনিটে।

জরুরি তথ্য

শেরপা লজ – যোগাযোগ: 9733005191/8371918192/9476386379

সিংগো নেটওয়ার্কের গাড়ি – যোগাযোগ: 7076788207/7865955513

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *