
সকালের প্রথম আলোয় ঝলমলে যমুনোত্রী হিমাবাহ চোখধাঁধানো রূপ নিয়ে সামনে হাজির। কাল রাতে পাহাড়ের চুড়ায় বরফ পড়েছে। আরও সুন্দর, আরও মসৃণ। কিন্তু আমরা একটু জলদি বেরিয়ে পড়ছি প্রতি দিন। আজও ব্যতিক্রম নয়। আজ আমাদের দুই সহযাত্রী দেবেশ-মণিকা আমাদের ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছেন কেদারনাথের পথে। তাঁদের বারকোটে নামিয়ে দিয়ে যাব। সেখান থেকে বাসে উত্তরকাশী যাবেন তাঁরা। তাঁর পর সেখান থেকে শ্রীনগর হয়ে গুপ্তকাশীর পথে চলে যাবেন। আমরা এগিয়ে যাব মসুরীর (সাহেবরা যে শহরকে বলতেন মুসৌরি) পথে।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / প্রথম পর্ব : ধনৌলটি ছুঁয়ে নিউ টিহরী
পরিকল্পনা মাফিক যাত্রা শুরু। ঘণ্টা দুই চলার পর বারকোট বেন্ডে পৌঁছে ধরাসুর রাস্তায় না গিয়ে দেহরাদুনের দিকে গাড়ি চলতে লাগল। পৌঁছোলাম বারকোট শহরে, বারকোট বেন্ড থেকে ৮ কিমি। এখানে খাবারদাবারের ভালোই ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু অপরিচ্ছন্ন, দামও বড়ো বেশি। এ দিকে জানকীচট্টির জিএমভিএন রেস্ট হাউসে স্নান করার সময় পড়ে গিয়ে আমাদের সহযাত্রী রুদ্রাণীমামি (দত্ত) হাতে চোট পেয়েছেন। তাঁরা অন্য গাড়িতে আমাদের পেছনে আসছেন। আমরা একটু খোঁজাখুঁজি করে এক্সরের দোকান পেয়ে গেলাম ঠিকই, কিন্তু খুলতে দেরি। তাই মসুরীর হোটেলে ফোন করে সেখানে এক্সরে করার ব্যবস্থা করা হল। প্রাতরাশ সেরে নিলাম। দেবেশদাদের বাসে তুলে দেওয়া হল। ইতিমধ্যে রুদ্রাণীমামিরা এসে পড়লেন। আমাদের দু’টি গাড়ি চলল মসুরীর পথে। ঘণ্টা চারেজের জার্নি। ঘণ্টা তিনে চলার পর আমাদের সামনে দিগন্তবিস্তৃত পর্বতমালা উন্মুক্ত হল। গাড়োয়াল হিমালয়ের প্রায় সব ক’টি পর্বতশৃঙ্গ এখান থেকে দেখা যায়। তবে আজ একটু বেলা হয়ে যাওয়ায় সে সব মেঘে ঢাকা। একটু দমে গেলাম। এল কেম্পটি ফলস। আপাতত নামলাম না। এগিয়ে চললাম শহরের দিকে। আরও প্রায় ৪৫ মিনিট গাড়ি চলার পর ম্যাল রোডের সামনে এসে গেলাম। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে হোটেল দীপে, ক্যামেলস ক্যামেল ব্যাক রোডে। সেটি ম্যালের শেষ প্রান্তে। গাড়ি ঘুরিয়ে পৌঁছোলাম সেখানে। এখান থেকে প্রায় ৭০০ মিটার হেঁটে যেতে হবে। প্রায় সমতল রাস্তা, তাই হেঁটে যাওয়া সমস্যার নয়। পাঁচ জন মালবাহকের পিঠে মাল চাপিয়ে দললাম হোটেলে।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / দ্বিতীয় পর্ব : টিহরী থেকে উত্তরকাশী হয়ে হরসিল
ভালোই লাগল হোটেল দীপ। আমাদের ঘর ছিল চারতলায়। লিফট আছে। সামনে খোলা বারান্দা। সেখান থেকে কেদার পর্বত দেখা যায়। তবে এখন সবই মেঘে ঢাকা।

দুপুরের খাবার খেতে বিকেল হয়ে গেল। পড়ন্ত সূর্যের আলোয়, বারান্দায় বসে হালকা শীতের আমেজে আমাদের ‘অপরাহ্নভোজ’ শেষ হল। সন্ধের আগেই সন্দীপমামারা চলে গেলেন দেহরাদুন। সেখান থেকে দিল্লি পৌঁছে, মামির হাত দেখিয়ে, কলকাতার বিমান ধরবেন। আমাদের মহিলাকুল ও তাঁদের স্বামীরা গেলেন বাজার করতে। এই ভ্রমণের শেষ দিন কাল। তাই যার যা টাকাপয়সা বেঁচেছে, তা দিকে কেনাকাটি করা বোধহয় খুব জরুরি! আমি ভাগ্যক্রমে সঙ্গে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেলাম। রেহাই পেলেন গ্রুপের নেতা সুগত বসুও। কিন্তু দু’জনে মিলে পরশু ফেরার পরিবর্তিত পরিকল্পনা নিয়ে সারথির সঙ্গে কথা বলে নিলাম। ঠিক ছিল হরিদ্বারে নামব। কুম্ভ এক্সপ্রেসে টিকিট না মেলায় আমাদের সাহারানপুর হয়ে ফিরতে হবে। সেখান থেকে ধরব গুরুমুখী এক্সপ্রেস। উত্তরপ্রদেশে ঢুকতে হবে। ফলে লাগবে রোড ট্যাক্স। তাই গাড়ির ভাড়া কিছু বেশি পড়বে। সে সব নিয়েই সারথির সঙ্গে কথাবার্তা।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / তৃতীয় পর্ব : গঙ্গোত্রীতে এক রাত
পরের দিন সকাল হতেই ঝলমলে কেদার শৃঙ্গ আমাদের সামনে। তবে মসুরী শহরও দূষণে আক্রান্ত। ফলে একটা কুয়াশা-ধোঁয়াশা ভাব রয়েছে। এক দিকে ঘড়িঘর, সে দিকেই সূর্য উঠল। সকালের খাবার বাইরেই খাব। তাই সূর্যোদয়ের একটু পরেই বেরিয়ে পড়লাম। আজ মসুরী ঘুরে দেখব। শেষে ম্যাল হয়ে কেনাকাটা করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি। এক স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটবে।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / চতুর্থ পর্ব : বারসুতে রাত কাটিয়ে বারকোটের পথে
ইংরেজ জেনারেল ফেড্রিক ইয়ং-এর শখ হয়েছিল শুটিং গেম খেলতে। এখানে এসে তিনি হাওড়া-কলকাতার মতো জমজ শহরের পত্তন করেন – মসুরী আর ও ল্যান্ডর, প্রায় সাড়ে ছ’ হাজার ফুট উচ্চতায়। এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানেই থেকে যান। প্রথম গোর্খা বাহিনী তৈরি করেন ও আলুর চাষ করেন। আমরা যে ক্যামেলস ব্যাক রোডে আছি, সেখানেই উনি একটি শুটিং স্পট তৈরি করেন। সাহেবি শখ। পরে এখানে ক্যান্টনমেন্ট তৈরি হয়। তৈরি হয় ঘড়িঘর। মানে ইতিহাসের পুরো এক প্যকেজ। কাছেই ঘড়িঘর। সরু রাস্তায় একটু এগিয়ে ঘড়িঘর দেখে কেম্পটি ফলস-এর দিকে এগোনোর পথে দেখে নিলাম মসুরীর সর্বোচ্চ পয়েন্ট লাল টিব্বা। এখান থেকে হিমালয়ের দৃশ্য অতুলনীয়। তবে হালকা কুয়াশা আছেই। ক্যামেলস ব্যাক রোড এখান থেকে দেখতে অনেকটা উঠের পিঠের মতোই।

কেম্পটি পৌঁছোতে ৪৫ মিনিট লাগল। সেখানে খানিক নামার পর কেবলকারে চেপে বসলাম। ঝরনা যেখানে পড়ছে সেখানে পৌঁছে দেবে এই কেবলকার। এই কেবলকারে নামা ও ওঠা জনপ্রতি ১৫০ টাকা। শুধু উঠতে লাগে ১০০ টাকা। আমরা নামা-ওঠার টিকিট কেটে চেপে বসলাম। মিনিট খানেকের যাত্রায় পৌঁছে দেয় একদম নীচে। তবে স্নান করার মূল জায়গাটি একটু ওপরে। তাই আবার উঠতে হয়। আছে ব্রিজে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সুযোগও। যেখানে কেবলকার থেকে নামলাম, সেখানে রয়েছে টি স্টল, রয়েছে গাড়োয়ালি পোশাকে সজ্জিত হয়ে ছবি তোলার সুযোগ। আমরা ঘণ্টা খানেকে সব করলাম। তার পর উপরে উঠে এসে একটি হোটেলে দুপুরের খাওয়া। বিশ্রামের সময় নেই, আবার ছুট। গাড়ি ফিরে এসে নামিয়ে দিল ম্যাল রোডের মুখে। এখান থেকে হেঁটে বা রিকশায় হোটেল ফিরতে হবে। আমরা কেনাকাটা করতে করতে পদব্রজে এগিয়ে চললাম। খানিক বিশ্রাম, একটু কফি পান, আবার হন্টন। এ বার পৌঁছোলাম ‘গান হিল’ যাওয়ার কেবলকার স্টেশনে। আমাদের কেউ কেউ চেপে বসল। ‘গান হিল’ থেকে সমগ্র মসুরী ও দেহরাদুন শহর দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু বিকেলের দিকে কুয়াশার দাপট বেশি থাকায় মসুরী ও দেহরাদুন যে দৃশ্যমান হবে না, তা বলাই বাহুল্য। তাই অতিরিক্ত খরচের পথ আর মাড়াইনি। এর পর হেঁটে হোটেল ফিরে আসা আর রাত কাটিয়ে পরের দিন ট্রেন ধরার প্রস্তুতি। সাহারানপুর থেকে আমাদের ট্রেন বেলা সাড়ে এগারোটায়। বেরিয়ে পড়তে হবে ৬টাতেই।
আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / পঞ্চম পর্ব: বারকোটে রাত কাটিয়ে জানকীচট্টি
আজ আর দেহরাদুন শহর ঘোরার বা সহস্রধারা জলপ্রপাত দেখার সময় হল না। পরিবর্তে যা পেলাম, তা-ই বা কম কি! দেহরাদুন শহর পেরিয়ে সাহারানপুরের রাস্তা ধরতেই চড়াই-উৎরাই। এবং ঢুকে গেলাম রাজাজি জাতীয় উদ্যানে। এটি ঠিক জানা ছিল না। জানতাম একটা জঙ্গল পেরোতে হবে। সেটা যে রাজাজি জাতীয় উদ্যান তা বোর্ড দেখে জানতে পারলাম। বেশ উৎসাহিত হলাম। তবে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা হলেও সে ভাবে কিছু নজরে এল না, হনুমানের দল ছাড়া। জঙ্গলের গন্ধ নিয়েই সমতলে নামতে হল। অবশেষে সাহারানপুর থেকে গুরুমুখী এক্সপ্রেস ধরা এবং এক স্বপ্নময় ভ্রমণের সমাপ্তি। (শেষ)
আমাদের যাত্রাপথ আর একবার: কলকাতা-দিল্লি-হরিদ্বার-ধনৌলটি-টিহরী-উত্তরকাশী-হরসিল-গঙ্গোত্রী-বারসু-উত্তরকাশী-ধরাসু বেন্ড-বারকোট বেন্ড-যমুনোত্রী-বারকোট শহর-মসুরী-দেহরাদুন-সাহারানপুর-কলকাতা।
ছবি লেখক
গাড়োয়াল ভ্রমণ সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য জানতে চান –
পড়ুন : পুজোয় চলুন / ভ্রমণ অনলাইনের বাছাই : গাড়োয়াল