এ কঁহা আ গয়ে হম
ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লাম। চিনিয়ালসর, ধরাসু বেন্ড হয়ে উত্তরকাশীর ‘হোটেল গঙ্গাশ্রয়’ আজ আমাদের গন্তব্য। কিন্তু গাড়ি গতি তুলবে কী করে? চিনিয়ালসরের রাস্তা ধরতেই তো স্বর্গে প্রবেশ। ধীরে ধীরে সূর্যদেবতার উদয়, ডান দিকে নীচে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, দূরে গাড়োয়াল মণ্ডলের ভাসমান কটেজ। পাহাড়েঘেরা ভাগীরথীর পাখির চোখে দৃশ্যায়ন। পুব আকাশ রক্তিম। বাঁকে বাঁকে শিহরন। বার বার গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা আর চোখের আরাম। এ দিকে দেরি হয়ে গেলে উত্তরকাশীতে আমাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে সমস্যা হতে পারে। তাই একটা তাড়া ছিলই। না হলে এখানেই তো থেকে যাওয়া যায়। এ ভাবেই ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম ধরাসু বেন্ড। এখানে রাস্তা দু’ ভাগ – একটা গিয়েছে বারকোট হয়ে যমুনেত্রী বা দেহরাদুন আর অন্যটি উত্তরকাশী হয়ে হরসিল এবং গঙ্গোত্রী। আমরা দ্বিতীয়টি তথা ডান দিকে উত্তরকাশীর রাস্তা ধরলাম। তার আগে সেরে নিলাম প্রাতরাশ।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / প্রথম পর্ব : ধনৌলটি ছুঁয়ে নিউ টিহরী
গাড়ি চলতে শুরু করতেই আবার থামাতে হল। ধরা দিলেন মাউন্ট বান্দরপুঁছ। একটা বাঁক পেরোতেই। বাঁদরের লেজের মতো বলে এঁর নাম বান্দরপুঁছ। তিনটি শিখর নিয়ে দাঁড়িয়ে। ইলেকট্রিক তারের বাধা টপকে মনের মতো ছবি হয়ত তোলা গেল না, কিন্তু চোখের আরাম ষোলো আনা। আবার গাড়ি এগিয়ে চলল। ঘণ্টা চারেক পরে উত্তরকাশী শহরে প্রবেশ। প্রথম এলাম কৈলাস আশ্রমে। এখানে পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল আমাদের। সাধুসন্তদের ‘ভাণ্ডারা’ প্রদান। কয়েক ঘণ্টার অনুষ্ঠান সমাধা করে অনেকে আশ্রমেই মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিলেন। আশ্রমের পাশেই বয়ে চলেছে ভাগীরথী। গঙ্গাদর্শন করে পৌঁছে গেলাম প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে আমাদের আজকের আস্তানা ‘হোটেল গঙ্গাশ্রয়’-এ। ঘরপ্রতি ভাড়া ১২০০। হোটেলটি একদম নদীর ধারেই। নদী কিছুটা নিচু দিয়ে প্রবাহিত। ঘরের পাশে লনে দাঁড়ালেই দেখা যায় এঁকে বেঁকে নদী এসেই আবার পাহাড়ের বাঁকে মিলিয়ে গেল। কয়েক ধরনের মাছরাঙার দেখা পেলাম।
একটু বিশ্রাম নিয়েই চলে গেলাম কাছেই মনুষ্যসৃষ্ট খেড়ি ফলস দেখতে। এটা একটি উপ-জলধারা, যা ভাগীরথীতে এসে মিশেছে। জলপ্রপাতের পাশে তৈরি হয়েছে রামধনু। শেষ বিকেলে এখানে পৌঁছোনোর মজাই আলাদা। ফিরে এসে নামলাম নদীর বুকে। জল ভালো ঠান্ডা। একে তো বরফগলা, তায় এখানে তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই ঠান্ডার দাপট। তাড়াতাড়ি রাতের আহার শেষ করেই সারা দিনের ক্লান্তি দূরে করতে বিছানায় আশ্রয় নিলাম। তবে তার আগে এক প্রস্থ গানের লড়াই খেলে নিতে অসুবিধা হল না। এই স্বর্গীয় ভুমিতে মন আনন্দে গুন গুন করে উঠবেই “এ কঁহা আ গয়ে হম, তেরে সাথ…।” কাল আমাদের স্বপ্নের গন্তব্য হরসিল।
উত্তরকাশীর ‘হোটেল গঙ্গাশ্রয়’ নিঃসন্দেহে ভালো। শহর থেকে একটু দূরে, কিন্তু নিরিবিলি। তবে খাবারের দাম নিয়ে দরাদরি আবশ্যক। না হলে বেশি দামে কম খাবার। এ ছাড়া এখানে একটা অঙ্কগত সমস্যা দেখছি – সরকারি বেসরকারি সর্বত্রই। হিসেবে ভুল করা – মোট ক’টা রুটি খেলাম, খাবারের বিল কম-বেশি করে ফেলা ইত্যাদি। তাই নজর রাখতে হচ্ছে।
