
সে এক সময় ছিল বটে! বেড়াতে যাওয়া ঠিক হলে উৎসব এবং উদ্বেগ দু’টোই একসঙ্গে শুরু হত, বিশেষ করে উদ্বেগ। ভোরে উঠতে না পারার উদ্বেগ। অনেক রাত পর্যন্ত ব্যাগ গুছিয়ে, ভোর থাকতে থাকতে ওঠাটাও ছিল কষ্টকর, বিশেষ করে শীতের সময়। কিন্তু সে সময় মামাবাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই যেত বাস, হাত দেখালেই দাঁড়িয়ে যেত। আবছা আবছা মনে পড়ে, আমরা ছোটোরা হুটোপুটি করে উঠে পড়তাম দিনের প্রথম বাসে। নামতাম সালার ষ্টেশনে, সেখান থেকে কু ঝিক্ ঝিক্ চেপে অজয় নদী পেরিয়ে ট্রেন পৌঁছোত ধাত্রীগ্রাম। সেখানে আবার বাস। বাগনাপাড়ায় নামতে পারলেই শান্তি, বাশারমামা হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকতেন, সঙ্গে গরুগাড়ি আর গাড়োয়ান। বাশারমামা বড়োমামার শ্যালক। আমরা যাচ্ছি বড়োমামার শ্বশুরবাড়ি, ডাঙ্গাপাড়া।
আরও পড়ুন: উইকএন্ডে গন্তব্য হোক বর্ধমান, প্রস্তুতি নিচ্ছে জেলা প্রশাসন
প্রায়ই যেতাম তখন, ছুটি পড়লেই ভোকাট্টা আর-কি! না, বিশেষ কিছু দেখার ছিল না সেখানে, তবুও যেতাম, যেতাম নানা-নানি, মামা-মামির আন্তরিকতার টানে। বড়ো, খোলামেলা বাড়ি, গৃহস্থ পরিবার। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে কামারশালা, তার পাশে বড়ো খামার। পুকুরে ঝাঁপ, কামরাঙা ও জলপাইয়ের ডালে ডালে লুকোচুরি। ঢিল মেরে পাড়া কাঁচা আমের গন্ধ সোঁকা। অদূরে ছিল একটি সাঁওতাল পাড়া। সেখানে যাওয়া আমাদের নিষেধ ছিল অবশ্য। বাশারমামা যে ঘরে থাকতেন, বেশ সাজানো গোছানো। বড়ো একটা রেডিও ছিল বোধহয়। আরও কত কী যে ছিল আমার আকর্ষণের, তার ইয়াত্তা নেই। তেজপাতা গাছ ছিল। ছিল তালের শুকনো আঁটি কেটে মিষ্টি শাঁস খাওয়ার লোভ। একটা বড়ো বাঁশে প্রচুর কড়ি লাগানো ছিল। পাশের বড়োলোক বাড়ির পেয়ারাগুলোও ছিল বড়োসড়ো আর মিষ্টি। তাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য আবার গোবর গ্যাসের ব্যবস্থাও ছিল। রাস্তার এক পাশে তাদের বাড়ি আর অন্য পাশেই ছিল সেই গোবরের কাণ্ডকারখানা। একটা বড়ো চেম্বারে গোবর জমা করে, উৎপন্ন গ্যাস পাইপ করে চলে যেত বাড়িতে। একটা ইঁদারাও ছিল বোধহয়।

বহু বার গেছি, এত বার গেছি যে ডাঙ্গাপাড়া’র লোক চিনে গিয়েছিল যে আমরা গাঁয়ের জামাই মুকুলের ভাগনা। ওই রকম একবার যেতে যেতেই জেনেছিলাম যে কলারও বীজ হয়, সিঙ্গাপুরি কলা। হলুদ কলার কালো কালো বীজ যা খেতে হয় না, খেলেই পেটে কলাগাছ হয়ে যাবে — বড়ো মামা বলেছিল, বিশ্বাসও করেছিলাম অবলীলায়। তাই খুব সাবধানে ভয়ে ভয়ে খেতাম সেই কলা। বাগনাপাড়াতেই দেখেছিলাম প্রথম তাকে, যাকে দেখলেই বর্ধমানের কথা মনে পড়ে বা বর্ধমানের কথা মনে এলেই যার কথা মনে আসে, মিহিদানা। বড়ো কাঁসার থালায় পিরামিড গড়েছে মিহিদানা, হলুদ ও রসালো। কিছু মাছি তারই ওপর পাক খাচ্ছে। বড়ো হয়ে বুঝেছি, ওগুলো আসলে মাছি নয়, ওরা মনমাছি। আমরা যারা মিহিদানা দেখি দোকানে, তাদের মনটাই মনমাছি হয়ে পাক খায় মিহিদানায়।
আরও পড়ুন: কৃত্তিবাস ও গোঁসাইবাড়ির শান্তিপুর : প্রথম পর্ব
আজ যখন বড়ো হয়ে গেলাম, সে দিনের সেই সোনাঝরা দিনগুলি মনে দোলা দেয় হঠাৎ হঠাৎ। কেমন আছে বাশারমামা? কামারশালটা কি এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে? সাঁওতাল পাড়াটাও কি রয়েছে ওখানে? ছোটোবেলায় বড়োদের কথা শুনে ওদের দেখতে যেতে পারিনি, এখন তো আমি বড়ো হয়েছি, এখন কি একবার যাওয়া যাবে ওদের ঘরকন্না দেখতে? ছোটোবেলার ধুলোমাটিতে পা ছোঁয়ানোর সুযোগ কি আর দেবে আমাদের জীবন নামক যাপন, কি জানি!
