
উত্তরকাশী থেকে বেরিয়ে একটু দ্রুত এগোতে লাগলাম। কিন্তু ধরাসু বেন্ডে এসে আবার দাঁড়িয়ে পড়তে হল। সামনে গাড়ির লাইন জানান দিল ধস নেমেছে। তবে খুব বড়োসড়ো নয়। ঘন্টা খানেকের অপেক্ষা। ধস পরিষ্কার হতে আবার যাত্রা। গাড়ি ধরাসু বেন্ড পেরিয়ে এ বার নতুন রাস্তা নিল। ফেলে আসা টিহরীর দিকে না গিয়ে ডান দিকে ঘুরে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গাড়ি চলতে লাগল। সাধারণ পার্বত্য পথ। বিশেষ কিছু দেখার নেই। পথে শিবের মন্দির, গুম্ফা পেলাম। ব্যাস, আর কিছু বলার নেই। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর পেয়ে গেলাম বারকোট বেন্ড। বারকোট শহর আমাদের সামনে আসবে যখন আমরা মুসৌরির দিকে যাব। কিন্তু আমাদের যাত্রা ডান দিকের পথে, গন্তব্য যমুনোত্রী। তাই ফেরার পথে বারকোট শহরকে পাব।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / প্রথম পর্ব : ধনৌলটি ছুঁয়ে নিউ টিহরী
এই বেন্ডে আমাদের আজকের ঠিকানা হোটেল আদিত্য প্যালেস। প্যালেস শুনে চমকে যাবেন না। ভাড়া মাত্র ৭০০ টাকা। দোতলা আবাস। তবে ওপরের ঘরগুলো বেশ সুন্দর। নীচের গুলো একটু ছোটো। দরাদরি করে ৫০০ করা হল। দূর থেকে আসা তীর্থযাত্রীরা বারকোটে এক রাত থেকে পরের দিন ভোরে উঠে জানকীচট্টি যান। সেখান থেকে ট্রেক করে যমুনোত্রী মন্দিরে পূজা দিয়ে আবার রাতের আগেই বারকোটে ফিরে আসেন। এর ফলে জানকীচট্টির হিমশীতল পরিবেশ থেকে বাঁচা যায়। এখানে এই বারকোটে একটু দূরে যমুনার পারে তাঁবুতে থাকাই যেত। সেখান থেকে যমুনোত্রী হিমবাহের পাহাড়ের দেখা মেলে। কিন্তু পকেট অনুমতি দেয়নি।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / দ্বিতীয় পর্ব : টিহরী থেকে উত্তরকাশী হয়ে হরসিল
এই বারকোটেই আমাদের আধার কার্ড দেখিয়ে নাম নথিভুক্ত করতে হল। তবে দুপুরের খাওয়ার পরে। ছবিও তুলে রেখে দিল। একটি অনুমতিপত্র জাতীয় কাগজ প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। যদিও সেই কাগজ কোথাও কাজে লাগেনি। তবে দেখানোর দরকার পড়লে বা বিপদে কাজে লাগে। এখানে ঠান্ডা অনেক কম। উচ্চতাও অনেক কমে গিয়েছে। কাল প্রায় ৩০০০ ফুট গাড়িতে উঠব, তার পর হাঁটা। তবে দুপুরের বৃষ্টি আমাদের পিছু ছাড়েননি। বৃষ্টি হয়ে একটু ঠান্ডা বাড়িয়ে দিল। না হলে গায়ে গরমজামা ছাড়াই চলছিল।

পরের দিন ভোর ৫টাতেই বেরিয়ে পড়লাম। একটু এগিয়ে দু’টো বাঁক নিতেই চমক। যমুনোত্রী হিমবাহের সঙ্গে আরও নাম-না-জানা দু-এক জন হাজির রূপের ডালি নিয়ে। এ যেন শেষ না হওয়া রূপকথা। ঘণ্টা তিন গাড়িতে থাকার পর আবার ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পৌঁছে গেলাম হনুমানচট্টি। এখানেও অনেকে থাকেন। এখান থেকেই হেঁটে যান। জিএমভিএনের টুরিস্ট বাংলো এখানেও আছে। তবে আমরা শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাব। একটু চা খেয়ে পুলিশের তল্লাশি পেরিয়ে আমরা এসে গেলাম জানকীচট্টি। এটা যমুনোত্রীর বেস ক্যাম্প। এখানেও আমাদের জিএমভিএন টুরিস্ট বাংলোয় বুকিং। ম্যানেজার নেই। একজন কেয়ারটেকার। একটু বয়স্ক। আমাদের ন’টা ঘর দেখাতে দেখাতে হাঁপিয়ে উঠলেন। তায় আমাদের দু’টো ঘর পছন্দ না হওয়ায় ইকো থেকে ডিলাক্স রুমে পরিবর্তন করে নিলাম। বাকি ঘরগুলি ১২টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস ছিল। কিন্তু ঠিক হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।

এই প্রথম আমাদের ঘর থেকেই দেখা দিলেন যমুনোত্রী হিমবাহ, একধারে কুলকুল করে বয়ে চলেছে যমুনা নদী। স্বর্গীয় অনুভুতি, কিন্তু ঘর অপরিচ্ছন্ন। তবে খাবারদাবার ভালোই। যাঁদের যমুনোত্রী যাওয়ার, তাঁরা চটপট আলুর পরোটা খেয়ে ঘোড়ার দরদস্তুর করে বেরিয়ে পড়ল। তাঁরা সংখ্যায় সাত। ঘোড়াপ্রতি যাওয়া-আসা নিয়ে ১০০০ টাকা। ডুলি চেপে যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল আমার স্ত্রীর। কিন্তু তারা ৮০০০ টাকা চেয়ে বসায় তিনি রণে ভঙ্গ দেন। স্বাভাবিক ভাবেই মনটা খারাপ। আমরা জনা ছয়েক টিফিন করে বেরিয়ে পড়লাম জানকীচট্টি ঘুরে দেখতে। মন্দিরের দূরত্ব ৫ কিমি। কিন্তু রাস্তা খাড়াই। তাই ও দিকে না গিয়ে টুরিস্ট বাংলোর দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোকের কথামতো চললাম সরস্বতী ও শিবমন্দির দেখতে। চড়াই এড়িয়ে যেতে গেলে অনেকটা ঘুরে যেতে হয়। তাই চড়াই পথই ধরলাম। আর কষ্ট করলাম বলে কেষ্টও মিলল, পথের সৌন্দর্য। প্রায় দু’ কিমি হেঁটে মন্দিরে পৌঁছোলাম। মা যমুনা কার্তিক পূর্ণিমার পরেই নেমে আসেন এই মন্দিরে। মন্দিরে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। অনেকেই সেখানে প্রসাদ ফেলে ফুটিয়ে নেন। বোতলে করে জল নিয়ে আসেনয়। তার পর মন্দিরে পূজা দেন। মায়ের শীতকালীন আবাসে আমরা অবশ্য সাধারণ ভাবেই সরস্বতী মায়ের ও শিবের পূজা দিলাম। যমুনার ঠান্ডা জলের ছিটে আর গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ পরিবেশটা বেশ প্রাণময় করে তুলল। এই মন্দিরের ঠিক মাথায় যমুনোত্রী হিমবাহ। আর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে যমুনা নদী। হু হু করে বইছে ঠান্ডা হাওয়া।

এর পর আমরা চললাম গাড়োয়ালী গ্রাম দেখতে। গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা। অনেকটা হেঁটে পৌঁছে গেলাম শনি-নাগদেবতা মন্দিরে। মূল মন্দিরটি চারশো বছরের পুরনো। পাথর ও কাঠ দিয়ে তৈরি। সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ভেতরে আলো খুব কম। মন্দিরের নীচে রামলীলার আয়োজন হচ্ছে। একটু দূরেই নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। ভেতরে ঢোকার জায়গা দেখতে পেলাম না। বাইরে থেকে প্রণাম সারলাম। শুনলাম শনিদেবতা এখন বদরী মহারাজের ওখানে গেছেন। নাগদেবতা আছেন। মন্দিরের পেছনেই তুষারশুভ্র পর্বতের উপস্থিতি। দর্শন শেষে ফিরে এলাম। কষ্ট কম হল, রাস্তা উৎরাই বলে। নীচে একটা ঝুলন্ত সেতু, যমুনা পেরোনোর ব্যবস্থা। এখান থেকেই শুর যমুনা-দূষণের।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / তৃতীয় পর্ব : গঙ্গোত্রীতে এক রাত
ক্লান্ত পদযুগলকে টেনে নিয়ে বাংলোয় ফিরে দেখি ঘর বসবাসযোগ্য হতে দেরি আছে। অগত্যা সামনের উঠোনে বসেই হিমবাহ দর্শন। এত কাছ থেকে হিমবাহ অনেকেই দেখেননি। এখন একটু ঠান্ডা কম, তাই পাহাড়ের গায়ের বরফ গলে যাচ্ছে। যাঁরা যমুনোত্রী মন্দির দর্শনে গিয়েছিলেন তাঁরাও ধীরে ধীরে ঘোড়ায় চেপে ফিরে এলেন। ততক্ষণে আমাদের দুপুরের খাওয়া সারা।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / চতুর্থ পর্ব : বারসুতে রাত কাটিয়ে বারকোটের পথে
সব ঘর পরিষ্কার হতে হতে বিকেল হয়ে গেল। বিকেলে সবাই যে যার ঘরে ব্যাগ রেখে একটি ঘরে মেয়েরা ও একটি ঘরে ছেলেরা জমায়েত হল। গল্প, তাস সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা। আমি এক বার ওই ঠান্ডায় বাইরে এসেছিলাম। চাঁদের আলোয় হিমবাহের অপার সৌন্দর্যের রূপ আমার সামনে ধরা দিয়েছিল। যমুনার কুলকুল শব্দ এখন যেন গর্জন। শুনলাম কয়েক মাস আগে মেঘফাটা বৃষ্টি ও সঙ্গে হড়কা বানের কবলে পড়েছিল এই অঞ্চল। এই বাংলো বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে সামনের একটি হোটেল। আজও পারদ শূন্যের নীচে। তাই বেশি দেরি না করে শুয়ে পড়াই মঙ্গল। কাল ফিরব মুসৌরি। অনেক পথ। (চলবে)
ছবি লেখক