করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/২: ‘থ্রি বেডেড উইথ অ্যাটাচড বাথ’-এ আমি একা

অশোককুমার কুণ্ডু

জ্বালাপুরে নেমে সে কী কেচ্ছা, সীমাহীন! একে গন্তব্যচ্যুত মানুষ, তার ওপর মধ্যদুপুর এবং ক্ষুধার্ত। এর মধ্যে অনেকেরই দু’ ডোজের সার্টিফিকেটও রয়েছে। তা হলে কেন এমন হয়রানি করবে সরকার? মজার ব্যাপার, ভুল হিন্দিতে গজরাচ্ছে। টনটনে জ্ঞান। উত্তরাখণ্ড। রেগেমেগে বাঙালি ইংরেজি বলেনি। সকলের হিন্দি শুনে আমি বোবা। কারণ আমার হিন্দি ইহার চেয়েও খারাপ। মাথা গরম করে লাভ নেই। নিমের হাওয়া ভালো। বাঁধানো গোলাকার চাতালে বসলাম। ব্যতিব্যস্ত মানুষদের দেখছি। নিম পেড়ের নীচে বসে, পক্ব পত্রের মতো।

অসংখ্য গোলাকার ছাতার তলে সুন্দর যুবক-যুবতীরা টেস্টটিউব হাতে। তাঁদের গাইড করছেন সিনিয়র বয়স্করা। অনেক ছাতা গোটা জায়গাটায়। টেস্ট করাও। সরকারি বাস দাঁড়িয়ে। মুফতে জ্বালাপুর থেকে হরিদ্বার স্টেশনের কাছে পৌঁছে দেবে। হুড়মুড়িয়ে সেই বাসে। কে জানলার ধারে বসবে। কে সামনে বসবে। কে পরের বাসে যাবে। মানুষ, আমজনতা আসলে এক অবিবেচক অস্থির প্রাণী। মনে হল আমার, দূরে বসে দেখতে দেখতে।

নিমগাছের পাতা ঝরে পড়ছে। একটা আমগাছে কচি আমের শুঁটি। দূরে একটা ছাতার নীচে সুদৃশ্য – এক জোড়া প্রেমে ডুবে। দেখো বাপু, টেস্টে ভুল কোরো না। কত রকম মুখের লাইন-ড্রয়িং। গলা থেকে লালারস নেওয়ার পরে সে এক যন্ত্রণা। তুলো-সহ দণ্ড ঢোকানোর এবং বের করার পরে মুখে বিরক্তির চরাচর। কে একজন হেঁচে ফেলল। সর্বনাশ! ভাগ্যিস, প্লাস্টিক দণ্ড বের করে নিয়েছিল। প্লাস্টিক না কাচ, কে জানে। ভেঙে গেলে এই বিদেশবিভূঁইয়ে কী হত কে জানে?

সংসার সমুদ্রমন্থনে নারী

সেই রিপোর্ট হাতে আসেনি তখনও। স্বামীর সংশয়, আশঙ্কা। “যদি এখানের রিপোর্টে করোনা পজিটিভ হয়? তখন কী হবে? কলকাতায় এক বার একই জিনিসের দু’ রকম হল না সে বার? কী একটা সুগার না কী যেন? মনে নেই?”

স্ত্রী উত্তর দিলেন – “তোমার যেমন মাথা। এখানের রিপোর্টটা মা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেব। আর কলকাতার নেগেটিভটা দেখাব।” সত্যিই নারীর বৈষয়িক বুদ্ধি!

“তা হলে এখানে আবার টেস্ট করানোর দরকার কী ছিল?” স্বামীর বিরক্তিকর প্রশ্ন আবার। তবে স্ত্রীর উত্তরখানি খাসা। “তোমার যেমন বুদ্ধি! কী করে অপিস চালাও। গোটা অপিসটাই কি তোমার মতন? বলি, কলকাতায় তো প্রাইভেটে কত টাকা নিয়েছিল দু’ জনের টেস্টে! এখানে তো নিখরচায়। বুঝলে না?”

আমি বুঝলাম। ওঁর উনিও বুঝলেন কি না জানি না। তবে এই জীবনের সারাংশ, অমৃত, নারী না থাকলে সংসারে সমুদ্রমন্থন এক্কেবারে দফারফা হয়ে যেত। তবে সংসারে নারী না থাকলে সমুদ্রমন্থনের দরকারই হত না। আপনা হাত জগন্নাথ। ভাতে ভাত ফোটাও। তার পর সময় হলেই ফুটে যাও।

দশ-পনেরো মিনিটেই ছাড়পত্র

“আঙ্কল, মে আই হেলপ্‌ ইউ?” ছাতার ছায়া সরিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে ডাকলেন মেডিক্যাল টিমের সুন্দরী। ভিড় অনেকটাই পাতলা। এগিয়ে গেলাম। পাশেই মেডিক্যাল ভ্যান দাঁড়িয়ে। আবার সেই গলায় কাঠি। নাকে কাঠি। সারা জীবন কাঠি করে ও কাঠি খেয়েই গেল। বিশ্বাস হবে কি না জানি না। দশ-পনেরো মিনিট পরেই এক টুকরো সাদা (সত্যিই এক টুকরো) কাগজে, রবার স্ট্যাম্প মারা, এগিয়ে দিয়ে বললেন ওই রমণী, “হো গিয়া। জাইয়ে আঙ্কলজি। বাস খাড়া হ্যায় হরিদ্বার জানে কে লিয়ে।”

জানি না, এই দশ-পনেরো মিনিটে কোভিড ১৯ টেস্ট সম্ভব কি না। মেডিক্যাল সায়েন্সের মানুষ বলতে পারবেন। চৌকো সাদা কাগজে ফরম্যাট করা আছে। নাম-লিঙ্গ-বয়স-স্থান-রাজ্য-তহশিল। পাশে বেগুনি কালিতে রবার স্ট্যাম্প মারা। রিপোর্টের ঘরে করোনা পজিটিভ বা নেগেটিভ। হাসি পেল বই-কি! পরমায়ু বোধ করি যমের হাতে। এ-ও শুনলাম, হরিদ্বারে নানা স্থানে এমন সেন্টার একাধিক। যে চিরকুট দেওয়া হল, তার পরমায়ু বাহাত্তর ঘণ্টা। আবার টেস্ট। আবার চিরকুট। আবার টেস্ট। আবার পুণ্যের ডুবকি। আবার স্রোতে অবগাহন। ও মা গঙ্গা, মাগো মা, বিচার করো মা।

ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রয়ে

ডাক্তারি পরীক্ষার পরে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে বাসে উঠলাম। কনখলের কাছে বাস থেমে গেল। আর যাবে না। এই তার সীমারেখা। এ বার রিকশা নাও। পথ ধরো। হাত-পা কাঁপছে। বাসের ড্রাইভার-কনডাক্টর বলল, এই তো কাছেই হরদুয়ার রেলস্টেশন। উঠে পড়লাম তিন চাকার রিকশায়। উঠলেই আশি থেকে একশো টাকা ভাড়া, যে যেমন পারে। এই তথ্য সকলের জানা। মেলার সময় মানুষ মুরগি। যে যেমন পারে, যাকে যেমন পারে জবাই করে, হালাল অথবা ঝটকা।

একটু পরেই পুলিশ-ঘেরাও মানে ব্যারিকেড। কারণ রিকশা ঢোকা মানা। ওদের লৌহকপাটও টপকানো যাবে না। উপায়, অনেক ঘুরে, ঘুরিয়ে নাক দেখানো। অনেক বচসা। অনেক তর্কবিতর্ক। ঘেমে একশেষ। শেষে ছাড়। রিকশা অবশ্য সংখ্যায় সামান্য। যাব মহারাজা অগ্রসেন চৌক। মহারাজার মূর্তির বামেই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ।

এক কথায়, বলাই ষাট, ষাট টাকা বলল রিকশাওয়ালা। রাস্তা সামান্যই। মেলা না থাকলে তিরিশ টাকা ভাড়া হত। তা হোক। আমরা তো শপিং মলে সায়লেন্ট, ভদ্র ক্রেতা। যত চোটপাট এই প্রান্তবাসীদের সঙ্গে। মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই ভারত সেবাশ্রমের বিশাল আশ্রম। এই ক’ বছরে আরও বড়ো হয়েছে। তবে খোলা চাতালটি বেশ বড়ো, অপূর্ব। তিনখানা আমগাছ। ভরন্ত ফলে শ্রীময়ী। আশ্রমের অফিসে কাগজপত্র সব মিটিয়ে ঘরের স্লিপ পেলাম। বলে রেখেছিলেন সঙ্ঘের বর্তমান সম্পাদক দিলীপ মহারাজজি। সহ-সম্পাদক ভাস্করানন্দজি মেলার সময় আশ্রম পরিচালনের জন্য আগেভাগে এসে গেছেন। আশ্রম ফাঁকা ফাঁকা। করোনার কারণে অনেকেই বুকিং ক্যানসেল করেছেন, শুনলাম।

বড়ো, থ্রি বেডেড উইথ অ্যাটাচড বাথ। আমি একা। দোতলায়। রয়েছে বারান্দা। হাত-মুখ ধুয়ে বড়ো রাস্তায় বের হয়ে দোসা আর লস্যি। দোসা একশো, লস্যি আশি। তবে হরিদ্বারে দুগ্ধজাত সব কিছু সস্তা ও ভালো। দুধের বেশিটাই মহিষের, গোরু কম এখানে। লস্যি খেয়ে জান তর। মশালা দোসায় মাথা ঠান্ডা। ঘরে ফিরে করোনায় বিদ্ধ হরিদ্বার কুম্ভের প্রথম দিনের বিবরণ। অনেক কষ্টে লিখলাম। কষ্ট এ কারণেই যে, যাত্রাপথের হুজ্জতি এখনও যে থিতোয়নি।

এ বারের কুম্ভের বিশেষত্ব

এ বারে এই কুম্ভ অধিকতম বিশেষ। একাধিক কারণে।

প্রথমত, এই প্রথম পৃথিবী জুড়ে অতিমারি। একশো বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুর কথা ধরছি না। যাই হোক, সেই অতিমারি থেকে তো বাইরে নয় ভারতের ধর্মশহর, কুম্ভনগরী এই হরিদ্বার।

দ্বিতীয়ত, উঠছে প্রশ্ন, পৃথিবী জুড়ে এই অতিমারি-কালে কি বন্ধ করা যেত না এই স্নান? ভারত ছাড়া অন্য সব দেশে তো জমায়েত বাতিল। সব রকমের জমায়েত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সরকারি ঘোষণায়। এ এক অদ্ভুত মন! সে দ্রুতগতির ট্রেন চাইছে, ফাইভ জিবি চাইছে, অত্যাধিক সমরাস্ত্র চাইছে। অথচ তার ধর্মীয় বিশ্বাস, ‘শিকড়ে দাঁতের পোকা বের করি মা’, ‘ভিটের দোষ কাটাই’। কিছু বলা হলে দিল্লির জামা মসজিদের জমায়েতের তুলনা টানছে সন্তসমাজ। বলছে, কুম্ভস্নানের আগে যে পশ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচ রাজ্য আর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভোটের নামে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হল, তার বিচার করবে কে। হিন্দু সন্তসমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ধর্মবাদী পুণ্যপিয়াসিরা। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক ভারতের সঙ্গে ইন্ডিয়ার, পেটকাটি-চাঁদিয়ালে।

তৃতীয়ত, হরিদ্বারে এ বার পূর্ণকুম্ভের যোগ পড়েছে ২০২১ সালে। একই স্থানে, হরিদ্বারে, গত বার পূর্ণকুম্ভ হয়েছিল ২০১০ সালে। সরল পাটিগণিতের হিসেব অনুযায়ী ১২ বছর পরে পূর্ণকুম্ভের যোগ আসা উচিত। তা হলে গ্রহ-নক্ষত্রে এমন কী বিবাদ হল যে পূর্ণকুম্ভ এগিয়ে এল এক বছর? ২০২২ সালে না হয়ে হচ্ছে ২০২১ সালে। কেন? (চলবে)

আরও পড়ুন: করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/১: হরিদ্বারে নয়, নামতে হল জ্বালাপুরে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *