
পরোটা, আলুভাজা আর রসগোল্লা উদরস্থ করে আবার ছুট। প্রথমেই ৩২৩ বছর পুরোনো তোপখানা মসজিদ। গাজী ইয়ার মহম্মদের প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদটিতে মোঘল আমল থেকে ঝোলানো একটি ঝাড়বাতি একই ভাবে রয়েছে বলে খবর ছিল। কিন্তু না, নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেটা আর দেখা গেল না। মসজিদ সংলগ্ন বাগানেই রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা ও তাঁর পুত্রের সমাধি।
মসজিদের পর মন্দির। সম্ভবত বঙ্গের একমাত্র গণেশ মন্দিরটি শান্তিপুরেই অবস্থিত। ব্যবসা-বাণিজ্যে এক সময়ে এ অঞ্চলের যে রমরমা ছিল তার সাক্ষী বহন করে একশো বছর পুরোনো এই মন্দির। পাশাপাশি মন্দিরে পঙ্খের কাজগুলিও দৃষ্টিনন্দন। পঙ্খের কাজ রয়েছে খোন্দকার মসজিদেও, যদিও ক্ষয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এখন চলছে মোটা দাগের সংস্কারের কাজ, তবে শৈল্পিক স্থাপত্যের মেয়াদ আর হয়তো বেশি দিন নয়।

সকাল থেকেই লাগাতার চরকিপাকে, নানান পাড়া মহল্লায় তাঁত চালানোর আওয়াজ কানে আসতে আসতে এমন হল যে মেশিনের শব্দ না পেলেই তাকিয়ে দেখছি এ-দিক ও-দিক। শাড়ি বোনা দেখব বলাতে পিন্টুদা একেবারে তাঁতের হাটে নিয়ে চলে গেল। নানান নকশা ও রঙবেরঙের তাঁত ও অন্যান্য রকমারি শাড়ি দেখার দৃশ্যও ঝকমারি। বণিকেরা ব্যস্ত বাণিজ্যে, আগ্রহীদের নেড়ে চেড়ে দেখা আর তাদের খেয়াল করে খুশি হওয়া, দারুণ অভিজ্ঞতা। ভাবলাম, ভিডিও কল করে বউকে একবার দেখাই। কিন্তু ঝুঁকিটা নিলাম না শেষমেষ। একেই আমি বর্ণচোরা, তার ওপর শাড়ির ফরমায়েশ যদি হয় তবে তো ঘোর বিপদ, কেননা মেয়েদের আলমারিতে পরিধানযোগ্য শাড়ি একটিও থাকে না, কোনোকালেই ।

“নমাজকে বোলো না আমার এখন কাজ আছে, বরং কাজকে বোলো আমার এখন নমাজ আছে”, শরিফৎ মসজিদের প্রবেশদ্বারেই চোখে পড়ল। এমনিতে বাড়িতে থাকলে জুম্মাবারে আমি যাই মসজিদে, বাকি দিনগুলি যাওয়া হয় না। কিন্তু এখানে বাক্যটির গভীরতা ছুঁয়ে গেল অন্তর। ভেতরে প্রবেশ করে আরও অবাক হওয়ার পালা। মসজিদ চত্বরেই আস্ত একটি পাঠাগারের অবস্থান, মসজিদ কর্তৃপক্ষই যার পৃষ্ঠপোষক। খবর নিয়ে জানা গেল, ধর্মগ্রন্থের পাশাপাশি অন্য বইপত্রও এখানে রাখা হয়। আমি বরাবর বিশ্বাস করি, ধর্মগুরু এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠানের সদিচ্ছায় সমাজের বহু ভালো হতে পারে, কারণ জনমানসে তাদের প্রভাব অনস্বীকার্য। সেই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে যদি তারা জনগণকে ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলত তা হলে দেশ ও দশের উন্নতি হত একযোগে।

শ্রীশ্রীঅদ্বৈতপাট বা বাবলা মন্দির ছায়ানিবিড় এক আমবাগানে। নির্জন শীতল এই আমবাগানেই নাকি একদা হয়েছিল নকশাল ও রাষ্ট্রযন্ত্রের গুলির লড়াই। সে গুলির দাগ বা আস্ত বুলেট এখনও মেলে কোনো কোনো গাছের কোটরে। ভাগীরথী কোনো এক সময় বইত এই বাবলা পাটেরই পাশ দিয়ে, মন্দিরের ভিতর থেকে সেই পরিত্যক্ত নদীখাতটি স্পষ্ট বোঝা যায়। তিন প্রভুর মিলনস্থল এই পাটেই। বৈঞ্চব চূড়ামণি অদ্বৈতাচার্যকে গৌর আনা ঠাকুর বলা হয়, কেননা তিনিই প্রথম অনুভব করেছিলেন নবদ্বীপের নিমাইয়ের মধ্যে কৃষ্ণের অস্ত্বিত্ব। বিধর্মী যবন হরিদাসকে নিজ গৃহে নিমন্ত্রণ করে তৎকালীন ধর্মরক্ষকদের বিরাগভাজনও হন তিনি। কিন্তু আগাগোড়া ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে অটল। আধুনিক পৃথিবীতে বব ডিলানের গানকে সাহিত্য মেনে নিয়ে যদি নোবেল প্রদান করা হয়, তা হলে চৈতন্যদেব ও তার সতীর্থদের নাম সংকীর্তন বা বৈষ্ণব পদাবলি কোন্ অর্থে সাহিত্য নয়, সে প্রশ্ন আমাদের তোলা উচিত। একটা বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে এ সুর আর গীতির প্রভাব কোনো ভাবেই আমরা অস্বীকার করতে পারি না কিন্তু।

অদ্বৈতপাটের পর বড়ো গোঁসাইবাড়ি। এখানে রয়েছে হাজার বছরের পুরোনো শ্রীরাধারমণ বিগ্রহ যিনি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে পুরীতে পূজিত হতেন দোলগোবিন্দ নামে। আনুমানিক তিনশো বছর আগে এই কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে শ্রীমতি বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হয়। শ্রীরাধারমণ-শ্রীমতি বিগ্রহই হলেন শান্তিপুরের ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাসোৎসবের পুরোধা বিগ্রহ। এ ছাড়া রয়েছেন বাল্মীকি বর্ণিত সবুজ রঙের রঘুনাথ রাম এবং শ্রীযড়ভূজ মহাপ্রভু। শোনা যায়, জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা শ্রীচৈতন্যদেবকে মন্দিরপ্রবেশে বাধা দিলে তিনি এই রূপ ধারণ করেন, যেখানে তিনি রাম ও কৃষ্ণের প্রতিভূ। গোঁসাইবাড়ির বাইরেই বিরাট রাসমঞ্চ। তবে আমার নিজের বড়ো গোঁসাইবাড়ির তুলনায় গোকুলচাঁদ বাড়ির মন্দিরটি ভালো লাগল। একই ধরনের দু’ দু’টি আটচালা মন্দির, আশেপাশে গোস্বামীদের বসবাস, অবস্থান, পরিবেশ এবং বছরভর গোঁসাইবাড়ির সম্ভাব্য অদেখা নিষ্ঠার কথা স্মরণ করেই মনটা উদাস হল।
আরও পড়ুন: কৃত্তিবাস ও গোঁসাইবাড়ির শান্তিপুর : প্রথম পর্ব
পাঠকের হয়ত জানা আছে, তিন তিনটি গিনেস রেকর্ডের মালিক ফুলিয়ার মানুষ। সব চেয়ে বড়ো জাতীয় পতাকা উত্তোলন, দীর্ঘতম আলপনা এবং বৃহত্তম রসগোল্লার রেকর্ড ফুলিয়ার দখলে। ‘রসগোল্লা’ নিয়ে হইচইয়ের সময় এলাকাবাসী দাবি করে রসগোল্লার উৎপত্তি শান্তিপুরের ফুলিয়ায়। খানকয়েক খেয়েও দেখলাম, দারুণ, একেবারে বেলডাঙার মতো!! তবে খেজুর রস থেকে তৈরি ‘দোবড়া চিনি’ নিরুদ্দেশ। কোনো এক কালে ছিল সেটাই একমাত্র সান্ত্বনা।

পুরোনো শহর শান্তিপুর। ধর্মচর্চার পাশাপাশি নানা কৃষ্টি সংস্কৃতিরও অনুশীলন চলে সারা বছর। নানা বাড়ির দোল নিয়ে প্রায় মাসখানেক ধরে চলে দোলযাত্রা। শহরের রাষ্ট্রীয় উদ্যানে শান্তিনিকেতনি অনুকরণে পালন করা হয় বসন্ত উৎসব। মোড়ে মোড়ে মহল্লায় মহল্লায় দশ বারো ফুট উচ্চতার গোপাল গড়া হয়। রাস্তাঘাট, আলোর ব্যবস্থা ও তদারকির পাশাপাশি নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের দিকেও নজর রাখে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় পৌরসভা শান্তিপুর। সাংস্কৃতিক মঞ্চ, প্রেক্ষাগৃহ ও ‘কলা তীর্থ’ নামে আর্ট গ্যালারি নির্মিত হয়েছে পৌরসভার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে। ভবিষ্যতের নাগরিকদের নিজ শহরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য পৌরসভার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আমাদের শান্তিপুর’ নামে একটি পাঠ্যবই যা শহরের বিদ্যালয়গুলিতে পড়ানো হয় পঞ্চম শ্রেণিতে।
শেষ লগ্ন উপস্থিত। এক দিনের ঝটিকা শান্তিপুর সফরে সমৃদ্ধ হলাম দারুণ ভাবে। দুর্দান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হয়তো নেই, অনেকক্ষণের ট্রেনপথ, কাজ থেকে ছুটি নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার আকুলিবিকুলিও হয়তো এখানে দরকার পড়বে না, একটুখানি খ্যাপামি, কিছুটা সদিচ্ছা আর কিছুটা নিকটবর্তী জনপদের প্রাত্যহিক রোজনামচা দেখার বাসনাই আপনার মনকে দেবে অমূল্য প্রসন্নতা যা অনেক সময় ব্যয়বহুল ভ্রমণেও মেলে না। বেড়ানোটা আসলে নিজের ওপর বিনিয়োগ করা, সেই কথাটা মনে রেখে তাই স্বপ্ল বিনিয়োগেই সপ্তাহান্তে ঘুরে আসতে পারেন ‘শান্তিপুর’, মানসিক ও ভ্রামণিক শান্তির সন্ধানে। (শেষ)

কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদহ থেকে সরাসরি ট্রেন, ধর্মতলা থেকে বাস চলে শান্তিপুর। আবার হাওড়া থেকে ট্রেন ধরলে গুপ্তিপাড়া বা কালনা নেমে ভাগীরথী পেরিয়েও আসা যায় শান্তিপুর। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে কলকাতা থেকে শান্তিপুর ৯৬ কিমি, গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যায়, পথ বারাসত-চাকদা-রানাঘাট-ফুলিয়া হয়ে।
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য পৌরসভার অতিথি নিবাস রয়েছে, ফোন-০৩৪৭২-২৭৮০১৮, ২৭৭৪০১। এ ছাড়াও শহরের মোতিগঞ্জ এলাকায় বেশ কিছু বাজেট হোটেল আছে।