ট্রেনের শয়নযানে দ্বারভাঙা চলেছি৷ এপ্রিলের প্রথম দিকের ভোরে ঘুম ভাঙতেই ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বিহারের উত্তর অংশের রুক্ষ সবুজ গ্রাম আর নতুন গমগাছে সোনালী হয়ে ওঠা খেত, সঙ্গে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া। সব মিলিয়ে এক পরম প্রাপ্তি৷ দিন শুরু হওয়ার প্রথমেই এ যেন দশ কলা প্রাপ্তি হয়ে গেল৷ হঠাৎ করে ট্রেনটি লাল সিগন্যাল পেয়ে সেই গ্রাম্য পথেই কিছুক্ষণের জন্য তার দেহখানি রাখলো৷ এমনিতেই ট্রেন কিছু দেরিতে চলছে, তার ওপর মাঝেমধ্যেই তার এই বিশ্রাম নেওয়া। বড্ড অস্থির করে তুলছিল মনটা৷ খালি হাতঘড়ির কাঁটার নড়নচড়ন দেখছিলাম৷ কখন তার দয়া হয় আর আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়৷ এ বার আমার গন্তব্য ছিল মধুবনী স্টেশন থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত সৌরাট গ্রামে৷
ভারতের বিভিন্ন ছোটো বড় গ্রামের মতো সৌরাটেরও একটা নিজস্ব গল্প আছে৷ এখানে এখনও স্বয়ংবরসভার মাধ্যমে বিবাহ হয়৷ মুলত আষাঢ় মাসে অর্থাৎ জুন-জুলাইয়ে এই স্বয়ংবরসভা বসে। আঞ্চলিক ভাষায় একে বলে গাছী৷ সেই ট্র্যাডিশনের সূত্রেই গ্রামের নাম সৌরাট সভাগাছী। বিয়ের উপযুক্ত বেশ ক’জন পাত্র ও তাঁদের পরিবার, অপর দিকে পাত্রী ও তাঁর পরিবার একটি মণ্ডপ বা মন্দিরে জড়ো হয়৷ দু’ পাশে উভয় পক্ষের লোকজন সার দিয়ে বসে থাকে৷ পুরোহিতরা আসেন৷ এ বার সুরু হয় বরপণের অঙ্ক কষাকষি৷ পছন্দমাফিক বরপণ ঠিক হলে কনে তার পছন্দের দুলহা কে বরমাল্য পরাবে৷ এই হল সৌরাটের স্বয়ংবরসভা। বহু যুগের এক প্রচলিত প্রথার অনুসরণ আজও হয়ে আসছে এই সৌরাট গ্রামে৷
নির্ধারিত সময়ের প্রায় ঘণ্টা খানেক বাদে ট্রেন মধুবনী পৌঁছোল। গোটা স্টেশনটিই মধুবনী চিত্রকলায় সুন্দর করে সাজানো৷ স্টেশনএ থেকে বাইরে বেরোতেই অটো, রিকশা, গাড়ির স্ট্যান্ড৷ রিকশা স্ট্যান্ডে গিয়ে দরদাম করে সৌরাট নগরীর জন্য একটি রিকশা ভাড়া করে নিলাম৷ পথেই সকালের হালকা টিফিন সেরে নিলাম৷ স্টেশন চত্বর ছেড়ে বাজারের ভিড় পেরিয়ে চলতে লাগল রিকশা৷ কিছুক্ষণ পরে বড়ো রাস্তার মোড় পেরিয়ে সৌরাট যাওয়ার রাস্তা ধরে এগোতে লাগল৷ এই রাস্তায় তত ভিড় নেই ৷ বেশ শান্ত প্রকৃতি৷
এই মিথিলাঞ্চলের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে৷ উত্তর বিহারের এই জায়গায় কেমন একটা সংস্কৃতিময় ভাব৷ কবি বিদ্যাপতির জন্মস্থান এই মিথিলা। শুধু তা-ই নয়, আরও অনেক মুনিঋষি, কবি-সাহিত্যিকের জন্ম দিয়েছে এই মিথিলা। সেই মিথিলারই একটি গ্রাম সৌরাট। সেই সংস্কৃতিময় গ্রাম সৌরাটের পথে আমি চলেছি৷ মসৃণ পিচঢালা রাস্তা, চার পাশে বড়ো বড়ো মাঠ, পথের ধারে বড়ো বড়ো গাছ লাগানো, মাঠের বেশ কিছুটা ভেতরে গ্রাম৷ তার নিস্তব্ধ পথ দিয়ে শান্তশিষ্ট রিকশার দুলকি চালে চলার আওয়াজ অন্তরাত্মা পর্যন্ত শান্তির সঞ্চারন ঘটাচ্ছে৷ গ্রামে গিয়ে কী পাব বা না পাব, যা জেনে এসেছি তার থেকে আরও বেশি কিছু জানতে পারব কিনা, সে সব চিন্তা তখন মন থেকে উড়ে গেছে৷ শুধুই দু’চোখ ভরে তখন শ্যামলা প্রকৃতিকে দেখেই চলেছি৷ মনোমুগ্ধকর যাত্রাশেষে এক সময় পৌঁছে গেলাম সৌরাট সভাগাছীতে৷
এই যাত্রায় রিকশার চালক রামুই বেশ দক্ষতার সঙ্গে গাইডের ভূমিকা পালন করছিলেন৷ হবে বা না-ই বা কেন? ওঁরা তো প্রায়ই এ দিকে আসেন৷ সবই জানেন ওঁরা৷ রামুবাবুই গ্রামের মধ্যে নিয়ে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। হিন্দিতে বললেন, “এ বাবু কলকাত্তা সে অ্যায়েঁ হ্যাঁয়, ইঁহা কা ফটো ভি খিঁচেগা অওর ইস গাঁও কে বারে মে কুছ জাননা ভি চাহতে হ্যাঁয়।”
একটি ছেলে শুনে বেশ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এল আমাকে এক ভদ্রলোকের কাছে৷তাঁর কাছে এই গ্রামের স্বয়ংবরসভার ব্যাপারে জানতে চাইলাম। এক মন্দিরের সামনে আপ্যায়ন করে বসালেন আমাকে। হিন্দিতেই বলতে লাগলেন৷ মন্দিরটিতে বেশ ছোটো ছোটো কতগুলো কক্ষ আছে৷ সেখানেই বসে স্বয়ংবরসভা বা গাছির আসর৷ এ ছাড়াও মাঠে মণ্ডপ গড়েও গাছি বা স্বয়ংবরসভার আয়োজন করা হয়৷
সৌরাট গ্রামে স্বয়ংবরসভা বসার পেছনে যে একটি সুন্দর কারণ আছে, তা-ও মনে করিয়ে দিলেন তিনি৷ মিথিলা অঞ্চল সীতাদেবীর জন্মস্থান (সীতামারি)৷ জমি কর্ষণের সময় সীতাদেবীকে রাজা জনক কন্যাসন্তান রূপে লাভ করেন৷ পরবর্তীকালে এই সীতাদেবীরই বিবাহ দেওয়ার জন্য রাজা জনক এক স্বয়ংবরসভার আয়োজন করেন৷ সেখানে রাম এসে সভায় রাখা হরধনু ভেঙে শর্তপূরণ সাপেক্ষে সীতাদেবীকে বিবাহ করেন৷ রামায়ণের সীতাদেবীর সেই স্বয়ংবরসভার রীতিকে স্মরণে রেখে আজও সৌরাট গ্রামে স্বয়ংবরসভার মাধ্যমে কনের বিবাহ হয়৷ এক দিকে বসানো হয় বিবাহযোগ্যা কনেকে, অপর দিকে জনাকয়েক পাত্র৷ এ বার বিবাহযোগ্যা কনের বাড়ির সামর্থ্য অনুযায়ী বরপণ যে পাত্রপক্ষের পছন্দ হবে তার গলায় পাত্রী বরমাল্য পরাবে৷ ত্রেতা যুগের সেই হরধনুর জায়গা নিয়েছে কলি যুগের বরপণ৷ যদিও সরকার থেকে বরপণ নেওয়া বন্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, যদিও ‘দহেজ মুক্ত মিথিলা’ গড়ার জন্য সামাজিক আন্দোলন চলছে, তবুও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই সামাজিক রীতি আজও সৌরাটের মানুষ বজায় রেখে চলেছেন৷
সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পরিছন্নতা সৌরাট গ্রামের অন্যতম বৈশিষ্ট৷ জনকোলাহল নেই, বিস্তীর্ণ খেত এখন শস্যশূন্য, কালো পিচের রাস্তা, রাস্তার দু’ ধারে বড়ো বড়ো গাছ, ফুরফুরে হাওয়া৷ সবই সৌরাটের গ্রামে উপরি পাওনা ৷
ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে গ্রামের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আর ভারতের আরেক ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রামে ঘোরার আনন্দে মন আমার তৃপ্ত৷ এই তৃপ্ততার স্বাদ পেতে পেতে বেলাশেষ হয়ে আসতে লাগল৷ এ বার সৌরাট ছেড়ে ফেরার পালা৷ রিকশায় উঠে বসতেই গ্রামটি ক্রমশ পেছনে সরে যেতে লাগল৷ অচেনা আগন্তুককে দেখে জড়ো হওয়া মানুষগুলোকে হাত নেড়ে চোখের মণিকোঠায় সৌরাটের স্মৃত সাজিয়ে আমিও অগ্রসর হতে লাগলাম৷
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে জয়নগরগামী ট্রেনে চড়ে মধুবনী নেমে স্টেশন নেমে রিকশা বা গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যাওয়া যায় সৌরাট গ্রামে৷
কোথায় থাকবেন
সৌরাট গ্রামে থাকার কোনো ব্যাবস্থা নেই৷ অনুমতি সাপেক্ষে গ্রামবাসীদের বাড়িতে থাকা যেতে পারে৷ নইলে মধুবনীতে বিভিন্ন মানের থাকার হোটেল পাওয়া যাবে৷ মধুবনীর কয়েকটা হোটেলের নাম ও ফোন নম্বর দেওয়া হল — মধুযামিনী ইন, ০৯৮০১০১৯০৩২; হোটেল অতিথি, ০৯১২৮০৮৩৪৩৪; জনতা রেস্ট হাউস, ০৯০৩১৫৮২৫২৮৷