আরও পড়ুন: কৃত্তিবাস ও গোঁসাইবাড়ির শান্তিপুর : শেষ পর্ব
ভূগোলে পড়ে জানলাম বঙ্গের শস্যগোলা বর্ধমান জেলা। ঘটনাচক্রে সেই জেলাতেই হল আমারও শ্বশুরঘর। এখন বুঝি আমার পায়ে সরষে নেই, আছে জলবিছুটি আর মনে রয়েছে গোবরে পোকা। যা পেয়েছি ছোটোবেলার ওই কারণে অকারণে মামাবাড়ি যাওয়ারই উপহারস্বরূপ। তাই পায়ের চুলকানি আর মনের কুড়কুড়ানি চলতেই থাকে হরদম। এক সপ্তাহ, দশ দিনেই একঘেয়েমি পেয়ে বসে নিরন্তর। হঠাৎ হঠাৎ বেঘর হওয়ার সাধ জাগে। কিছু না পেলে তাই, আনখা কোনো শহরে চলে যাই, চায়ের দোকানে, স্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকি খামোখা। লোক দেখি। কখনও বা সাইকেল নিয়ে মেঠো পথ ধরেই অনেকটা চলে যাই উদ্দেশ্যহীন ভাবে। চাষিরা মাঠে কাজ করে, হাই টেনশন বিদ্যুৎ লাইনের পটপট্ আওয়াজ শোনা যায়। নাম-না-জানা নানা ঘাসফুল ফুটে থাকে। কোথাও বা শ্যালো পাম্প চলে যান্ত্রিক খেয়ালে। ঘণ্টা দুই তিনেক এ-দিক সে-দিক কাটিয়ে বাড়ি ফিরি, খাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে বহুক্ষণ। কেউ জানতে চায় না কোথায় ছিলাম, বারণও করে না কোনো কিছুতে। বুঝি আমি বড়ো হয়ে গেছি, যত বুঝি ততই মনটা আকুলিবিকুলি করে ছোটো হওয়ার জন্য। সেই সময়টার জন্য কান্না পায়, যখন আমরা প্রায়শই মামাবাড়ি, নানাবাড়ি, ফুপুবাড়ি চলে যেতাম নানা অছিলায়। আশ্চর্য, তখন কখনোই আমাদের সময়ের অভাব হত না!
জানি পাঠক আমায় গাল পাড়ছেন, বর্ধমানের গল্প শোনাতে বসে, শোনাচ্ছি মন খারাপের পাঁচালি। কিন্তু না আর নয়, এই নিন কার্জন গেট। শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে এই ‘বিজয় তোরণ’টি ১৯০৩ সালে বর্ধমানরাজ বিজয়চাঁদ মহতাবের আদেশক্রমে নির্মিত হয় বোম্বে অধুনা মুম্বইয়ের ‘গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া’র আদলে। ‘স্টার অফ ইন্ডিয়া’ নামে পূর্বপরিচিত এই তোরণটি ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বর্ধমান আগমনের হেতু হিসেবে ভাইসরয়কে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়। বর্ধমান পৌঁছে ঘাড় উঁচু করে দিব্যি দেখে নিতে পারেন। পাশেই দেখবেন রামপ্রসাদের লস্যি, এক গ্লাস খেয়ে বাকিদেরও খাওয়ান। দু’টিই খুব বিখ্যাত, এখন রামপ্রসাদের লস্যির কারণে কার্জন গেট না কার্জন গেটের কারণে রামপ্রসাদের লস্যি বিখ্যাত, তা বিচারের ভার পর্যটকের।

গেট থেকেই বি সি রোড শুরু। দু’পাশে হরেক মালের পসরা, দোকানদার, খরিদ্দার সকলের ধাক্কা খেতে খেতেই এক সময় পৌঁছে যেতে পারেন গোলাপবাগ; রাজবাটি, এক সময় বর্ধমান রাজাদের রাজবাড়ি, এখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। তার আগে ডান দিকের দোতলাগুলি খেয়াল করতে থাকবেন অবশ্যই। ‘উত্তরায়ণ’ চোখে পড়লে দাঁড়িয়ে যান। খাওয়া-দাওয়া করুন এখানেই, তবে মনে রাখুন রান্নাবান্না সম্পূর্ণ না হওয়া অবধি ওদের সদর দরজা খোলে না। এবং নিশ্চিত থাকুন ওই দামে ওই মানের খাবার আপনি কলকাতাতে পাবেন না কখনোই। পাবেন না শক্তিগড়ের ল্যাংচার স্বাদও। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এলে যখনই বাতাসে ল্যাংচার সুবাস পাবেন, জানবেন বর্ধমান আগতপ্রায়। ওই ল্যাংচার কথা ভাবতে ভাবতেই শক্তিগড়, তার পরই শহর বর্ধমান।I

রাজবাটির কাছাকাছিই পেয়ে যাবেন বর্ধমানের শেষ আফগান জাগিরদার শের আফগানকে, যিনি মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের কুনজর থেকে নিজ স্ত্রী মেহেরুন্নিসাকে বাঁচাতে প্রবল পরাক্রমী মোঘলদের সঙ্গে দুশমনিতে জড়ান এবং সম্রাটের পাঠানো কুতুবুদ্দিনের সঙ্গে যুদ্ধে নামেন। সেই যুদ্ধস্থল ছিল আজকের বর্ধমান রেল স্টেশনের কাছে। ১৬১০-এর ওই যুদ্ধে দু’জনেরই মৃত্যু হয়। দু’জনেই শুয়ে রয়েছেন এখন পীর বেহরামে। ও দিকে মেহেরুন্নিসা দিল্লি গিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গিরের ঘরণী হন ১৬১১ সালে, নতুন নামে হন পরিচিত, নূর-এ-জাহান বা জগতের আলো, আর শের আফগান শুয়ে থাকেন কবরের অন্ধকারে!

দু’বছরের রায়ার কৌতূহল অসীম। যা দেখে তা-ই জানতে চায়, এটা কী, ওটা কী। যতটা সম্ভব তার কৌতূহলের নিরসন করি আমরা সকলেই। এ পর্যন্ত তা-ও সব ঠিক ছিল। গোল বাঁধল নবাবহাটের ১০৮ শিবমন্দিরে গিয়ে। শিবলিঙ্গ দেখিয়ে রায়া যথারীতি জানতে চাইল, পাপা এটা কী? শিবঠাকুরের মন্দির বলেও রেহাই নেই, পরেরটা দেখেও তার একই প্রশ্ন। এ দিকে আমি নিজেই জানি না মন্দিরের সংখ্যা ১০৮ কেন? একই শিব, একই লিঙ্গ, তবে? ১০৯ বা ১০৭ নয় কেন? কালনাতেও একই সংখ্যার আরও একটা শিবমন্দির রয়েছে। তা হলে ১০৮-এর কী মাহাত্ম্য? মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল এই রহস্যের কৌতূহল। শ্যালিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে জানে না। ল্যারি পেজ, ‘গুগল্’ ব্যবসার আইডিয়াটা আমার সহধর্মিনীর কাছেই পেয়েছিল, তাই তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস করলাম না। প্রতি শিবরাত্রিতেই এখানে সাত দিন ধরে আরাধনা চলে প্রতিষ্ঠা কালহতেই। রানি বিষ্ণুকুমারী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৮৮ সালে। ১০৮-এর ঘনঘটায় তাঁকে স্মরণ করে হলাম আত্মমগ্ন, থুড়ি শিবমগ্ন!
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে প্রচুর বাস বর্ধমান ও বর্ধমানের ওপর দিয়ে চলাচল করে। ট্রেনও রয়েছে অনেক লোকাল ও এক্সপ্রেস মিলে। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জায়গার সঙ্গে ট্রেনে বা বাসে বর্ধমানের সঙ্গে যোগাযোগ। সড়কপথে কলকাতা থেকে বর্ধমানের দূরত্ব ১০২ কিমি, সোজা চলে আসুন দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে।
থাকা-খাওয়া
বর্ধমানে খাওয়ার আসল জায়গা উত্তরায়ণ। এ ছাড়াও নানা বাজেটের খাওয়ার জায়গা রয়েছে। থাকতে পারেন পৌরসভা পরিচালিত অতিথি নিবাসে, ফোন- ০৩৪২-২৬৬ ৪১২১।
এ ছাড়াও শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান হোটেল ও গেস্ট হাউস ।