
হরসিলে আমরা তুষারপাত পেলাম না। এই ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় হরসিলে ভালো তুষারপাত হয়েছে বলে শুনেছি। বিধি বাম। তবে তুষারপাত হলে পরিষ্কার সকাল উপভোগ করা যেত না। আজও সকাল ৭টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম গঙ্গোত্রীর পথে। বেশি রাস্তা নয়, ঘণ্টা খানেকের। কিন্তু আমরা থেমে থেমে যাব বলে একটু তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছি প্রতি দিন। আর থামব নাই-বা কেন? এক একটা মোড় ঘুরতেই বরফসাদা পাহাড়চূড়া এসে আমাদের দৃষ্টি সার্থক করে দিচ্ছে। আজও ব্যাতিক্রম নয়। একটু এগোতেই মাউন্ট শিবলিঙ্গ, সুদর্শন দেখা দিতে লাগলেন। যেন ডেকে নিয়ে যেতে চান। কালকে রাতে ঠান্ডার ধাক্কা এখনও সহযাত্রীরা সামলাতে পারেননি। তাই গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলার লোক আজ সামান্যই, ২-৩ জন। বাকিরা গরম গাড়ির ভেতরেই। কাল রাতের পারদ শূন্যের নীচেই ছিল বলে শুনেছি। বেরোনোর সময় দেখেছি, জমে থাকা জল জেলি বা সাদা সাদা হয়ে গিয়েছে। যাকে গ্রাউন্ড ফ্রস্টিং বলে। আজকে সকালেও সেই ঠান্ডা কমার কোনো লক্ষণ নেই। উলটে আজ রাতে আরও বেশি ঠান্ডা পড়বে। তবে কি বরফ পাব?
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / দ্বিতীয় পর্ব : টিহরী থেকে উত্তরকাশী হয়ে হরসিল
অচিরেই আমরা গঙ্গোত্রী মন্দির থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের গেটে এসে পৌঁছোলাম। এখানেই গাড়ির যাত্রা শেষ। আর এগোনোর অনুমতি নেই। আবার মালবাহক লাগবে, মালপত্র বয়ে নিয়ে যেতে হবে। এক এক বার এক এক মালবাহককে দিতে হবে ১১০ টাকা। এখানেও আমাদের থাকার জায়গা জিএমভিএন-এর ট্যুরিস্ট বাংলো। পাঠক, মনে রাখবেন এখানে জিএমভিএন-এর দু’টি বাংলো আছে – একটি ছোটো, গঙ্গোত্রী মায়ের মন্দির লাগোয়া আর অন্যটি বড়ো, মন্দির থেকে ৫০০ মিটার দূরে, নদীর অন্য প্রান্তে। আমাদের বুকিং ছিল বড়োটিতে। খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না। তবে একটু দূরে, এই যা। নদীর ওপরে তৈরি ব্রিজ পেরোতে হবে এবং একটু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলোয় পৌঁছোতে হবে। বয়স্কদের একটু অসুবিধা হতে পারে।

আমাদের দু’টি পরিবারের জন্য একটি রুমের ব্যবস্থা হয়েছে, যাকে বলা হয় ফ্যামিলি রুম। ভাড়া ১৬০০-এর মতো। বাকি প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে ডিলাক্স রুম। ডিলাক্স রুমে প্রাতরাশ বিনা পয়সায়। ঘর থেকে কোনো পর্বত দেখতে পাওয়া যায় না, কিন্তু সামনের লনে এলেই কেদার ও সুদর্শন হাজির রূপের পসরা নিয়ে। বাংলোটি এত সুন্দর জায়গায় যে ডান দিকে কয়েক পা এগোলেই সূর্যকুণ্ড নামের ঝরনা। প্রবল বেগে নেমে আসছে ভাগীরথী।আর এক প্রান্তে সীতাকুণ্ড।
পুরাণ অনুসারে সগর রাজার ষাট হাজার সন্তান কপিলমুনির অভিশাপে ভস্ম হয়ে গেলে তাদের উত্তরপুরুষ ভগীরথ তপস্যাবলে মা গঙ্গার আগমন ঘটান মর্ত্যে। সেই পুণ্য গঙ্গার স্রোতে মুক্তিলাভ ঘটে সগররাজার সন্তানদের। এই গঙ্গোত্রীতেই মা গঙ্গার মর্ত্যে আগমন। ভগীরথের নামে এখানে তিনি ভাগীরথী। দেবপ্রয়াগে আলকানন্দার সঙ্গে মিশে গঙ্গা নামে প্রবাহিত। কিন্তু মা গঙ্গার স্রোতধারা মহাদেবের জটায় ধারণ ছাড়া মর্ত্যের বিনাশ আটকানো সম্ভব ছিল না। তাই মনে করা হয় এই সূর্যকুণ্ডে মহাদেব গঙ্গামা-কে জটায় ধারণ করেন। বিজ্ঞান বলছে, অনেক আগে গঙ্গোত্রী হিমবাহ গঙ্গোত্রী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ধীরে ধীরে গোমুখ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। এখন আরও পিছিয়ে গিয়েছে, যার নাম গোমুখ ২। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ, গোমুখ ২ ট্রেক করে যাওয়া যায় বা ঘোড়ায় চড়ে।

মালপত্র রেখে কুলিভাড়া মিটিয়ে আমরা চললাম গঙ্গামায়ের মন্দির দর্শনে। সূর্যকুণ্ডে রামধনু দেখা যায়। কিন্তু আজ অদৃশ্য। সূর্যকুণ্ড থেকে মাউন্ট সুদর্শন দেখে ছবি তুলে এগিয়ে চললাম। ভাগীরথীর একটি ধারা পেরিয়ে, প্রধান ধারার ওপরে ব্রিজে পৌঁছোনোর আগে ভাগীরথী শিলা। মনে করা হয় এখানেই ভগীরথ শিবের তপস্যা করেছিলেন। তার পর ব্রিজ পেরিয়ে মন্দির। মন্দিরে প্রধান বিগ্রহ মা গঙ্গা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে এখানে পূজা দেন। আমিও ব্যতিক্রম নই। জল মাথায় দিলাম। ভালো ঠান্ডা, কিন্তু কেমন যেন সহ্য হয়ে গেল। ছোটো ছোটো ১০০ মিলিলিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে। ১০ টাকায় কিনে জল ভরে নিলাম। পুজোর প্রসাদ খই ও নকুলদানা। ভক্তিভরে খেয়ে নিলাম। ইতিহাস মতে, মন্দির তৈরি করেন নেপালি জেনারেল অমর সিং থাপা। নদীর এঁকে বেঁকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই এক পাশে মন্দির। মন্দিরের উঠোনে দাঁড়ালে উলটো দিকে মাউন্ট সুদর্শন, সঙ্গী কেদার। যেন মা গঙ্গাকে পাহারা দিচ্ছেন। অপরূপ দৃশ্য। একটু থেকে বেরিয়ে এলাম।
এ বার ফেরার পালা। ফেরার পথে খেয়াল করলাম বন বিভাগের রেস্টহাউস এখানেই আছে। দুপুরের খাওয়া এখনও একটু দেরি আছে। তাই চললাম দেড় কিলোমিটার দূরের পাণ্ডব গুহা দেখতে। প্রথম দিকে ভালো চড়াই-উৎরাই থাকলেও শেষের দিকে প্রায় সমতল রাস্তা। দেড় কিমি থেকে একটু বেশিই হবে। হেঁটে যেতে বেশ লাগে। জঙ্গলের ভেতরে গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাখির ডাক শুনে এগিয়ে চলা। নীচে দিয়ে বয়ে চলা ভাগীরথীর গর্জন। অবশেষে পৌঁছে গেলাম। একটা বড়ো পাথরের ভেতরে ছোটো গুহায় কয়েক জন সাধুর বসবাস। রান্নার ধোঁয়ায় ভেতরে থাকা বড্ড কষ্টকর। রাস্তার সৌন্দর্যের সঙ্গে এই জায়গাটার কোনো তুলনাই চলে না। তাই একটু হতোদ্যম হয়েই ফিরে চললাম।

সর্বত্র ফেরার সময় কম লাগে। এ বারেও তাই। তার মধ্যে বাংলো থেকে সহযাত্রীদের ফোন, আমার চলার গতি বাড়াতে আরও সাহায্য করল। দুপুরের গরম গরম নিরামিষ খাবার ডাকছে। ২০ মিনিটে ফিরে এলাম। পেটে চনমনে খিদে, গোগ্রাসে গিলে নিলাম সব। কিন্তু খাওয়ার পর থেকেই ঠান্ডা লাগতে লাগল বেমক্কা। হাঁটাচলার জন্য যে গা গরম হয়েছিল তা কিছুক্ষণের মধ্যেই উধাও। বেজায় ঠান্ডায়ে শরীরের হাড়গুলো যেন ঠোকাঠুকি করতে লাগল। সূর্য ডুবতেই উষ্ণতা একদম নিশ্চিত শূন্যের নীচে। ওদের অফিসরুমের বাইরে লাগানো থার্মোমিটার জানা দিচ্ছে -২ ডিগ্রি এখনই। রুমহিটারের খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেল না। পেলেও লাভ হত না। সারা দিন বিদ্যুতের দেখা নেই। সন্ধের পর থেকেই চলছে জেনারেটর। ১১টা অবধি আলো জ্বালিয়ে রাখা, তার পরেই অন্ধকার। এরই মধ্যেই রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / প্রথম পর্ব : ধনৌলটি ছুঁয়ে নিউ টিহরী
চলছে কনকনে হাওয়া। বরফের পাহাড়গুলো খুব কাছে হওয়ায় ঠান্ডা মাত্রাতিরিক্ত। পরের দিন সকাল সকাল ছবি তুলেই পালিয়ে আসার পথ ধরলাম। সকাল ৬টা নাগাদ সব গুছিয়ে বেরিয়ে আসার সময় উষ্ণতা দেখা গেলো -২। আজ যাব বারসু।
প্রসঙ্গত বলে রাখি গঙ্গোত্রীর উচ্চতা ১০ হাজার ফুটের একটু বেশি। সাধারণত শ্বাস নিতে অসুবিধা না হলেও, উত্তেজনা, ক্রোধ ইত্যাদিতে শ্বাসকষ্ট শুরু হতেই পারে। দরকারে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে হবে। অতিরিক্ত ঠান্ডা থেকে বাঁচতে চকোলেট বা গা গরম রাখার খাবার খাওয়া প্রয়োজন। তবে নিরামিষ একমাত্র ভরসা, কারণ মাংস নৈব নৈব চ। ওতেই মানিয়ে নিতে হবে। (চলবে)
ছবি: লেখক