হরসিলের পথে
কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করেই সক্কাল সক্কাল শয্যা ছাড়তে হল।৬টাতেই রওনা দিলাম হরসিলের পথে – রাজ কাপুরের স্বপ্নের হরসিল। উচ্চতা প্রায় ৮০০০ ফিট। এখানে আমাদের থাকার জায়গা জিএমভিএন-এর লজে।
গাড়ি চলছে, পাশে পাশে ভাগীরথীও। আগের দিন দেখা খেড়ি ফলসের একটু আগে উত্তরাখণ্ড পুলিশ প্রতিটি গাড়ির তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে। খেড়ি ফলস ছাড়িয়ে মানেরি বাঁধ পেরিয়ে চলতে লাগলাম। মানেরি বাঁধও সুন্দর, প্রায় টিহরীর দোসর। সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তবে আমাদের গ্রুপ ক্যাপ্টেনের ম্যানেজ করার একটা ‘স্কিলে’ আছে। তাতেই ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম, তবে ছবি তোলা নৈব নৈব চ। ভাটোয়ারিতে গাড়ির চাকা ঠিক করানো হল। এর পরে আর গাড়ির সারাই বা তেল ভরার আর কোনো দোকান পাওয়া যাবে না।
এই পথ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। তাই প্রায়ই বাঁকে বাঁকে গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা আর সেই সৌন্দর্যের স্বাদ নেওয়া চলছে। তার ওপর বড়ো গাড়ি, গতি তুলনায় কম। তাই মাত্র ৬৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হরসিল পৌঁছোতেও কম করে চার ঘণ্টা লেগে গেল।
‘পাহাড়ি’ উইলসনের রাজ্যে
ভাগীরথী একটু ডান দিকে মোচড় নিয়ে এগিয়ে গিয়ে এই ভাবে একটা সুন্দর উপত্যকা বানিয়ে ফেলবে তা কল্পনা করতে পারিনি। সেনাবাহিনীর ক্যাম্প পেরিয়ে, ছোটো একটা নদীর ওপর দিয়ে এগিয়ে হরসিল গ্রামে প্রবেশ করা পর্যন্ত চারিদিকে বরফপড়া পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু ভাগীরথী দেখতে আমাদের হরসিল জিএমভিএন-এর লজ অবধি যেতেই হত। মালপত্র বয়ে আনার জন্য কুলির ব্যবস্থা করে, ঘরের দাবি পেশ করে, আমাদের ঘরে মালপত্র ঢুকিয়ে ছুটলাম লজের লনে। সেখানে চমক। ঘরে বসে সব পাওয়া যাবে না। সামনের দিকের ঘরগুলি বা ওপরের ঘরগুলি থেকে কিছু দৃশ্য পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ ঘরেই দৃশ্য নেই। তবে লনে কাচ দিয়ে ঘেরা কয়েকটি ঘর। সেখানে বসে আড্ডা ও ভাগীরথী দর্শন। সাথী হিমালয়ের কিছু বরফাবৃত চূড়া – বান্দরপুঞ্চ, শিবলিং, সুদর্শন – আরও কত! সব নাম কি ছাই জানি?
চূড়াগুলোতে একটু যেন কম কম বরফ। গলে গিয়েছে হয় তো। কিন্তু প্রকৃতিদেবী একটু বেলা বাড়তেই মেঘ এনে সেই খামতি মিটিয়ে দিতে লাগলেন। আমরা দূর থেকে সেই হোয়াইট ওয়াশ দেখতে লাগলাম। অনেকখানি জায়গা জুড়ে ভাগীরথী এঁকে বেঁকে, লজের সীমা চুম্বন করে, দূরের পাহাড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। স্রোত ভয়ানক বেশি, তবে জল কম। নদীর ধারে অসংখ্য নুড়িপাথর আর অগুনতি পাখির সমাহার। লালঝুঁটি থেকে সাধারণ বুনো পায়রা, উপস্থিত সবাই। কারণ? নদীর ধারে ভেসে আসা আপেল। এখানে আপেলের চাষ হয়। আর এ বছর আপেলের ফলন বেশ ভালো। লজের নিজস্ব গাছে আপেল পেড়ে খেতে আপত্তি নেই, কিন্তু গ্রামের মানুষের ফল পাড়া যায় না। বাজারে আপেলের দাম ২০ টাকা প্রতি কেজি। কল্পনা করা যায়?
হরসিল বলিউডখ্যাত। গল্প শুনেছি রাজ কাপুর সাহেব হরসিলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বানিয়েছিলেন ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’র মতো সিনেমা। এর বেশির ভাগ শুটিং এখানেই। মন্দাকিনীর নামে একটা ঝরনাও আছে, কিন্তু খুঁজে পেতে একটু কষ্ট। রাজ কাপুর কেন মুগ্ধ হয়েছিলেন তা এসেই বুঝতে পারছি। চারিদিকে বরফসাদা পাহাড়ের মাঝে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া ভাগীরথী তৈরি করেছে এক মনোরম উপত্যকা, এই এত্ত উঁচুতে। আর সেই উপত্যকায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আপেলগাছ।
এই হরসিলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘পাহাড়ি’ উইলসনের নাম। পুরো নাম, ফ্রেডরিক ই উইলসন। অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় উইলসন ১৮৫৭-এর সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ আর্মি ছেড়ে পালিয়ে এসে টিহরী মহারাজের আশ্রয় চান। কিন্তু ব্রিটিশবন্ধু মহারাজ তাঁকে আশ্রয় না দেওয়ায় তিনি পালিয়ে আসেন হিমালয়ের এই দুর্গম জায়গায়, লুকিয়ে থাকেন এই হরসিলে। বিয়ে করেন গুলাবি নামে এক পাহাড়ি-দুহিতাকে। তার পর পাহাড়ি মানুষদের আপেলের চাষের উপায় বাতলে ও গাছের গুঁড়ির ব্যবসা করে ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে যান ‘রাজা’। লোকমুখে আজও তাঁর কাহিনি ঘোরে।
নদীতে নামা যেত। তবে সাহস হল না, একে নদী খরস্রোতা, তার ওপর আমার ‘ব্যালেন্স’ খুব একটা ভালো না। তবে চোখ ভরে দেখলাম প্রকৃতি। বেলা বাড়তেই হু হু করে হাওয়ার দাপট। মেঘে ভরে গেল আকাশ। মাঝারি বৃষ্টি শুরু হল। আশা জাগল যদি বরফ পড়ে। এখানে প্রকৃতি এখন এ রকমই। সকালে পরিষ্কার, বেলা বাড়তে থাকলে মেঘ এসে হাজির হবে। তার পর বৃষ্টি হয়ে আবার রাতের দিকে পরিষ্কার। স্থানীয়রা বললেন, আজ একটু বেশি সময় বৃষ্টি হল। আশেপাশের সবুজ পাহাড় স্নান করে আরও সুন্দর হল।
আর চোখের সামনে দেখতে পেলাম সামনের উচ্চ শৃঙ্গগুলি আরও সাদা। অনেক নীচে পর্যন্ত বরফ পড়েছে। চাঁদ উঠল। তবে মাথার ওপরে। লজের আলোয় আলাদা করে খুব বেশি না হলেও সামান্য সামান্য দেখা যেতে লাগল। কলকাতার সংস্থা ওয়েদার আল্টিমা আসার আগে আমাকে বলে দিয়েছিল যে এই সময় পশ্চিমী ঝঞ্জার কারণে হরসিল বা গঙ্গোত্রীর মতো উঁচু জায়গায় বৃষ্টি তো পড়বেই, বরফও পড়তে পারে। তাই আশায় বুক বাঁধলেও শেষমেশ হতাশই হলাম। রাতের ঠান্ডা ভয়ংকর। শূন্যের কাছাকাছি। বাঁচোয়া যে রুমহিটার চলছিল, বিদ্যুতেরও সমস্যা হয়নি।
আমার হরসিলে দু’ রাত থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনায় এক রাত। ঠান্ডায় কষ্ট করে এক রাত কাটিয়ে দেওয়া যায় শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দৃশ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখানে প্রকৃতি যেন একটু বেশি সুন্দর সাজে। বৃষ্টি না হলে হয়তো গ্রাম ঘুরে দেখতাম। তবে পরের দিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়ার তাড়ার মধ্যেও সকালের পরিষ্কার আকাশে আরও কয়েক বার উপত্যকার সৌন্দর্য অবলোকন করতে ভুলিনি। আবার কবে আসব কে জানে আমার এই স্বপ্নপুরীতে। (চলবে)
ছবি: লেখক