
ভাগ্যিস চরম শীতের ভয়ে ডালহৌসি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নইলে হিমাচল প্রদেশের অত্যন্ত সুন্দর একটা জায়গার সঙ্গে অপরিচিতই থেকে যেতাম যে।
নুরপুরের হিমাচল পর্যটনের হোটেলে পৌঁছোতেই দুর্দান্ত ভাবে স্বাগত জানালেন হোটেলের ম্যানেজার এবং কর্মচারীরা। ডালহৌসির ম্যানেজারের কাছ থেকে খবর পেয়ে একদম প্রস্তুত ছিল নুরপুরের হোটেল। আজ সকালে যখন ডালহৌসি থেকে চেকআউট করছি, তখন ম্যানেজার সাহেবই বললেন, নুরপুরে যেতে। নুরপুরে হিমাচল পর্যটনের হোটেল থাকার ফলে বুকিং-ও ‘বদলি’ হয়ে যাবে, আলাদা টাকা লাগবে না।
আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৭/ ডালহৌসির প্রবল ঠান্ডায়
হোটেলে ঢুকতেই দেখলাম মধ্যাহ্নভোজন তৈরি। পেট ভরে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লাম নুরপুর শহরের সঙ্গে পরিচিত হতে।
নুরপুরের নাম যে একেবারে শুনিনি সেটা নয়, হিমাচলের মানচিত্র ঘাঁটতে গিয়ে বেশ কয়েক বার শহরটাকে দেখেছি, কিন্তু এই নুরপুরও যে হিমাচলের একটা অনন্য জায়গা, সেটা এখানে এসে বুঝতে পারলাম।
প্রথমেই বলে রাখি যে কারণে নুরপুরে এসেছি, সেই কারণ এক্কেবারে সফল। ডালহৌসির ম্যানেজার বলেছিলেন, নুরপুর অনেক নীচে, তাই বেশি ঠান্ডা লাগবে না। সত্যিই তাই, সমুদ্রতল থেকে মাত্র হাজার দুয়েক ফুট উচ্চতার নুরপুরে ঠান্ডা অনেকটাই কম। দুপুর দুটোর সময়ে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ১৫ ডিগ্রি। ২৪ ঘন্টা আগেই এই সময়ে তাপমাত্রা দেখেছিলাম ২ ডিগ্রি। পাহাড় যে প্রায় শেষ হয়ে আসছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে। রাস্তাও প্রায় সমতল।
আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৬/ খাজিয়ারের তুষারচমক
নুরপুরের প্রধান দ্রষ্টব্য স্থান এখানকার কেল্লা। সেই কেল্লা দেখার উদ্দেশে রওনা হলাম।

ছোট্টো করে নুরপুরের ইতিহাসটা বলি নিই। রাজপুত পাঠানিয়াদের রাজত্বের শহর নুরপুর। একাদশ শতকে এই শহরের পত্তন করেন রাজা ঝেত পাল। ১৫৮০ থেকে ১৬১৩ পর্যন্ত রাজা বাসুর আমলে নুরপুরের নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। রাজ বাসুই এই কেল্লা তৈরি করেন। কিন্তু তখন এই শহরের নাম ছিল ধামেরি। সেখান থেকে নুরপুর নাম হল কী ভাবে?
নুরপুরের নাম এসেছে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের স্ত্রী নুরজাহানের নাম থেকে। জাহাঙ্গির যখন দিল্লিতে সাম্রাজ্য চালাচ্ছেন তখন নুরপুর, তথা ধামেরিতে এসেছিলেন নুরজাহান। সেই শহরের সৌন্দর্যে তিনি এতটাই মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জাহাঙ্গির-পত্নী। নুরজাহানের এই সিদ্ধান্তে চিন্তার ভাঁজ পড়ে স্থানীয় রাজাদের কপালে। স্থানীয় রাজারা ধামেরিতে মুগল আগ্রাসন আটকানোর জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। কিন্তু এটাও জানতেন যে নুরজাহান এখানে থেকে গেলে মুগল আগ্রাসন এখানে হতে বাধ্য। অগত্যা নুরজাহানকে শহরছাড়া করানোর জন্য একটা অভিনব চিন্তা করা হল, যাতে তিনি মনে আঘাতও পেলেন না।
আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৫/ মণিমহেশের প্রবেশদ্বারে
এই শহরে বেশি দিন থাকলে তাঁর সৌন্দর্যে প্রভাব পড়তে পারে আর তাঁর শরীরও খারাপ হতে পারে, কারণ এখানে নাকি অজানা রোগের প্রকোপ বাড়ছে, নুরজাহানের কানে এই কথা তুলতেই তড়িঘড়ি ধামেরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে স্থানীয় সাম্রাজ্য।
কিন্তু নুরজাহানের সঙ্গে এই শহরের স্মৃতিকে বেঁধে রাখতে ১৬২২ সালে এই শহরের নাম বদলে নুরপুর করার সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন রাজা জগত সিংহ পাঠানিয়া। ১৯৪৭ পর্যন্ত করদরাজ্য হিসেবে থেকে যায় নুরপুর।
একটা পাহাড়ের ওপরে অনেকটা সমতল অঞ্চলের ওপরে স্থিত নুরপুরের কেল্লা। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করে আবার বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। এক সময়ে এই কেল্লা গমগম করলেও, এখন অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কেল্লার ধ্বংসের পেছনে অবশ্যে ১৯০৫-এর কাংড়ার ভূমিকম্পও একটা কারণ।
আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৪/ জোত পাস, যেখানে হাতছানি দেয় স্বর্গ
তবে কেল্লার মধ্যে যেখানে মানুষের আনাগোনা সব থেকে বেশি সেটা হল ব্রিজ বৃজরাজস্বামী মন্দির। মন্দির হওয়ার আগে এটি দেওয়ান-ই-খাস ছিল। তাই মন্দিরের ইসলামধর্মী স্থাপত্য নজর কাড়বে। মন্দিরের ভেতরে বিরাজ করছেন ভগবান কৃষ্ণ। নিজের রাজত্বকালে রাজস্থানের চিতৌর থেকে কৃষ্ণের মূর্তি এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করেন জগত সিংহ পাঠানিয়া।

কেল্লার এক্কেবারে শেষপ্রান্ত থেকে পুরো উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। এক দিকে হিমালয়ের পাহাড়শ্রেণি, অন্য দিকে পঞ্জাবের সমতল। নীচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটি নদী, আকারে বেশ বড়ো। স্থানীয়দের কাছে জানতে পারলাম, এই নদীর নাম জভর খাদ। চাক্কি নদীর একটা শাখানদী এটা।
আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৩/ কাংড়া ফোর্ট দেখে দলাই-ভূমে
ঘণ্টাখানেক সময় খরচ করে নুরপুরের কেল্লা দেখলাম। এটা বলাই যায় যে এই কেল্লার থেকে বড়ো কেল্লা আমরা অনেক দেখেছি, কিন্তু তবুও এই কেল্লার সৌন্দর্য এবং এক কথায় গোটা নুরপুরের সৌন্দর্য আমাদের মনে একটা দাগ কেটে গেল।

কেল্লা দর্শন শেষ, এ বার আমাদের গন্তব্য নাগনি মাতা মন্দির। নুরপুর থেকে কুলুর দিকে ৬ কিমি গেলে এই মন্দির। স্থানীয়দের দাবি, এই অঞ্চলের অত্যন্ত জাগ্রত এই নাগনি মাতা। মন্দিরের পরিবেসহ এক কথায় অসাধারণ। মূল সড়ক থেকে বেশ কিছুটা নেমে এই মন্দির। আশেপাশে একটা জঙ্গল জঙ্গল ব্যাপার রয়েছে।
আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ২/ ধৌলাধারের পাদদেশে পালমপুরে
মন্দিরের পেছনে জঙ্গল হওয়ার ফলে মাঝেমধ্যেই এখানে সাপের দেখা মেলে। স্থানীয়দের বিশ্বাস তখন নাকি স্বয়ং নাগনি মাতাই পৃথিবীতে আসেন। কথিত আছে, কাউকে যদি সাপে কামড়ায়, তিনি যদি এই মন্দিরের জল খান তা হলে নাকি সম্পূর্ণ সুস্থ্ হয়ে যান। সেই কথা ঠিক না ভুল, জানি না। তবে আমরা শুধুমাত্র এই মন্দিরের পরিবেশেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

সন্ধে হয়ে আসছে, এ বার হোটেলে ফিরতে হবে। হিমাচল ভ্রমণের পালা এক্কেবারে শেষ পর্যায়ে। গত কয়েক দিন ধরে কত কী দেখলাম, কত কী জানলাম, স্থানীয়দের সঙ্গে পরিচয় করলাম। প্রবল ঠান্ডায় কী ভাবে জীবনধারণ করতে হয় সেটাও প্রত্যক্ষ করলাম। সব মিলিয়ে দারুণ কয়েকটা দিন হিমাচলে কাটল আমাদের। কাল রওনা হব অমৃতসরের পথে। তার পরেই বাড়ি ফেরার ট্রেন।
হোটেলে ফিরে তাই হিমাচল ভ্রমণের স্মৃতি রোমন্থনেই কেটে গেল গোটা সন্ধে। (চলবে)
কী ভাবে যাবেন
কাংড়া ভ্রমণ শুরু করার পথে একটা দিন যদি নুরপুরে থাকতে পারেন, খুব ভালো লাগবে। হাওড়া বা দিল্লি থেকে ট্রেনে পাঠানকোট পৌঁছোন। পাঠানকোট থেকে নুরপুরের দূরত্ব ২৬ কিমি। বাসেই চলে আসা যেতে পারে, আর গাড়ি তো আছেই। ডালহৌসির পথে একটা দিন এই নুরপুরে কাটিয়ে দিন।
কোথায় থাকবেন
নুরপুরে বেসরকারি কিছু সাধারণ হোটেল রয়েছে। তবে এখানে রাত্রিবাসের সব থেকে ভালো জায়গা নিঃসন্দেহে হিমাচল পর্যটনের হোটেল নূপুর। অনলাইনে বুক করার জন্য লগইন করুন www.hptdc.in।