নবাবি শহর মুর্শিদাবাদে : প্রথম পর্ব

papiya mitra
পাপিয়া মিত্র

ভোর পৌনে পাঁচটায় ফোন বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে ঝনঝনে আওয়াজ — বেরিয়ে আয়, গেটের বাইরে আমরা। ছ’ সিটারের গাড়িতে ততক্ষণে পাঁচটি আসন পূর্ণ। আশপাশের ভোরের ঘুম ভাঙিয়ে একটা উলুধ্বনি দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল। কলকাতা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়েই ছিল। কিন্তু নিজেদের উল্লাস ধরে রাখতে পারছিল না দলটা। তাই কলবল করতে করতে অনেক সময় কাটিয়ে ফেলার পরে হঠাৎ চোখে পড়ল সামনেই লালগোলা প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়ে।

এই নিয়ে দু’বার সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে থেকে ঘুরে এসেছেন মিসেস দত্ত। সঙ্গে ছিলেন বোনঝি। কিছুই ভালো লাগে না তাঁর। একাকিত্ব গ্রাস করেছে। ছুটন্ত জীবন থেকে ছুটি পেয়ে যাওয়াটা যে একেবারেই ভালো নয়, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তাঁর কলেজশিক্ষক বোনঝি।

নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন প্রবাসী জামাইয়ের সঙ্গে। আসাযাওয়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ভালোই কাটছিল। কিন্তু ঘুমের ঘোরে ম্যাসিভ অ্যাটাক নিতে পারেননি মিস্টার দত্ত। পরের দিন ভোর থেকে সময় গড়িয়েছে ধীরে ধীরে। মিসেস দত্ত বুঝতে পারলেন কত একা নিজে। এক এক করে ফোনে খবরটা সকলকে জানালেন নিজেই। ছোট্টো সংসারে দৌড়চ্ছিলেন বেশ। কিন্তু হঠাৎ করে সব শান্ত, মেনে নিতে পারেননি একবারেই।

jahankosha
জাহানকোষা কামান।

সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী হয় প্রবাসে যাওয়া, নয়তো নতুন করে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে নেওয়া। মেয়ের কাছে তো যাওয়া আছেই। সেটা যেমন আছে তেমন থাক। বরং…হ্যাঁ, হঠাৎ করে স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে গেল এক দুপুরে। ওষুধ খেয়ে ও বোনঝির সঙ্গ পেয়ে ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠছিলেন মিসেস দত্ত। আজকাল স্যোশাল মিডিয়ার দৌলতে যোগাযোগের পথ বেশ সুগম হয়েছে। বোনঝি দু’টি অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে ফেসবুকে আর হোয়াটসওয়াপে। স্কুলের, পাড়ার বন্ধুদের এখন যখনতখন, রাতবিরেতে এমনকি মেয়েজামাইয়ের দেখা মিলছে ঘনঘন। ট্রেনে বন্ধুদের সঙ্গে মিসেস দত্ত, বেশ কয়েকটি ছবি পাঠালেন মেয়ে ও বোনঝির কাছে।

কলকাতা থেকে মাত্র ১৯৭ কিলোমিটার দূরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের স্মৃতি বিজড়িত মুর্শিদাবাদের পর্যটন আকর্ষণ আজ দুর্নিবার। স্কুলের বইয়ের কথা, মেয়েকে পড়ানোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে হাজারদুয়ারী, ঘড়িঘর, বড়ো ইমামবাড়া। পাশাপাশি ক্লাসে বসা, দু’বেণী করা কণিকাই প্রথম হুজুগটা তুলেছিল। তার পর থেকে শুধু এগিয়ে চলা আর চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী মনে জোর আনা। কণিকাই মনে করিয়ে দেয় ওষুধ খাওয়ার কথা। দলে শুরু হয়ে গিয়েছে গানের প্রতিযোগিতা। দল বড়ো হয়েছে সহযাত্রীরা যোগ দেওয়ায়। সময় কেটে যাচ্ছে হু হু করে।

মুর্শিদাবাদের পৌর অতিথি নিবাস ‘নেতাজি আবাস’ লালবাগের নেতাজি রোডে, এসবিআই-এর বিপরীতে। রাস্তার দিকের ঘরটি বেশ আলোহাওয়া পূর্ণ। তবে এ শুধু থাকার জন্য। তাই খাওয়া অন্যত্র। সেখানেই ঠিক করে নেওয়া হল কোথায় কোথায় যাওয়া হবে। সংসার থেকে দু’দিনের ছুটি মিলেছে সকলের।

inside katra mosque
কাটরা মসজিদ।

মধ্যাহ্নভোজের পর দলে হুড়োহুড়ি পরে গেল টোটোতে কে কার পাশে বসবে। ঠিক হল হাজারদুয়ারী দেখা হবে পরের দিন সকালে। কারণ দশটার আগে খুলবে না। অতএব চলল টোটো গড়গড়িয়ে, প্রথম দর্শন জাহানকোষা অর্থাৎ বিশ্বজয়ী কামান। প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার দীর্ঘ, প্রস্থ দেড় মিটার ও মুখের বেড় ৪৫.৫ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় ৮ টন। প্রতি বার গোলা ছুড়তে বারুদ লাগে ৩০ কেজি। গোবরনালার তীরে দেশের সুরক্ষার্থে গড়ে ওঠে দুর্গ অর্থাৎ তোপখানা। বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর নগরের সুবেদার ইসলাম খাঁর অর্ডারে জনার্দন কর্মকার তৈরি করেন এটি। দেখে ছবি তুলে আশ মেটে না। বাড়ি থেকে এই প্রথম বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরতে আসা। সেই কবে কলেজ থেকে কবির দেশে যাওয়া, তা-ও মনে এসে ধাক্কা দেয় মিসেস দত্তর। মনে মনে বলে ওঠেন এই ভাবে ভালো থাকতে হবে।

রেলস্টেশন থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তরপুবে শহরের প্রান্তে কাটরা মসজিদ। মক্কার কাবা মসজিদের অনুকরণে মুর্শিদকুলির খাঁর হাতে রূপ পায় কারুকার্যমণ্ডিত এই মসজিদের। কড়িবরগা নেই এই খিলানযুক্ত কাটরা মসজিদে। এই মসজিদে প্রায় হাজার জনের আসন বসে কোরান পাঠে। ১৪ ধাপের সিঁড়ি নেমে গিয়েছে যেখানে সমাহিত আছেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ।(চলবে)

grave of murshidkuli khan
মুর্শিদকুলি খাঁ-এর সমাধি।

কী ভাবে যাবেন

শিয়ালদহ/কলকাতা স্টেশন থেকে মুর্শিদাবাদ ট্রেনে পৌনে চার ঘণ্টা থেকে পৌনে পাঁচ ঘণ্টার পথ। সারা দিনই ট্রেন আছে। সময় জানতে দেখে নিন erail.in

কলকাতা থেকে বাসেও যেতে পারেন মুর্শিদাবাদ। এসপ্ল্যানেড থেকে সারা দিন নানা সরকারি, বেসরকারি বাস ছাড়ে বহরমপুরের উদ্দেশে, দূরত্ব ২২৮ কিমি। সেখান থেকে লালবাগ ১১ কিমি। বাস আছে। গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারেন লালবাগ।

কোথায় থাকবেন

লালবাগে নেতাজি রোডে পুরসভার অতিথিনিবাসটি ভালো। যোগাযোগ ০৩৪৮২ ২৭০০৩৩। এ ছাড়াও বেশ কিছু বেসরকারি হোটেল ও লজ আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোটেল সাগ্নিক (www.hotelsagnik.com), হোটেল গ্রিনহাউস (www.murshidabadhotelgreenhouse.in), হোটেল ইন্দ্রজিৎ (hotelindrajit.in), হোটেল রেমন্ড (www.hotelraymond.com), সৌরভ লজ (www.souravlodge.com), হোটেল মঞ্জুষা (hotelmanjusha.com), হোটেল অন্বেষা (hotelanwesha.com), নিরঞ্জন নিবাস লজ (যোগাযোগ ০৯৭৩২৭ ৬৫৬৩১) ইত্যাদি।

এ ছাড়াও বহরমপুরে থাকতে পারেন। রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের টুরিস্ট লজ। অনলাইন বুকিং www.wbtdcl.com । অনেক বেসরকারি হোটেলও আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *