সুব্রত গোস্বামী
ভোরে উঠে চটজলদি স্নান সেরে রেডি হয়ে নিলাম। আজ আমাদের গন্তব্য জয়ন্তী ও বক্সা পাহাড়।
নানা গাছগাছালিতে ভরা এই পাহাড়ে রয়েছে একটি দুর্গও। ১৮৬৪ সালে ভূটিয়াদের হটিয়ে বক্সা দুর্গ দখল করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। ১৯৩০ সালে এই দুর্গ সংস্কার করে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেখানে আটক করে রাখার ব্যবস্থা করে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকেও এখানে একসময় বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
বক্সা পাহাড়ের অরণ্য ৭৬৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এই অরণ্য শাল, চাঁপা, গামার, শিমূল, নানা প্রজাতির ঘাস, অর্কিড, বাঁশ, গুল্ম ও ওষধি বৃক্ষে ভরা। ১৯৯২ সালে এই বক্সা অরণ্যকে জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা অগণিত হাতি, গন্ডার, হরিণ, বাইসনের চারণভূমি।
ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটতে লাগল। পথে পড়ল রাজাভাতখাওয়া। অদ্ভুত নাম। এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ইতিহাস। ১৮০০ সালের আশেপাশে এই অঞ্চলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এই অঞ্চল দখল করেন ভুটানের রাজা। তখন এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন কোচবিহারের রাজা। ভুটানের রাজার বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের ডাক দেন। কোচ রাজা পণ করেন যতক্ষণ না পর্যন্ত এই অঞ্চলকে মুক্ত করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি অন্ন গ্রহণ করবেন না। এই খবর পেয়ে প্রমাদ গোনেন ভুটানের রাজা। বিপদ বুঝে সন্ধিতে রাজি হন তিনি। পণ ভাঙেন কোচ রাজা। দুই রাজার মধ্যে সন্ধির পরে এই স্থানে বসে অন্নগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা। তাই এই অঞ্চলের নাম ‘রাজাভাতখাওয়া’।
আলিপুরদুয়ার থেকে ৩০ কিমি দূরে বক্সা অভয়ারণ্যের পাশে জয়ন্তী। এমন অন্তহীন সৌন্দর্য ডুয়ার্সের খুব কম জায়গাতেই আছে। তাই জয়ন্তীকে বলা হয় ডুয়ার্সের রানি। গাড়ি থেকে নেমে একটু অবাকই হলাম। এ কোন জায়গা! সৌন্দর্যের ছিঁটেফোঁটাও কিছু দেখতে পেলাম না।
এখান থেকে অন্য গাড়িতে করে আমাদের জঙ্গলে প্রবেশ করতে হবে। মারুতি জিপসি গাড়িতে করে জঙ্গলের আরও ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভুল ভাঙল তার পর। শীতের শুরুতে নদীতে জল শুকিয়ে আসছে। নদীর পাথুরে গিরিখাত ধরে আমাদের গাড়ি ছুটতে লাগল। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। নদীর পথে পথে কোথাও তীব্র জলস্রোত। তার ওপর দিয়ে হেলতে দুলতে আমাদের জিপসি এগিয়ে চলল।
গর্বের গতিপথ হারিয়েছে জয়ন্তী নদী। তবু সৌন্দর্যে এক ফোঁটাও ভাটা পড়েনি। বর্ষাকালে এই নদীর অন্য রূপ। কূল ছাপিয়ে গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নদীর ও-পারে ভূটান পাহাড়। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা নুড়ি-পাথরের শুকনো নদীপথে বিরাজমান অপার শান্তি। দুলতে দুলতে সেই পথ বেয়ে আমাদের গাড়ি যেখানে থামল, সেখান থেকে শুরু হাঁটা পথ। এই পথ ধরেই আমরা এগিয়ে চললাম ছোটো মহাকাল মন্দিরের উদ্দেশে।
শিবরাত্রির সময় এই মহাকাল মন্দিরে বহু মানুষের সমাগম হয়। তখন মেলার আকার নেয় এই অঞ্চল। জঙ্গলের বুক চিরে নেমে এসেছে জয়ন্তী নদী। কাচের মতো স্বচ্ছ জল মাড়িয়ে আমরা ছোটো মহাকাল মন্দিরের দিকে এগিয়ে চললাম। কোথাও আমার কোমর-সমান জল। আমার সহধর্মিণী তো ভয়ে জড়সড়ো। মাকে অভয় দিল আমার পুত্র ঋষভ।
ডিসকভারি চ্যানেলের দৌলতে আমরা জানি কী ভাবে এই রকম জলস্রোত অতিক্রম করতে হয়। তিন জন হাত ধরে নদী পার হলাম। তার পর আবার পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথ পেরিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম ছোটো মহাকাল মন্দিরে। মন্দির সংলগ্ন এলাকায় সব নীরবতা ভেঙে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসছে এক ঝরনা। ঘন জঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চলে আছে অপার শান্তি। স্বপ্নময় নীল আকাশের নীচে পাহাড়ে শুধু সবুজের সমারোহ। এই স্বপ্নের সন্ধানে প্রকৃতির ঘ্রাণ নেওয়ার জন্যই ডুয়ার্সের পথে ভ্রমণপিপাসু মানুষের ভিড়।
জয়ন্তী দেখে ফিরতে ফিরতে বেলা শেষ হয়ে এল। এই যাত্রায় আমাদের আর পুকুরি লেক দেখা হল না। বকসা দুর্গের সংস্কার চলছে। কিছু দূর গিয়ে ফিরে আসতে হল। ক্লান্ত শরীরে ‘হৃদকোমল’-এ ফিরে দেখি কফি নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় কৃষ্ণ ভাই। সত্যি এদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হতেই হবে। ঘুরতে এসে এই আতিথেয়তা আমাদের পরম প্রাপ্তি। (শেষ)
ছবি: ঋষভ গোস্বামী
আরও পড়ুন: করোনাকালে ডুয়ার্স ভ্রমণ ২: হরিণ-পরিবারের মুখোমুখি