করোনাকালে ডুয়ার্স ভ্রমণ ২: হরিণ-পরিবারের মুখোমুখি

সুব্রত গোস্বামী

‘হৃদকমল’-এ এসে মনটা খুশিতে ভরে গেল। ময়নাগুড়ির শহুরে এলাকা ছেড়ে কোলাহলমুক্ত সবুজের মাঝে এই অতিথিশালা। অতিথিশালার কর্মীদের সব দিকে সজাগ দৃষ্টি। সারা রাত বাসে চলার ধকল সামলে ফ্রেশ হতে না হতেই দেখি চা-এর ট্রে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন কৃষ্ণ ভাই। চা খেয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা হল। একটু পরেই প্রাতরাশের ডাক এল। প্রকৃতির মাঝে বসে লুচি, তরকারি আর মিষ্টি খাওয়ার মজাই আলাদা। সামনে ঝকঝক করছে পাহাড়ের রানি কাঞ্চনজঙ্ঘা। এই বছর লকডাউনের কারণে বাতাসে দূষণের মাত্রা কম। তাই পাহাড়ের রানি হাতের মুঠোয়।

সকালের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে না নিতেই দেখি লাঞ্চের খাবার রেডি। অনেক দিন পর এত ভালো রান্না পেলাম। ঘুরতে গেলে আমরা খাবার নিয়ে মাথা ঘামাই না। কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে শুধু এই খাবারের লোভেই আবার আসতে হবে। লাউয়ের তরকারি আর বরোলি মাছ তো অনবদ্য। সাথে আবার জলপাইয়ের চাটনি আর সন্দেশ। আমরা এসেছি শুনে বৌদি নিজের হাতে রান্না করে পাঠিয়েছেন।

লাঞ্চের পর আজ আমাদের মেদলা ফরেস্ট সাফারি। গরুমারা অভয়ারণ্যের দক্ষিণ দিকের ফরেস্ট ‘মেদলা’ নামে পরিচিত। ঠিক সময়ে পাপাই গাড়ি নিয়ে হাজির। এখানে থেকেই শুরু হল আমাদের ডুয়ার্স ভ্রমণ।

‘ডুয়ার্স’ কথার অর্থ দুয়ার বা দরজা। এটি পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে পশ্চিমবঙ্গ ও অসম নিয়ে গঠিত। এই অঞ্চল উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মাঝে রয়েছে চাপরামারি, গরুমারা, চালসা, ঝালং, বিন্দু, জলদাপাড়া, বকসার মতো সুন্দর জায়গা।

ছোটো বড়ো পাহাড়, পাহাড়ি রাস্তা এঁকেবেঁকে মিশেছে দূরের পাহাড়ে। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাল, সেগুন আর চা বাগান। এখানে-ওখানে দু’-একটা ঘরবাড়ি। সব কিছু মিলিয়ে ডুয়ার্সের পরিবেশ নিঝুম, নিরিবিলি।

মন হালকা করল গাড়ির সাউন্ড সিস্টেম। অবিরাম বেজে চলেছে পুরোনো দিনের বাংলা গান। গহন অরণ্য, চা বাগান পিছনে ফেলে অবশেষে গরুমারা অভয়ারণ্যের মুখে এসে দাঁড়াল আমাদের রথ। গন্ডার, হাতি, বাইসন, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ ও চিতাবাঘের দর্শন মেলে এই অভয়ারণ্যে। জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে চলা ইনডং ও মূর্তি নদীর শোভা অজানারে দেয় হাতছানি। জঙ্গলের সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করার জন্য আছে ওয়াচটাওয়ার। কর্মব্যস্ত শহুরে জীবন ছেড়ে জঙ্গলে প্রবেশের মুখে উপলব্ধি করলাম প্রকৃতির ঘ্রাণ। চা বাগানের ভিতর দিয়ে আঁকা বাঁকা রাস্তা যেন কোনো অচিনপুরের পথ। সে পথে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। মেদলা অভয়ারণ্যের গেট থেকে আমাদের গাড়িতে ৪ কিমি যাওয়ার পর আমাদের আসল যাত্রা শুরু হল। আমরা মোষের গাড়িতে করে জঙ্গলের আরও ভিতর প্রবেশ করলাম।

মোষের গাড়ি থেকে নেমে পায়ে পায়ে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করেই চমকে উঠলাম। আমাদের স্বাগত জানাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক হরিণ পরিবার। আমাদের পায়ের শব্দে থোড়াই কেয়ার। ভাবটা এমন এ যেন তাদেরই রাজত্ব। তোমরা কে হে! সত্যিই তো…আমরা তো এখানে অনাহূত অতিথি।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে বয়ে গেছে মূর্তি নদী। শীতকালে তার জল বিশেষ না থাকলেও সৌন্দর্যে এক ফোঁটাও ভাটা পড়েনি। জঙ্গলে ঘেরা নুড়ি-পাথরের শুকনো নদীপথে বিরাজমান অপার শান্তি।

একটু সামনে যেতেই দেখি ওয়াচটাওয়ার। যার উপরে উঠে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। দূরে এক জলাশয়ে একটা গন্ডার তার সন্তান নিয়ে খেলা করছে। একটু পরেই দেখি, সে গুটি গুটি পায়ে ওয়াচটাওয়ারের দিকে এগিয়ে আসছে। আমার পুত্র ঋষভের আনন্দ আর দেখে কে! মনের আনন্দে ক্যামেরার শাটার টিপে চলেছে। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে। আমরা সবাই বাকরুদ্ধ। দূরে নদীর ও-পার থেকে একদল বাইসন জল খেতে এসেছে। আস্তে আস্তে সূর্যের আলো কমে আসছে। এ বার ফেরার পালা।

অতিথিশালায় ফিরে দেখি গরম গরম শিঙাড়া আর কফি রেডি। সত্যি এঁদের আতিথেয়তার কোনো তুলনা নেই। এখানের জল খুব ভালো। যা খাচ্ছি, তা-ই হজম হয়ে যাচ্ছে। রাতে আবার দেশি মুরগির মাংস আর রুটি। সাথে আবার সন্দেশ। আর কী চাই! (চলবে)

আরও পড়ুন: করোনাকালে ডুয়ার্স ভ্রমণ ১: ‘হৃদকমল’-এর আশ্রয়ে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *