করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/৩: তিনটি প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে

অশোককুমার কুণ্ডু

এ বার এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। প্রথমত, সুপার স্প্রেডার করোনা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। কুম্ভের হরিদ্বার তার বাইরে নয়। ভক্তি বড়ো, না ভক্তের জীবন বড়ো? করোনা কিন্তু চতুঃসম্প্রদায়, দশনামী, বৈরাগী (বৈষ্ণব), উদাসীন, গুরু-শিষ্য – কাউকেই ছাড়ছে না। না, ছাড়ছে না রাজা-উজির কাউকেই।

তা হলে ধর্মগুরুকুল কেন এই কুম্ভস্নান বন্ধ রাখলেন না? প্রতীকী পুণ্যস্নান করে, তেরো আখাড়ার প্রধানরা জলে ডুব দিয়ে করোনা-মুক্তির প্রার্থনা করতে পারতেন। এই প্রশ্নের উত্তর মিশে আছে হরিদ্বার কুম্ভের (২০২১) সোয়া চার হাজার কোটি টাকার বাজেটে। দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি – কুম্ভ বন্ধ রাখার ক্ষমতা কারও নেই। দরকার হলে, সোয়াশো কোটি ভক্ত, আমজনতা ‘সিয়ারাম’ হোক। কুম্ভ বন্ধ করতে হলে মসনদ উলটে যাবে। কুম্ভ বন্ধ হলে ওই সোয়া চার হাজার কোটির ভাগবাঁটোয়ারা কী ভাবে হবে? আসুক সুপার ডুপার স্প্রেডার করোনা। মরুক কিছু লোক। তা নিয়ে ছাতারে পাখির কামড়াকামড়ি চলবে টিভিতে। এই তো আমার মহান ভারতবর্ষ।

কুম্ভস্নান বন্ধ হলে বিভিন্ন ধর্মীয় দলের নেতারা পরস্পরকে ছিঁড়ে খাবে। ও দু’-চারটে, দশ-বিশটা করোনার লাশ ভেসে যাক গঙ্গায়। ছিঁড়ে খাক কুকুর-শিয়াল-শকুনে। জীয়ন্তেই জীবনের দাম নেই। মুরদার, প্রাণহীনের আবার দাম কী? ক’ দিন মিডিয়া চিল্লাবে, চিল্লাক। তার পরে আবার নতুন খেলা। নতুন গল্প। নতুন সওয়াল-জবাব। নতুন অদূর দর্শনে। নেট-পাড়ার বীরেরা ড্রয়িংরুমে বসে চিল্লাবে। আবার নব গ্রাউন্ড-জিরোর খোঁজ। গ্রাউন্ড-জিরো থেকে আমরাই প্রথম।

ধর্মগুরুদের অমৃতবাণী

গ্রাউন্ড-জিরো। নতুন এক্সক্লুসিভ। নির্বোধ এবং অবিবেচকের যৌথ প্রয়াসে করোনা তাড়ানোর যাগযজ্ঞ। একই সঙ্গে করোনা ভ্যাকসিনের জন্য চিৎকার। এবং ধর্মগুরুরা গলায় সাড়ে বত্রিশ ভরির হার পরে আমজনতার উদ্দেশে টিভিতে অমৃতবাণী বিলোচ্ছেন, “মাস্ক পরে স্নান করো। জলে দূরত্ব বজায় রেখে ডুবকি মারো।” উনি দেখতে পাচ্ছেন জলে লক্ষণরেখার বৃত্ত স্পষ্ট ভাসছে। এ সব ধর্মগুরু গৃহস্থের মঙ্গল করে স্বপ্নরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। এবং স্নান করা, না-করা নিয়ে ঐকমত্য হবে না তেরো আখাড়া এবং অসংখ্য ধর্মীয় দল-উপদলে। সে-ও ওই বস্তু-সম্পদ বা বাসি বিবাদ। না-মেটা পুরাতন শোক-উল্লাস। সুতরাং করোনা-কুম্ভ চলবে হরিদ্বারের অমৃতস্নানে। গঙ্গামাঈয়ের আশীর্বাদে করোনার জীবাণু মরে ধুয়ে মুছে ভেসে যাবে। আপাতত স্নান চলুক। যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতা এই সব বাণী দিচ্ছেন, তাঁরা স্ত্রী-পুত্র-পরিবার-কন্যা নিয়ে ওই ভিড়ে স্নান করে ভক্তিটা দেখাতে পারতেন। সে গুড়ে বালি।

প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন যে হেতু অবিচ্ছিন্ন, তাই একই সঙ্গে উত্তর দেওয়া হল। দীর্ঘ উত্তর।

তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ                                    

এ বার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান-অধিষ্ঠান, যার উপর নির্ভর করে কুম্ভমেলা। শুধু কুম্ভমেলা কেন, সমস্ত ভারতীয় কাজে প্রথমে আসে ব্রাহ্মণ এবং তার সঙ্গে পঞ্জিকা। তা না হলে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ যাবে, তারও যাত্রার মঙ্গলমুহূর্ত নির্ণয় করা হয় পঞ্জিকা থেকে। রকেট ফেটে গেলে টেকনিক্যাল ফল্ট। সফল হলে পঞ্জিকা নির্দেশিত শুভকাল এবং প্রচারক ব্রাহ্মণের মন্ত্রযশ। হায় রে আমার হতভাগ্য স্বদেশ-সমাচার।

এই পঞ্জিকাতেও আছে নানা প্রাদেশিক বিবাদ। কেউ কাউকে মানে না। এই বিবাদ মেটাতে প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। তিনি দায়িত্ব দেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে। তৈরি হয় ‘রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ’। সেটা করতে গিয়ে প্রচুর বিবাদ-বিপত্তি। প্রধানমন্ত্রী ও বিজ্ঞানী বিব্রত বোধ করেন। অবশেষে ‘রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ’ অনুমোদিত হয়। ভারত সরকারের পাবলিকেশন বিভাগ থেকে আজও প্রকাশিত হয়ে আসছে এই বাৎসরিক পঞ্জিকা। তবে এই পঞ্জিকা যতটা না হিন্দুধর্মের অনুসরণ করেছে, তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান তথা অ্যাস্ট্রোনমি চর্চায়। অবশ্যই গ্রহ-নক্ষত্রের চর্চা আছে বই-কি! কিন্তু আধুনিক ভারতের দুর্ভাগ্য, সে হেরে গেল প্রাচীন ভারতের একাধিক ধর্মবিশ্বাসের কাছে। ‘রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ’ ভারতীয় সমাজ মেনে নিল না।

তৃতীয় প্রশ্ন, হরিদ্বারের পূর্ণকুম্ভ এক বছর এগিয়ে এল কেন এবং কী ভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে ২০১০-এ হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে পুণ্যস্নানের দিনগুলো কী ছিল, তা এক বার দেখে নেওয়া যাক –

(১) ১২ ফেব্রুয়ারি – মহাশিবরাত্রি, প্রথম শাহি বা প্রধান স্নান।

(২) ১৫ মার্চ – সোমবতী অমাবস্যা, দ্বিতীয় শাহিস্নান।

(৩) ১৬ মার্চ – নও সম্বত (রাজা বিক্রমাদিত্য প্রচলিত ক্যালেন্ডার সম্বত তথা বিক্রম সম্বত মোতাবেক নববর্ষ)। পূর্ব ভারত ও দক্ষিণ ভারত ছাড়া ভারতের অন্যত্র এই ক্যালেন্ডারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, গুজরাত প্রভৃতি রাজ্যে নববর্ষ বলতে এই দিনটিকেই বোঝায়।

(৪) ২৪ মার্চ – শ্রীরামনবমী। বৈষ্ণবদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

(৫) ৩০ মার্চ – চৈত্র পূর্ণিমা।

(৬) ১৪ এপ্রিল – মেষ সংক্রান্তি তথা চৈত্র সংক্রান্তি, তৃতীয় শাহিস্নান।

(৭) ২৮ এপ্রিল – বৈশাখ অধিবাস, পূর্ণিমা।

২০১০ খ্রিস্টাব্দের এই স্নানপঞ্জি প্রকাশ করেছিল উত্তরাখণ্ড সরকার। এটা মনে রাখা দরকার, শিবরাত্রি, সোমবতী অমাবস্যা এবং নও সম্বতের দিনগুলোয় স্নান চলবে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের যে তারিখেই পড়ুক না কেন। আর হরিদ্বারে শাহিস্নানের সংখ্যা তিনটিই। এই সংখ্যা অপরিবর্তিত।

১৪ জানুয়ারি (মকরসংক্রান্তি), ১৫ জানুয়ারি (মৌনী অমাবস্যা), ২০ জানুয়ারি (বসন্তপঞ্চমী) ও ৩০ জানুয়ারি (মাঘীপূর্ণিমা) –  এই চারটি দিনকে স্নানপঞ্জিতে যোগ করেছে সরকারি বিভাগ। এগুলি পুণ্যস্নান অবশ্যই। তবে তা হরিদ্বারের পূর্ণকুম্ভের স্নানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে গ্রহ-নক্ষত্র, তার ভালো-মন্দ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে যিনি নাড়াচাড়া করছেন সেই বন্ধুবর গোঁসাইজির কাছে। আধুনিক আকাশচর্চার কথা শুনিয়েছেন। পুরো নাম রজত গোস্বামী। এবং গ্রহ-নক্ষত্র-আকাশ চর্চায় রত স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ঢাকুরিয়া, কলকাতা) প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাসুদেব ভট্টাচার্য। অশীতিপর যুবক। এখনও ক্যাম্পে যান। আমি একাধিকবার ওঁর বাড়িতে গিয়েছি। বহু বার ফোনে উত্ত্যক্ত করেছি। কানে শোনা তথ্য লিখে ডাক যোগে বা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে অথবা কাছে গিয়ে সংশোধন করে নিয়েছি। বাসুদেবদা সত্যিকারের শিক্ষক। পুরাতন মানুষ বলেই সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞান ভালো ভাবে পড়েছেন। ফলে ত্রিধারায় নেই বিরোধ। তবে বিজ্ঞান অগ্রে।

বাসুদেববাবু জানালেন, অন্যান্য কুম্ভমেলার মতোই হরিদ্বারের দু’টি পূর্ণকুম্ভের মধ্যের সময়ের ব্যবধান ঠিক ১২ বছর (প্রধানত আমরা বলি বারো বছর এক যুগ) নয়, ১১.৮৬ বছর অর্থাৎ ১১ বছর ১০ মাস। এ বার এই সামান্য ভগ্নাংশ, প্রায় ২ মাসটাই ৬ নং (ষষ্ঠ, ২০২১–এর পূর্ণকুম্ভ ছেড়ে দিয়ে ধরলে) পূর্ণকুম্ভে ২X৬=১২ মাস এগিয়ে আসবে। একমাত্র হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভেই এই ঘটনা ঘটবে। অর্থাৎ সেই পূর্ণকুম্ভ হবে আজ থেকে ৭১ বছর পরে।

রজত গোস্বামীর মতে, হরিদ্বারের পূর্ণকুম্ভমেলার আবশ্যিক শর্ত দু’টি। প্রথম শর্ত: বৃহস্পতি গ্রহ থাকবেন কুম্ভ রাশির ঘরে। দ্বিতীয় শর্ত: রবি বা সূর্য থাকবেন মেষ রাশির ঘরে। সূর্যের অবস্থানেই মাস চিহ্নিত হয়। ফল রবি (সূর্য) যখন মেষ রাশির ঘরে তখন বৈশাখ মাস।

হরিদ্বারে ২০২২ সালে (আগের পূর্ণকুম্ভ হয়েছিল ২০১০ সালে। সাধারণ নিয়মে ১২ বছর বা এক যুগ পরে পূর্ণকুম্ভ) না হয়ে ২০২১ সালে হল। ২০২২ সালে হবে না। কারণ যে দু’টি প্রধান আবশ্যিক শর্ত, তার একটি পূরণ হবে না। কারণ বৃহস্পতি ঘর পরিবর্তন করবেন। ভিন্ন ঘরে তথা মীন রাশির ঘরে চলে আসবেন।  

অবশ্য ৭১ বছর পরে আমি দেখতে আসব না। দেখতে হলে আমাকে ১৪১ বছর পরমায়ু পেতে হয়। সত্তরে পা দিয়েছি। পেতাম এই পরমায়ু। দেবতারা বিট্রে করল। অমৃতের ছিটেফোঁটাও দিল না। অথচ পরিশ্রম করলাম। আধাআধি বখরা হল না। চিরকাল দেবতারা ঠকিয়েছে অসুরদের, আমাদের মতো অ-ব্রাহ্মণ প্রান্তবাসী শূদ্রদের। এটি অবশ্যই নিতান্তই লেখকের মত।

এ বছর কিছু সংবাদমাধ্যমে খবর হল, সন্ন্যাসীকুল ও একটি রাজনৈতিক দলের যোগসাজশে কুম্ভমেলা এক বছর এগিয়ে এনে এ বছরে করা হচ্ছে। এটি ২০২২ সালেও করা যেত। তাদের বলি, পঞ্জিকা না মানলে কুম্ভমেলা যে কোনো সময়ে করা যেতে পারে। কিন্তু গ্রহ-নক্ষত্র-রাশিরা রাজনৈতিক দল, পণ্ডিত সম্পাদক, মন্ত্রী-ষড়যন্ত্রী, কারও কথাই যে শোনেন না। এমনকি বক্রীগতি বা বক্রগতির পরে, কুম্ভের কাছে বৃহস্পতির ‘দ্বিতীয়’ বার ফিরে আসাকে মান্যতা দেওয়া হয় না। সুতরাং ২০২২ সালে কুম্ভযোগ সঠিক নয়। আবার বলি, শাস্ত্র মানলে ২০২১ সালটাই কুম্ভের সঠিক সময়। (চলবে)

আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *