করোনা-কালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে/১: হরিদ্বারে নয়, নামতে হল জ্বালাপুরে

নামতে হল জ্বালাপুরে।

অশোককুমার কুণ্ডু

চলেছি হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভের স্নানে। এই করোনা-কালে। আমার উদ্দেশ্য কিছু মহৎ না। পূর্ণকুম্ভে স্নানমেলা দেখা এবং মেলার ‘বিবরণ বেচা’ (বন্ধুর ব্যাঙ্গাত্মক শব্দবন্ধ) – একটি দৈনিক সংবাদপত্রের কাজ নিয়ে। চলো মন হরিদ্বার।

“প্রথমেই ভুল করলেন। জায়গাটা হরিদ্বার না হরদ্বার। হরি তো মথুরা-বৃন্দাবনে থাকে। হরিদ্বার হইল মহাদেবের জায়গা। আচ্ছা যাউগ্গা…।” (ভানু এল কলকাতায়)

হরি হরি। জয়গুরু। দুগ্গা দুগ্গা। যাত্রাপথের শুরুতে কোনো বাহাস-বিতর্কে জড়াব না। পথে অমঙ্গল হবে। তার পরে এই হতায়ু (শতায়ু) ঢাকাইয়া বাঙালের সঙ্গে তর্কে জড়ালে কী হতে পারে তা আমি নিরীহ ঘটি জানি। তাই খুব মাখো মাখো বিনয়ের সঙ্গে বললাম, তা যা বলেছেন হতায়ু ভানুবাবু।

ভুল, সবই ভুল। তবে হরিদ্বার রেলস্টেশনের বোর্ডে ইংরেজিতে Haridwar, হিন্দিতে হরিদ্বার লেখা। তবে উর্দুতে কী লেখা পড়তে পারলাম না। কিন্তু হিন্দুস্তানি উচ্চারণে ‘হরদুয়ার’-ই শুনেছি। এই সব আর বললাম না ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় মশাইকে।

কুম্ভের পথে ২৬ বছর

ভুলের কথা যখন উঠল, তখন দু’ ছত্তর কয়ে নিই। সেই ১৯৯৬, ইলাহাবাদ অর্ধকুম্ভ থেকে অমৃত খোঁজা। ছেদহীন, এই ২০২১ সালেও। মানে ২৬ বছর। মানে কতগুলো কুম্ভ? ধরো না কেন, ইলাহাবাদ অর্ধ-পূর্ণ-মাঘমেলা মিলিয়ে সাত বার। হরিদ্বার অর্ধ, পূর্ণকুম্ভে পাঁচ বার। নাসিক এবং উজ্জয়িনী তিন বার করে ছ’ বার। মানে, একুনে দাঁড়াল গিয়ে যাকে বলে ১৯ বার। অবশ্য চারটি কুম্ভস্থলে ক্ষেত্রসমীক্ষার জন্য চার বার যাওয়া। কুম্ভের হট্টগোলে স্পট সমীক্ষা ভালো হয় না – এ আমার অভিজ্ঞতা।

মাঝেমাঝেই মন শুধোয়, “পেলে কিছু অমৃতকুম্ভে? হাতে তবে কী?” আমি উত্তর দিই, “হাতে আছে জেল পেন।” জীবন মুচকি হাসে অন্তরালে। গেল কী? গেল তো সবই – সময়, অর্থ, পরমায়ু। পরমায়ু তো এমনিই যেত। তবে লাভ ওই অভিজ্ঞতাটুকু। আর সেই অভিজ্ঞতালাভের লোভে করোনা-আক্রান্ত কুম্ভের পথে নামা। ২০২১ সালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে। কিন্তু সেটা তো দেখা যেত নেট-টিভি-সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ সব তো ছিল। অকারণে তৎকাল-এসি করে অর্থনাশ। অবশ্য গরম পড়েছে বিস্তর। তবু এক যুগ, প্রায় ১২ বছর আগে ২০১০ সালে হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে তো এসেছিলে সাধারণ কম্পার্টমেন্টে। অবশ্য রিজার্ভ করে। তা হলে এ বার? জোশ নেই। তাকত নেই। সত্বরই পা দেব সত্তরে। ফলে এই অর্থদণ্ড দিয়েই যাত্রাপথ। অনেকটাই আরামে, এসিতে।

হয় দু’ ডোজ টিকার সার্টিফিকেট, নয় তো করোনা নেগেটিভ

কিন্তু টিকিটের এত আকাল কেন? এই করোনা-কালেও অনেকেই টিকিট কেটে রেখেছে। ট্রেনে উঠে মালুম হল, কিছুক্ষণ পরে। দু’-এক দিন আগে অনেকেই টিকিট ক্যানসেল করেছে করোনার ভয়ে। হয়তো কাগজ বা টিভি, নয়তো সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জেনেছে, হরিদ্বারে এ বছর করোনার কারণে বড়োই কড়াকড়ি। চাই দু’ ডোজ টিকা নেওয়ার সার্টিফিকেট, নয়তো হাসপাতাল-নার্সিংহোম থেকে করোনা নেগেটিভের সার্টিফিকেট। তা না হলে কোয়ারেন্টাইন। তার পর মেলায় ঘোরার অনুমতি।

১৯৫৪ সালের ইলাহাবাদ পূর্ণকুম্ভের পটস্মৃতি (অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, কালকূট) এল মনে। কলেরার ইনজেকশন নেওয়ার সার্টিফিকেট না আনলে আটকে রাখছিল মেলা কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের ত্রিপল ঘেরা খোলা জায়গায় রেখে কলেরার ইনজেকশন দেওয়া। এ বার সেই ভয়েই অনেকে পূর্ণকুম্ভের যাত্রা বাতিল করেছেন।

আমারও খেসারতের খবর বিস্তর। এ সব কড়াকড়ির কথা হরিদ্বার থেকে আগাম জানতে পেরে কলকাতার নামী নার্সিংহোমে পরীক্ষা করিয়ে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট পেতে হাজার দেড়েক। যাত্রা শুরুর দু’ দিন আগে থেকে সে কী উদ্বেগ! ট্রেন ছাড়ল দুপুরে। তখন মোবাইলের স্ক্রিনে বিজ্ঞপ্তি – আমার করোনা নেগেটিভ। অবশ্য তারও ক’ ঘণ্টা আগে রেল দফতর জানাল, আমার বগি ও বার্থ নম্বর। অর্থাৎ ওয়েটিং লিস্টের টিকিট কনফার্মড। যাক বাঁচা গেল!

বাঁচা কি পুরো গেল? না যায়? জীবনদেবতা তো আধমরা করে বাঁচিয়ে রেখেছে। বেঁচে থাকা মানে তো নানাবিধ হুজ্জত। এই যেমন, সরকারি উদ্যোগে করোনা-টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছি। দ্বিতীয় ডোজের তারিখ ছিল এপ্রিলের আট। আমার হরিদ্বার-যাত্রা শুরু এগারো এপ্রিল। তার মানে, সঠিক দিনে দ্বিতীয় ডোজ পেলে বুক ফুলিয়ে যেতে পারতাম। সরকার জানাল, আপাতত আট এপ্রিল তারিখটা বাতিল। এবং এই বাতিল না হলে আট এপ্রিল টিকা পেতাম এবং যাত্রাপথেই পেতাম দ্বিতীয় টিকার সার্টিফিকেট। তা আর হল কই?

ভারের বহর

আপাতত দুপুরের ট্রেনে উঠলাম। হাওড়া-দেহরাদুন। গনগনে হাওড়া স্টেশন ছেড়ে এসি কামরায়। বাঁচলাম ঠান্ডায়। আহ! নীচের বার্থ, পুণ্য পথের ঠিকানা। লোটাকম্বলের বহর বেশ ভালোই। একটা ট্রলি। পিঠে আধুনিক বস্তা। ডান হাতে বিগ শপার। অতিরিক্ত, নিজের ভার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভারও বেড়ে চলেছে।

এক এক সময় মনে হয় মানুষ একটি ভারবাহী প্রাণী। সে সমগ্র জীবন ধরে কত রকমের ভার বয়ে চলে। অন্যের ভার, সংসারের ভার, কর্মস্থলের ভার, নিজের ভার এবং সর্বোপরি স্মৃতির ভার। ভাঙা স্মৃতি, গোটা স্মৃতি, রক্তাক্ত স্মৃতি এবং ব্যর্থ অথচ জীবিত স্মৃতি। পথে পথিক কখনও দেখিনি যার দু’ হাত খালি। মুচকি হেসে চলেছে সে একা, নীল আকাশের নীচে। ওই মাত্র দু’ বারই সে ভারমুক্ত হয়ে দেখা দেয়। প্রথম, যে দিন সে এসেছিল। শে্‌ষ যে দিন সে চলে যায়।

সহযাত্রীরা হয়ে উঠলেন পড়শি

আপাতত যতই গন্তব্যের দিকে যায় ট্রেন, ততই সহযাত্রীরা সংকোচ ভেঙে কাছে আসে। পড়শি হয়ে ওঠে। তা ছাড়া এই ট্রেনের যাত্রীদের অধিকাংশই হরিদ্বারগামী, তীর্থকামী, পুণ্যপিয়াসি। একেবারে সামনেই বাপ-বেটিতে চলেছে। বাপ অরিন্দম গুপ্ত রামরাজাতলার বাসিন্দা, কন্যা অনুপ্রভা হাওড়া সেন্ট মারিয়ার ছাত্রী। অরিন্দম অফিসের কাজে দেহরাদুন। কন্যা হরিদ্বারে এই প্রথম। দেহরাদুন হয়ে, মসুরি (মুসৌরি) হয়ে হরিদ্বারের কুম্ভমেলা দেখা। অর্থাৎ রথ দেখা, কলা-মুলো বেচা এবং ঘরে ফেরা। আমি অবশ্য থাকব, সরকারি ঘোষণা মোতাবেক ‘সংক্ষিপ্ত কুম্ভ’ যত দিন চলবে অর্থাৎ এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত। ওই দিন রাতের ট্রেনে ঘরে ফেরা।

চুঁচুড়ার ঘড়িমোড়ের কাছে বাড়ি অমরনাথ দত্তের, সঙ্গে স্ত্রী জয়ন্তী। এঁদের সঙ্গে পাড়ার অনেকে। যেমন রিনা ঘোষ। সকলেই তীর্থভ্রমণে। মসুরি-দেহরাদুন-হৃষীকেশ হয়ে হরিদ্বারের ব্রহ্মকুণ্ডে মা গঙ্গায় ডুবকি। সব পাপ ধুয়ে মুছে ঘরে ফেরা। এমনিতে ট্রেন ছুটছে। যাত্রীরা এ-পাশ ও-পাশ করে সময় কাটাচ্ছে। ট্রেনে অবশ্য খাবার মিলছে। ডিম কারি, সবজি, দই এবং সকালে ডিম, পাউরুটি। অন্য কিছু নয়। কোভিডের কারণে মাছ-মাংস বাদ। চা এবং বিস্কুট যথেষ্ট। এবং নানাবিধ স্যুপ।

যাত্রীরা চনমনে হয়ে ওঠে, ট্রেন গন্তব্যের দিকে যতই এগিয়ে যায়। সেটাই স্বাভাবিক। সামনেই জ্বালাপুর। তার মানে তো। তার মানে তো এসেই গেছি। স্ত্রী স্বামীকে বলছে, করোনার ইনজেকশনের সার্টিফিকেট পকেটে রাখো। ওটাই তো আগে লাগবে। স্বামী এ রকম অসংখ্য সাবধানবাণী অসংখ্য বার শুনেছেন সংসারজীবনে। বিশেষ গা করলেন না। তার মানে, ঠিক আছে সব।

ঠিক যে নেই বোঝা গেল জ্বালাপুরে এসে। অসংখ্য পুলিশ আর তাদের সাহায্যকারী। গোটা ট্রেনে এক যোগে কড়া নির্দেশ – জ্বালাপুরে নেমে পড়ো, এই ট্রেন হরিদ্বারে দাঁড়াবে না। কারণ জানা গেল। জ্বালাপুরে কোভিড ক্যাম্পে সব যাত্রীর করোনা পরীক্ষা করা হবে। উত্তরাখণ্ড স্বাস্থ্য দফতরের এটাই নির্দেশ।

ওঃ কী জ্বালা! (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *