
‘তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে…’, গুনগুন করতে করতে এগিয়ে এলেন শিশির রাহুত। এখানকার কেয়ারটেকার, তথা গাইড, তথা সব কিছু। তাঁর কথা বলার, গান গাওয়ার একটা নিজস্ব ভঙ্গিমা রয়েছে। মাথা কাত করে গান গেয়ে যাচ্ছেন শিশিরবাবু।
একটু আগেই একগুচ্ছ পর্যটককে বাড়িটি দেখিয়েছেন তিনি। এখন আবার বন্ধ করে গাছের ছায়ায় বসে সুখটানে মগ্ন। আমরা যেতেই ফের উঠে পড়লেন। চাবি নিয়ে এগিয়ে এলেন দরজা খুলে দিতে। ভেতরে ঢুকলাম।
এই বাড়ির একবার দর্শন পাওয়া ভারতের সব রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের কাছে স্বপ্নের। এই ভবনের উলটো দিকেই কুইনাইন কারখানার প্রধান গেট। দার্জিলিং জেলার এই মংপুতে প্রচুর সিঙ্কোনার চাষ হয়। এই সিঙ্কোনা দিয়েই তৈরি হয় কুইনাইন।
এই কারখানার প্রধান কুইনোলজিস্ট বা মুখ্য অধিকর্তার বাসভবন ছিল আজকের রবীন্দ্রভবন। সাহেবি স্টাইলে গড়া। প্রধান কুইনোলজিস্ট ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী মনমোহন সেন।

কবিগুরু যখন কালিম্পং আসেন, তখনই মংপুতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা মৈত্রেয়ী দেবী। তাঁর ডাকেই কবিগুরু প্রথম মংপুতে আসেন, ১৯৩৮ সালের ২১ মে। হিমালয়ের কোলে মংপুর শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু। তাই তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ডাকে বারবার ছুটে গিয়েছিলেন মংপুতে।
১৯৩৮-এর পর ১৯৩৯ সালে মংপুতে দু’ বার গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর শেষ বা চতুর্থ বার আসেন ১৯৪০ সালে। প্রতি বারই তিনি এখানে এক-দু’ মাস করে থেকেছেন। এই বাড়িতেই। ১৯৪০ সালে কবিগুরু তাঁর জন্মদিনও এই ভবনেই পালন করেন।
মংপুর বাংলোয় থাকার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্তত ১২টি কবিতা লিখেছিলেন বলে জানা যায়। দার্জিলিং পাহাড়ের এই ছোট্ট গ্রাম কবির সঙ্গে কী ভাবে জড়িয়ে ছিল, সে সম্পর্কে নানান তথ্য মেলে মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইয়েও। কবির মৃত্যুর তিন বছর পর সিঙ্কোনা বাগানের ভিতরে থাকা এই বাংলোয় ‘রবীন্দ্র সংগ্রহশালা’ তৈরি হয়েছিল। বাংলোর নাম হয় রবীন্দ্রভবন।
দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। ২০১৭ সালে ভবনটিকে হেরিটেজ তকমা দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর পর সংস্কারের জন্য প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। শুরু হয় সংস্কারের কাজ। পুরো ভবনটি নতুন করে রং করার পাশাপাশি ভিতরের মেঝের কাঠের পাটাতন নতুন করে তৈরি করা হয়। ২০১৮ সালের ২৫ বৈশাখ নতুন রূপে রবীন্দ্রভবনের দরজা পর্যটকদের জন্য আবার খুলে দেওয়া হয়।

রবীন্দ্রভবনের সামনে সুন্দর একটি বাগান। সেখানে কবিগুরুর একটি আবক্ষমূর্তি আছে। মূর্তিটি ফাইবার গ্লাস দিয়ে তৈরি।
বাড়ির ভেতরে রয়েছে কবিগুরুর কিছু দুষ্প্রাপ্য জিনিস এবং ব্যবহৃত সামগ্রী। ব্যবহৃত চেয়ার, খাট, বিছানাপত্র, পড়ার ঘর ইত্যাদি। কবিগুরু ছবি আঁকতে যে সব রং ব্যবহার করতেন, সে সব রঙের বাক্সও রয়েছে। আছে একটি দেওয়াল আলমারি। এই আলমারিতে কবিগুরু ওষুধ রাখতেন।
উল্লেখ্য, চার বার মংপুতে এলেও পঞ্চম বারও মংপুতে আসার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন কবিগুরু। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় কালিম্পং থেকেই কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় তিনি অবশ্য তাঁর ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগেভাগে পাঠিয়েছিলেন এই রবীন্দ্রভবনে। আজও এই ভবনে কবিগুরুর পাঠানো সে সব ওষুধ সংরক্ষিত রয়েছে।
এখন তো রবীন্দ্রভবন পর্যন্ত গাড়ি চলে যায়। কিন্তু আগে তো সেই সুবিধা ছিল না। তখন মংপু আসার জন্য ভরসা করতে হত ঘোড়ার গাড়ি বা পালকি বা নিজের পায়ের ওপরেই। শিলিগুড়ি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রাম্বিবাজার পর্যন্ত গাড়িতে আসা যেত। সেখান থেকে পালকিতে মংপুতে পাড়ি দিতেন কবিগুরু।

কবিগুরুকে পালকিতে করে নিয়ে আসেন ভীমলাল রাহুত। শিশির রাহুত তাঁরই সুযোগ্য নাতি। দাদুর সুবাদে, শিশিরবাবুর বাবাও কবিগুরুকে দেখেছেন। শিশিরবাবুর রক্তে কী ভাবে রবীন্দ্রনাথ মিশে গিয়েছেন, সেটা খুব ভালো করেই বোঝা যায়।
কত আর আয় হয় তাঁর! সকাল সকাল এসে রবীন্দ্রভবন পরিষ্কার করেন। কোনো পর্যটক না থাকলে, দরজা বন্ধ করে গাছতলায় কিছুক্ষণের জন্য বসেন, আবার কেউ চলে এলে খুলে দেন। এই নিয়ে চলছে তাঁর জীবনসংগ্রাম।
আরও পড়ুন: ঘরে বসে মানসভ্রমণ: হিমালয়ের কোলে কসৌলি
রবীন্দ্রনাথের টান যে অমোঘ টান। রবীন্দ্রপ্রেমীদের পাশাপাশি শিশির রাহুতও যে সেই টান উপেক্ষা করতে পারেন না।