
দুই বাংলার কাঁটাতার গলে অশ্রুধারার মতো নেমে এসেছে তিনটে নদী – টাঙ্গন, পুনর্ভবা আর আত্রেয়ী। বুনিয়াদপুর থেকে জাতীয় সড়ক ধরে বালুরঘাটের দিকে গেলে এরা তিনজনই একে একে এসে ধরা দেয়। ইতিহাসের চোরাস্রোতে তলিয়ে যাওয়া কত গল্প বলে। গঙ্গারামপুর থেকে শিববাটির রাস্তাটা উত্তরে পুনর্ভবার গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে সীমান্তের দিকে। সেই পথে কিছু দূর এগোতেই আর্কিওলজিকাল সার্ভের নীল সাইনবোর্ড জানিয়ে দিল আমরা বাণগড়ে পৌঁছে গিয়েছি। বাণগড় – দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শনক্ষেত্র।
একটা প্রাচীন বটগাছ পেরোতেই অনেকটা এলাকা জুড়ে ধু-ধু প্রান্তর। কিছু বিক্ষিপ্ত প্রাচীর ক্ষেত্রটার সীমা নির্দেশ করছে। সেই ধার বরাবর পরিখার অস্তিত্ব স্পষ্ট বোঝা যায়। মাঠে নানা আকারের ঢিপি। তারই কয়েকটাতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পুরাতাত্ত্বিক খননের কাজ হয়েছে। জেগে উঠেছে পোড়ামাটির ইটের তৈরি সব জ্যামিতিক কাঠামো। মৌর্য থেকে তুর্কি পর্যন্ত কমবেশি দেড় হাজার বছর সময়কালের মধ্যে পাঁচটা শাসনযুগের সাক্ষ্য এরা বহন করছে। গুপ্তযুগে বৃহত্তর পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ শাসনবিভাগ বা ‘বিষয়’ ছিল ‘কোটিবর্ষ’। পূর্ববর্তী মৌর্য শাসনকালে এই কোটিবর্ষের নাম ছিল ‘দেবীকোট’ বা ‘দেবকোট’। ঐতিহাসিক মতে, বাণগড় ছিল কোটিবর্ষের রাজধানী আর বাণগড়ের এই প্রাচীরঘেরা ক্ষেত্রটাই প্রাচীন দেবীকোট বা কোটিবর্ষের অন্যতম প্রধান শাসনকেন্দ্র।

বাণগড় অঞ্চল হয়ত আরও অনেক বড়ো, তবে এই স্থানেই তার মূল ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। খননের সময় দুর্গ-সদৃশ এই এলাকায় শহরকেন্দ্রিক জীবনধারার নানা ছবি ধরা পড়েছে। মাটির কেল্লা সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে ক্রমে ইটের গড় হয়ে শক্তিবৃদ্ধি করেছে। শস্যাগার, পয়ঃপ্রণালী, জল সরবরাহের ব্যবস্থা রীতিমতো আধুনিকতার চিহ্ন বহন করে। তবে এর সবই হল খনন করা ঢিপিগুলো থেকে পাওয়া নিদর্শন। আরও অনেক ঢিপি একেবারে অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। সেগুলোর মাথায় পোড়ামাটির আভাস স্পষ্টই জানান দিচ্ছে তারা আরও অজানা ইতিহাস প্রসব করতে প্রস্তুত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খলজি সেন বংশের রাজাদের পরাজিত করে বাংলায় মুসলমান শাসনের পত্তন করেন। তখনও এখানে বসতি ছিল। বখতিয়ার পরে এই অঞ্চলের কাছাকাছিই গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন এবং পুনর্ভবার তীরে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
ঐতিহাসিক তথ্যের স্বল্পতার কারণে বাণগড়কে জড়িয়ে নানা পৌরাণিক গল্প আর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া কিছু মিথ তৈরি হয়েছে। শোনা যায়, এখানে নাকি বাণরাজার রাজত্ব ছিল। রাজার নামেই তাঁর রাজ্য। শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র অনিরুদ্ধ রাজার কন্যা ঊষাকে বাণগড় থেকেই হরণ করেছিলেন। স্থানীয় একটা রাস্তার নামও নাকি ঊষাহরণ রোড। ‘পাথরের কলাগাছ’–এর গল্প শুনে উৎসাহিত হয়ে চলে গিয়েছিলাম পাশের আদিবাসী গ্রামে। পাথর বটে, রীতিমতো গ্র্যানাইটের, তবে কলাগাছ নয়। এরা আসলে চারটে স্তম্ভ। সম্ভবত কোনো প্রাচীন বিষ্ণুমন্দিরের অবশেষ।

‘সংরক্ষিত এলাকা’ বাণগড় বিস্ময়কর ভাবে অসংরক্ষিত। এখানে মানুষ আর ইতিহাসের অবাধ সহাবস্থান। মাঠে ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশেই চাষ হচ্ছে, ছাগল চরছে। আদিবাসী গ্রামের অনেক বাড়ির দেওয়ালেই দেখলাম বাণগড়ের থেকে খুলে নিয়ে যাওয়া ইট। দিনকয়েক আগে সোনার মোহরসহ এক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করেছিল। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, সেই মোহরও নাকি এখান থেকেই পাওয়া। মাঠের কিছু জায়গা বেদখল হয়ে গেলে তার তলায় লুকিয়ে থাকা ইতিহাস হয়তো আর কখনোই জানা যাবে না। আর একে সুরক্ষিত না রাখতে পারলে বিজ্ঞানভিত্তিক খননের আগেই অনেক অজানা ইতিহাস হাতে হাতে পাচার হয়ে যাবে। তবে সুরক্ষার এই গুরুত্বকে সরিয়ে দিলে মনে হয়, এটাই বাস্তব। সমস্ত শাসনদম্ভের হয়তো এই শেষ পরিণতি। তাই যে দুর্ভেদ্য দুর্গে এক সময় অস্ত্র আর চাবুকের শব্দ শোনা যেত, আজ তার ভাঙাচোরা বুক চিরে চলে গরিবের লাঙল, গোরু তার খাদ্যাবশেষের চিহ্ন রেখে দেয়। ঢিপির ঢাল ধরে কোদাল হাতে চলা কৃষক-দলকে দেখে আবারও কবির লেখা মনে পড়ে যায় – “শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে, ওরা কাজ করে”।
ছবি: লেখক