
কর্নাটক রাজ্যের হাসন জেলায় অবস্থিত হালেবিদু (অতীতের নাম দ্বারসমুদ্র)। দ্বাদশ শতাব্দীতে হোয়সলা সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই হালেবিদু।
চোদ্দোশো শতাব্দীর প্রথম দিকে, এই শহরে, দু’বার মুসলিম আগ্রাসন হয় – মহম্মদ বিন তুঘলক ও মালিক কাফুর এই শহরে ব্যাপক লুঠপাঠ চালান। ধ্বংস হয় দ্বারসমুদ্র। হোয়সালা রাজারা তাঁদের রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান বেলুরে। সেই থেকে দ্বারসমুদ্র শহরের নামকরণ হয় হালেবিদু, অর্থাৎ পুরোনো রাজধানী। তার পর থেকে এই শহর কালের স্মৃতিতে হারিয়ে যায়। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়, আর ঘুরে দাড়াঁতে পারেনি। চলেছি সেই হালেবিদু। হোয়সলা স্থাপত্যের অন্যতম সেরা নিদর্শন হোয়সলেশ্বর মন্দির দেখতে।
আর পড়ুন: এক টুকরো হাম্পি : দেখুন জেনানা এনক্লোজার
হালেবিদুতে হোয়সলেশ্বর মন্দির মূলত শিব মন্দির। হোয়সালা সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ মন্দির, উৎকৃষ্টের সেরা উদাহরণ। বারোশো শতাব্দীতে হোয়সলা রাজা বিষ্ণুবর্ধন গড়ে তোলেন এই মন্দির। এই মন্দির দু’টি মন্দিরে ভাগ করা – একটি মন্দির রাজার জন্য (হোয়সলেশ্বর, এটি দক্ষিণ দিকে) আর অপরটি রানির জন্য (সান্তালেশ্বর, এটি উত্তর দিকে। রাজা বিষ্ণুবর্ধনের রানি ছিলেন সান্তালাদেবী। তাঁর নাম থেকেই এই মন্দিরের নামকরণ হয়েছে সান্তালেশ্বর।

এই দু’টি মন্দির, একে ওপরের মুখোমুখি, সোপস্টোন দিয়ে নির্মিত। এর জন্যই হয়তো মন্দিরগাত্রে এত সূক্ষ্ম কাজ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। মন্দিরের বাইরের গাত্রের পাথরের কাজ আপনাকে আবেশমুগ্ধ করে তুলবে। মন্দিরের জগতির ঠিক নীচে, যেটিকে মন্দিরের বেসমেন্ট বলা হয়, তাতে ভূমির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে সুনির্দিষ্ট ভাবে পাথরের কাজ রয়েছে, উচ্চতা ৮ ফুট। একদম শেষে ভূমি বরাবর রয়েছে পাথরের হাতির সারি – শক্তি ও দৃঢ়তার প্রতীক; ঠিক তার ওপরের সারিতে সিংহ – সাহসিকতার প্রতীক; তার ওপরের সারিতে ফুলের নকশা – সৌন্দর্য্যের প্রতীক; তার পর ঘোড়া – গতির প্রতীক; তার ওপরে আবার হিন্দু পুরাণমতে ফুলের নকশা, তার ওপরে পুরাণমতে অসুর ‘মাখরা’ এবং পাথরের শেষ সারিতে রয়েছে হাঁস। এই সারিগুলির দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার। সারা মন্দিরগাত্রে ৩৫০০০ পাথরের মূর্তি ছড়িয়ে আছে। একটার সঙ্গে আর একটার কোনো মিল নেই! গণেশের নৃত্যমূর্তি, মন্দিরে প্রবেশের মুখে দ্বারপাল, নটরাজ মূর্তি, রাবণের কৈলাস পর্বত উত্তোলন, শিব-পার্বতীর যুগলমূর্তি, কৃষ্ণর এক আঙুলে গোবর্ধন পর্বত উত্তোলন, নরসিংহ মূর্তি .. আরও কত কী!

মন্দিরের অভ্যন্তরে পিলার, দেওয়াল ও ছাদের কারুকার্য আপনাকে বাকরুদ্ধ করে তুলবে, যদিও কিছু পিলারে পাথরের কারুকার্য মুসলিম আগ্রাসনে ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। রাজার মন্দির ও রানির মন্দিরকে যোগ করেছে একটি অলিন্দ। মন্দিরে প্রবেশের মুখে রয়েছে এক পাথরে তৈরি (মনোলিথিক) নন্দীমূর্তি। রঁদ্যা, রামকিঙ্করের পূর্বসূরী ওই সব কালজয়ী শিল্পীরা, ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন যেন। এক বুক মুগ্ধতা নিয়ে হয়তো আপনি বলে উঠবেন ..
‘হে আমার শীর্ণ জীর্ণ মুহ্যমান শিল্পের সম্রাট ../একটু পাথর দাও আর এক বুক খোলা মাঠ।/রক্তে নাচে ছেনি,/বাতাসে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে ../যুবতীর বেপরোয়া বেণী’।
বেলুর
হালেবিদু থেকে এলাম বেলুর, অতীতের বেলাপুরে। বেলুরের খ্যাতি তার চেন্নাকেশব মন্দিরের জন্য -‘চেন্না’ শব্দের অর্থ সুন্দর ও ‘কেশব’ অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণু। মূলত ভগবান বিষ্ণুর মন্দির (বিষ্ণুর ২৪তম অবতার ‘বিজয়নারায়ণ’ – দক্ষিণ ভারতে ভগবান বিষ্ণু এই নামেই পূজিত হন)। রাজা বিষ্ণুবর্ধন দ্বাদশ শতকের গোড়ায় এই মন্দির নির্মাণ শুরু করলেও শেষ করেন তাঁর নাতি। এই মন্দির নির্মাণ করতে ১০৩ বছর লেগেছিল।
কালাকাড়ের যুদ্ধে চোল রাজাদের হারানোর স্মৃতিতে এই মন্দির গড়ে তোলেন হোয়সলা-রাজ। আবার অনেক ঐতিহাসিকে মনে করেন, রাজা বিষ্ণুবর্ধন বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করলে এই মন্দির গড়ে তোলার কাজে হাত দেন।
কালো পাথরের দণ্ডায়মান বিষ্ণুমূর্তি আর তাঁর সারা শরীর জুড়ে গয়নার অলংকরণ .. ‘পাথর না সত্যি’ .. আপনার মনে ভ্রম সৃষ্টি হবে! তাই তো ‘চেন্নাকেশব’ .. ‘handsome Lord Vishnu’।

মন্দিরে প্রবেশের দু’টি গোপুরম। ভেতরে রয়েছে পাথরের এক সুবিশাল চাতাল, মধ্যস্থলে রয়েছে মূল মন্দির। মন্দিরের বাইরের গাত্রে পাথরের মূর্তিরা যেন জীবন্ত ছবি! বেদ, উপনিষদ থেকে শুরু করে পুরাণের বিভিন্ন ঘটনা পাথর দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে! মন্দির চত্বরে রয়েছে গরুড়-স্তম্ভ। মন্দিরে সাতটি সিঁড়ি ভেঙে প্রথমে রয়েছে জগতি, তার পর রয়েছে মূল অধিষ্ঠান। মূল মন্দিরের প্রবেশপথ তিনটি। সমগ্র মন্দিরটি সোপস্টোন দিয়ে তৈরি। বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া প্রতি দশ বছর অন্তর পুরো মন্দিরগাত্র কেমিক্যাল ও মোম পালিশ করে থাকে। প্রবেশমুখে রয়েছেপাথরের মূর্তি, রাজা সিংহের সঙ্গে যুদ্ধরত। মন্দিরের প্রতিটি ইঞ্চি পাথরের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারুকার্য্যে সাজানো – শিল্প ও শিল্পীর এক অনির্বচনীয় সৃষ্টি এই মন্দির। সারা মন্দির চত্বরে ৪০টি পিলার আছে, প্রতিটি পিলারের ব্র্যাকেটে রয়েছে নৃত্যরতা মূর্তি – নাম ‘মদনিকা’ (সংখ্যায় ৪০টি)। এগুলির শরীরের বিভঙ্গে কোনোটির সাথে কোনোটির মিল নেই – এক বিস্ময়কর সৃষ্টি! শিল্পসত্তার এক চরম রূপ! মন্দির অভ্যন্তরে রয়েছে রানি সান্তালাদেবীর নৃত্যরত মূর্তি। এটিই হোয়সলা সাম্রাজ্যের একমাত্র মন্দির যেখানে এখনও নিয়মিত সকাল-বিকাল পূজা হয়ে থাকে। ৮৮৭ বছর ধরে এই পূজা চলে আসছে বলে জনমত।
মন্দিরের খোলা চত্বরে, একটি পাথরের ব্লকের উপর, ৪২ ফুট লম্বা একটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে, কোনো রকম বেস ফাউন্ডেশন ছাড়াই! মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের এক বিস্ময়কর উদাহরণ!
কী ভাবে যাবেন
ভারতের বেশির ভাগ শহরের সঙ্গে ট্রেন ও বিমানপথে যুক্ত বেঙ্গালুরু। সেখান থেকে (যশবন্তপুর কিংবা বেঙ্গালুরু সিটি, সরকারি নাম ক্রান্তিবীর সাঙ্গোলি রায়ন্না বেঙ্গালুরু স্টেশন) ট্রেনে হাসন তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in । হাসন থেকে বেলুর ৩৮ কিমি, হালেবিদু ৩০ কিমি। হালেবিদু-বেলুর ১৬ কিমি। হাসন স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে নিন।
বেঙ্গালুরু থেকে সরাসরি সড়কপথেও আসতে পারেন। বেঙ্গালুরু থেকে হাসন হয়ে বেলুর ২২২ কিমি। কর্নাটক রাজ্য পরিবহনের বাস সারা দিন মেলে। রাতেও পাওয়া যায়। বেঙ্গালুরু থেকে চিকমাগালুর ও হোরেনাডুগামী বাস হাসন, বেলুর হয়ে যায়। বেঙ্গালুরু থেকে হাসন হয়ে হালেবিদু ২১০ কিমি। হালেবিদু যেতে হলে হাসন বা বেলুর থেকে যেতে হবে। বাসে আগাম আসন সংরক্ষণের জন্য লগ ইন করুন https://www.ksrtc.in ।
বেঙ্গালুরু থেকে সরাসরি গাড়ি ভাড়া করেও আসতে পারেন।

কোথায় থাকবেন
বেলুরে চেন্নাকেশব মন্দিরের খুবই কাছেই (৭০০ মি) থাকার জন্য রয়েছে কর্নাটক পর্যটনের হোটেল ময়ূর বেলাপুরী। আর হালেবিদুতে হোয়সলেশ্বর মন্দিরের সামনেই রয়েছে কর্নাটক পর্যটনের হোটেল ময়ূর শান্তালা। অনলাইন বুকিং kstdc.co । রয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি হোটেল। খোঁজ পাবেন makemytrip, goibibo, trivago, cleartrip ইত্যাদি ওয়েবসাইট থেকে।
বেলুরে থেকে হালেবিদু বা হালেবিদুতে থেকে বেলুর ঘুরে নিতে পারেন। বেঙ্গালুরু থেকে চিকমাগালুর যাওয়ার পথে আগে হালেবিদু, তারপর বেলুর।
কিছু জরুরি তথ্য
হোয়সলেশ্বর মন্দির ও চেন্নাকেশব মন্দির খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত। গাইড নিলে সুবিধা হয়, চার্জ ৬০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা।
উৎসাহী পর্যটকেরা বেঙ্গালুরু থেকে গাড়ির জন্য যোগাযোগ করতে পারেন, সনৎ- ০৯৯১৬৫৯৯৮২৮, ০৯১৭৮৯২১২৯১৬৬ বা পুরুষোত্তম – ০৯৭৪২৯৯১৯১৯।
ছবি: লেখক