শ্রয়ণ সেন
‘চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালি’ যদি কোনো নামী চায়ের কাফের পাশ দিয়ে যায়, এক বার ঢুঁ মারবেই। আমরাও ব্যতিক্রম নই। ঢুকে পড়েছি মালবাজারের ‘টি মোমেন্টস’ কাফেতে।
লাল চা শরীরকে চাঙ্গা করে। পাহাড়ের ঠান্ডা থেকে আচমকা গরমে নেমে কিছুটা ক্লান্ত লাগছে। তাই শরীরকে চাঙ্গা করা একান্ত প্রয়োজন। এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে।
আজ কী রকম একটা মন খারাপের মতো সকাল হল লুংচুতে। ভেবেছিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে পাব। সে সুযোগ এল না। কুয়াশার যে আস্তরণ কাল রাত থেকে পড়েছে, সে সরেইনি। এমনকি এখানে আসার পর কাল দুপুরে সামনে যে পাহাড়টা দেখছিলাম, সেটাও উধাও।
প্রাতরাশ করেই রওনা হয়ে গেলাম। আজ বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। গন্তব্য জলদাপাড়া।
লুংচু থেকে জলদাপাড়া প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। বর্ষায় উত্তরবঙ্গে এক দিনে এতটা পথ সাধারণত কেউ পাড়ি দেন না। আমরা কিছুটা দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। ভাগ্যিস সকাল থেকে প্রবল বৃষ্টি নেই, তাই পথে কোনো সমস্যাও হয়নি।
নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে দিয়েই ফেরার পথ ধরলাম। গতকাল যেখান দিয়ে নেওড়া ভ্যালির মধ্যে ঢুকেছিলাম, আজ সেখানে বেরিয়ে এসে বাঁ দিকে ঘুরলাম। এগিয়ে চলেছি মালবাজারের দিকে।
চিন সীমান্তে যাওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা এখন এটা। রয়েছে বর্ডার রোডস্ অর্গানাইজেশনের তত্ত্বাবধানে। তাই পাহাড়ি পথ হলেও বেশ চওড়া। যদিও মাঝেমধ্যে ধসের চিহ্নও রয়েছে। কোথাও কোথাও কাদাও ভেঙে যেতে হচ্ছে।
উচ্চতা ক্রমশ কমছে। ক্রমশ নামছি আমরা। কুয়াশার আস্তরণ সরতেই ডুয়ার্সের সমতল আমার চোখের সামনে। এ এক অপরূপ দৃশ্য। প্লেন ল্যান্ড করার সময় নীচের সমতলকে যে রকম লাগে, ঠিক সেই অনুভূতিটাই আসছে।
আরও নীচে চলে এলাম। যাত্রাবিরতি হল চেল ব্রিজে। ডুয়ার্সের অন্যতম খ্যাতনামা নদী চেল। এখানেই ঝরনার মতো পাহাড় থেকে নেমে আসছে সে। তার পর, নদী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ডুয়ার্সের দিকে।
ছবি তোলার পালা শেষ করে রওনা হই। ফিরে এল চা বাগান। দার্জিলিং পাহাড়ে চা বাগানের যেমন ছড়াছড়ি, কালিম্পং পাহাড়ে অতটা দেখা যায় না। ডুয়ার্সের কাছাকাছি চলে আসতেই ফের এসে গেল সেই চা বাগান।
নাম তার অম্বিয়ক চা বাগান। কিন্তু স্থানীয় ভাবে সে পরিচিত অম্বে চা বাগান হিসেবে। বিশাল এলাকা জুড়ে তার ব্যাপ্তি। মূল সড়কও চা বাগানের ভেতর দিয়েই চলে গিয়েছে। অম্বিয়ক যেখানে শেষ, সেখানে আরও এক মনভোলানো সৌন্দর্য হাতছানি দিল। দাঁড়িয়ে গেলাম।
আশেপাশে সবুজ পাহাড়, মাথার ওপরে নীল আকাশ আর নীচে চেল নদী এঁকে বেঁকে চলে যাচ্ছে। এটা তথাকথিত কোনো স্পটই নয়, অথচ প্রকৃতি এখানে কী অসাধারণ রূপ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।
মালবাজারের বিখ্যাত কাফেতে চা খেয়ে মন এখন শান্ত। ক্লান্তিও নেই। ফের নতুন একটি জায়গায় যাওয়ার উত্তেজনায় মন ছটফট করছে। ফের শুরু হল পথ চলা।
ঝাঁ চকচকে রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল। এই পথ দিয়ে আগে অনেক বারই গিয়েছি। কিন্তু আজকের মতো রূপ আগে কখনও দেখিনি। বর্ষায় ডুয়ার্স কী ভাবে অপরূপা হয়ে ওঠে, সেটা উপভোগ করছি।
ডুয়ার্স মানেই একের পর এক নদী। প্রথমেই পেরিয়েছি মাল নদীকে। কুর্তী নদী পেরিয়ে এলাম চালসা। এখান থেকে বাঁ দিকে সামসিং-সান্তালেখোলা, ডান দিকে লাটাগুড়ি।
কিছুটা এগোতেই পেরিয়ে যাই মূর্তি নদী। দেখা যায় নদীর ঠিক ধারেই অবস্থিত পানঝোরা ক্যাম্প, পশ্চিমবঙ্গ বনোন্নয়ন এজেন্সির অন্তর্গত। শুরু হয়ে যায় চাপরামাড়ির ঘন জঙ্গল।
বর্ষায় এই জঙ্গলে সবুজের রাজত্ব। গা ছমছমে ব্যাপারের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। ডুয়ার্সে মাঝেমধ্যেই মূল সড়কে হাতি বেরিয়ে আসে। সেই রকম কোনো অভিজ্ঞতা হবে কি না ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলি।
খুনিয়া মোড় মনে করিয়ে দেয় বাঁ দিকের রাস্তা চলে গিয়েছে ঝালং, বিন্দুর দিকে আর ডান দিকেরটা মূর্তি পথে।
শেষ হল চাপরামড়ির জঙ্গল। পেরিয়ে গেলাম জলঢাকা। বর্ষায় নদীর যে রূপ দেখব ভেবেছিলাম সে রকম কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নদীতে জল রয়েছে, কিন্তু পাথরও বেরিয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে খুব বেশি বৃষ্টি এই বর্ষায় হয়নি।
তবে যে ব্যাপারটা মন ভুলিয়ে রাখছে তা হল দূষণমুক্ত পরিবেশ, ঘন নীল আকাশ এবং হাত ছোঁয়া দূরত্বে হিমালয়ের পাহাড়।
পাহাড় ছেড়ে এসেছি, কিন্তু পাহাড় আমাদের ছাড়তে চাইছে না কিছুতেই। তাই তার অপরূপ শোভা আমাদের সামনে। রাস্তার দু’ধারেই একের পর এক চা বাগান।
পেরিয়ে গেলাম গাঠিয়া, কুজি ডায়না নদী। বাঁ দিকে একের পর এক রাস্তা বেরিয়ে যাচ্ছে। কোনোটায় যাওয়া যায় লাল ঝামেলা বস্তি, কেউ গিয়েছে চামুর্চি, কেউ গিয়েছে বান্দাপানির দিকে। সব জায়গাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে একে অপরের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে।
বীরপাড়ায় রাস্তা দু’ ভাগ। সোজা চলে গেল মাদারিহাট, হাসিমারার দিকে। আমরা ডান দিকে ঘুরলাম, অর্থাৎ ফালাকাটার দিকে। এটা ঠিক যে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের প্রাণকেন্দ্র মাদারিহাট। কিন্তু আমরা যে দিকে যাচ্ছি, জাতীয় উদ্যানের অন্য একটা দিক। আসল জলদাপাড়াও সেখানেই।
ফালাকাটার দিকে ঘুরতেই দলগাঁও চা বাগান। রাস্তার দু’ধারে এই চা বাগান। বাগানের মাঝে অফিসারদের বিশাল বিশাল বাংলো বাড়িগুলো দেখে বেশ ঈর্ষা জাগে।
জটেশ্বর পেরিয়ে ঢুকলাম ফালাকাটা। উত্তরবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। সম্প্রতি পুরসভার মর্যাদা পেয়েছে এই ফালাকাটা। কিছুক্ষণের যাত্রা বিরতি। টুকটাক কেনাকাটা, ফের পথ চলা শুরু।
রাস্তা এ বার কিছুটা খারাপ। বিভিন্ন নদীর ওপরে সেতুগুলো নতুন করে তৈরি করার কাজ হচ্ছে। তাই গাড়ির গতি স্লথ।
আমরা যাচ্ছি জলদাপাড়া রাইনো কটেজে। ফালাকাটা ছাড়ার পর থেকেই ফোনে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন সেখানকার ম্যানেজারবাবু। রাস্তা বলে দিচ্ছেন।
শালকুমার মোড় থেকে মূল সড়ক ছেড়ে বাঁ দিকে গ্রামীণ সড়ক ধরলাম। তবে এই গ্রামীণ সড়কের অবস্থা মূল সড়কের থেকে ভালো। রাস্তা কিছুটা সরু হলেও পুরোটাই পিচের। কোথাও কোনো খানাখন্দ নেই।
এগিয়ে চলি শালকুমার হাটের দিকে। এ বার অন্যরকম সৌন্দর্য। চা বাগান আর নেই। তার জায়গায় দখল নিয়েছে একের পর এক সুপুরি বাগান। ডুয়ার্সকে এক কথায় চেনা যায় সুপুরি গাছ আর টিনের চালের বাড়ি দিয়ে। সেই রূপ দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাই শালকুমার হাট।
এখান থেকে ম্যানেজারবাবুর দুর্দান্ত পথ নির্দেশনায় বাকি পথটা শেষ করলাম। জিপিএসের সাহায্য নেওয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়ছে না। অবশ্য জিপিএস মাঝেমধ্যেই ভুল করে। এই সফরে বেশ কয়েক বার তেমন উদাহরণ পেয়েছি। তাই ফের একবার স্থানীয় মানুষের পথ নির্দেশনার ওপরেই ভরসা করছি।
পিচ রাস্তা ত্যাগ করে শেষে দেড় কিলোমিটার মাটি এবং সুরকির রাস্তা। আশেপাশে ঘিরে রেখেছে সুপুরি গাছ। ঢুকে পড়লাম জলদাপাড়া রাইনো কটেজের চৌহদ্দিতে।
“অন্য কথা পরে হবে, আগে খাওয়াদাওয়া করে নিন। আপনাদের খুব খিদে পেয়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”
অত্যন্ত অমায়িক এক কণ্ঠ। স্বাগত জানিয়েই আমাদের খাবার ঘরে টেনে নিয়ে চলে গেলেন ম্যানেজারবাবু।