
ছোট্টবেলা থেকে মা-বাবার সঙ্গে কোলে চেপে, হাত ধরে, প্রচুর ভ্ৰমণ করেছি। যাওয়ার আগে তোড়জোড়, প্যাকিং করা থেকেই মনটা ঘুরতে শুরু করে দেয়। অনিন্দ্যকাকুরা, মানসকাকুরা আর আমরা সাত জন য্খন একেএকে সকলে শিয়ালদহ স্টেশনে এসে পোঁছোলাম মনটা আমার এ বার ভাসতে শুরু করে দিল।
এ বারের বেড়ানোয় আমার একটা অন্য ভূমিকা আছে আর সেটা হল এ বার বেড়ানোর গল্পটা বাবা আমায় বলতে দিয়েছে। যে হেতু সামনের বছর আমি ভোট দেব তাই আমি আর এখন ছোটো নই, ফলে আমার গল্পতে একটু ‘অ্যাডাল্ট’ গন্ধ থাকতে পারে! সেটা আগেই বলে নেওয়া ভালো।
দাৰ্জিলিং মেলের পাশাপাশি দু’টি কূপের একটিতে আমরা চার জন মহিলা আর অন্যটাতে বাবা আর কাকুরা মিলে তিন জন থিতু হতেই খাওয়া আর গল্প শুরু। এর মধ্যে জানলার বাইরে তাকাতেই চোখ পড়ল গোল চাঁদের দিকে, পরশু দোলপূর্ণিমা! রূপ যেন ফেটে পড়ছে! কেমন যেন ঘোর লেগে গেল। তার পর ট্রেনের এক টানা ঝমঝম শব্দে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম কে জানে!

সকালে ফ্রেশ হয়ে সিকিমের বইটা খুললাম। একটা লাইনে চোখ আটকে গেলো “উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ” আরে এ তো শেষের কবিতার লাইন! অমিত, লাবণ্য আর রডোডেনড্রন, ভাবতে ভাবতে দেখি এনজেপি পৌঁছে গেছি। এই স্টেশনটায় এলে প্রতি বারই কেমন যেন একটা পাহাড় পাহাড় গন্ধ পাই। এ বারেও তাই, কারণ গাড়িতে উঠে বাবা বলল এ বারে আমাদের গন্তব্য সিকিম পাহাড়ে প্রকৃতির কোলে “নিঃশব্দ সংগীতের আখড়া” ওখরে, সেখান থেকে হিলে-ভার্সে।
কিছুক্ষণ পরেই থামলাম তিস্তার ধারে এক চায়ের দোকানে। গিয়ে দাঁড়ালাম আমার বহু পরিচিত তিস্তার পাড়ে। কিন্তু পাহাড়ের বাঁকে বয়ে চলা সেই একই তিস্তা দেখে এ বারে মনের মধ্যে কেন জানি না, শিরশির করে উঠল! বুঝতে পারলাম না! মনে হল, সে যেন সমবয়সি আমারই এক চপলা সখী। মানসকাকু গুনগুন করে উঠল, “মেঘ পিওনের ব্যাগের ভেতর মনখারাপের তিস্তা”!
কিছুক্ষণের মধ্যেই গেট পেরিয়ে সিকিমে ঢুকে পড়লাম। এ বারে আমার মোবাইলে গুগুল ম্যাপ! তাই দেখেই আমি নেভিগেট করছি আমাদের দলকে। সেই দেখেই আমি বুঝলাম, যে শিলিগুড়ি থেকে অলরেডি ৮৪ কিলোমিটার দূরে চলে এসেছি, জোড়থাংএ। দেখা পেলাম রঙ্গীত নদীর। ওখরে আরও ৫৪ কিলোমিটার!
অপরূপ সেই পাহাড়ি রাস্তা, বাঁকের পর বাঁক। শীত-ঘুমের পর পাহাড় সেজে উঠছে নানা রঙের ফুলে, ছোটো ছোটো বাড়িগুলোতেও নানা ফুলের সমারোহ। যেন “আজি বসন্ত এসেছে বনে বনে।”
এসে গেলাম সোমবাড়িয়া। এটা একটু জমজমাট জায়গা, দোকানপাট বেশ কিছু আছে। এখান থেকেই ডান দিকে গিয়েছে কালুক হয়ে রিনচেনপং যাওয়ার রাস্তা।
অবশেষে চলে এলাম আমাদের আজকের গন্তব্য ‘ওখরে’। ওখরের হোমস্টেতে দাঁড়িয়ে মনে হল যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি! অনেক চলার পরে এ যেন দু’ দণ্ড বিশ্রামের আর নিশ্চিন্ত ঘুমের এক আদর্শ জায়গা! জিনিসপত্র রেখে, লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়লাম, একটু আশপাশ ঘুরে দেখতে, ‘রেইকি’ করা যাকে বলে, আর কী! ঠান্ডাটা বেশ মালুম হচ্ছে। জনপ্রিয়তা যদি গুণমানের মাপকাঠি হয়, ওখরে কিন্তু আম-ভ্রামণিদের হতাশ করবে। সাইটসিয়িং সত্যি বলতে তেমন কিছুই নেই, তবে ঘন নীল আকাশ, কনকনে কড়া শীত, ঝলমলে নরম রোদ আর উত্তুরে হাওয়াকে, যদি সঠিক পরিমাণে মেশাতে পারেন, তবেই ওখরে-কে আন্দাজ করতে পারবেন! হরেক রকম পাখি আর যে দিকে তাকাও রক্তবর্ণ রডোডেনড্রন।

আমরা কয়েকটি প্রাণী ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছি, প্রাণ ভরে উপভোগ করছি প্রকৃতির এই মৌন মুখরতা। কে যেন গুনগুন করছে রবীন্দ্রসংগীতের কলি, শুনে শিরিশির করে উঠল শরীর, শীতের জন্যই বোধহয়, নাকি অন্য কিছু!
বাবারা, ক’জন চা খাবার ছুতো তুলল। সামনেই এক চায়ের ঠেক – একাধারে মুদি, স্টেশনারি, রেস্টুরেন্ট আবার হোমস্টে। আমরা সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠলাম, ওখানেই চা সার্ভ করা হবে। ধূমায়িত পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ আমাদের চোখ আটকে গেল পশ্চিমাকাশে। সেখানে চলছে সূর্যাস্তের রঙের খেলা! কে যেন রং তুলি নিয়ে আকাশের ক্যানভাসে এঁকে দিচ্ছে এক অপার্থিব ছবি! আগামী কালের দোলের পূর্বাভাস হবে হয়তো! নিঃশব্দ প্রকৃতিতে, গম্ভীর পাহাড়ের উপস্থিতি এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে, আমরা যাকে বলে ‘স্পেল বাউন্ড’!
পাহাড়ে সন্ধ্যা নামা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। ছোট্ট বাটির মতো উপত্যকায় সূর্য ঢলে গেলেই ঝুপ করে নেমে আসে অন্ধকার। তার সঙ্গে জাঁকিয়ে বসে শীত। আমরা তাড়াতাড়ি পা চালালাম আমাদের ডেরার দিকে।
বাবার প্রস্তাবনায় আমাদের হোমস্টের মালকিন, আন্টি, লজের লনে এক ট্রাইবাল ডান্সের আয়োজন করে ফেললেন। আশেপাশের কয়েক জন কিশোর-কিশোরী সেজেগুজে হাজির। ঝলমলে আদিবাসী পোশাক। স্বচ্ছ পবিত্র, যেন দেবকন্যা! আগুন জ্বালানো হল। শুরু হল নাচ। ভাষা না জানা থাকায় গানের অন্তর্নিহিত অর্থ না বুঝলেও সুরে এক আশ্চর্য মাদকতা আছে! চলে এল বারবিকিউ চিকেন, পনির ইত্যাদি। আমরা চেয়ার নিয়ে গোল করে ঘিরে বসে আছি। আমি আর পারলাম না, যোগ দিলাম ওদের সঙ্গে! দেখি আরও কয়েক জন পা মেলাচ্ছে আমাদের সঙ্গে!
এর মধ্যে দেখি আস্তে আস্তে মেঘ-কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারি দিক, এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। এসে গেল ডিনারের ডাক! খাওয়ার পর হি-হি ঠান্ডায় আশ্রয় নিলাম গোটা দুয়েক লেপের মধ্যে!
ভোরে ঘুম ভাঙল, বাবার চালানো রবীন্দ্রসংগীতের আওয়াজে। ঘুম ভেঙে যাওয়ার বিরক্তি নিয়ে বাইরে বের হতেই সব রাগ যে কোথায় চলে গেল। দেখি প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্য, অপেক্ষা করে আছে আমাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য যেন শুধু আমারই জন্য! দেখি সকলেই উঠে পড়ে আস্বাদন করছে, ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটার ভোরের রূপ। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সামনের রাস্তা দিয়ে। রং বেরঙের ফুলের আসর, কত নাম না জানা পাখির কুজন আর তারই প্রেক্ষাপটে নতুন সূর্যের নরম আলো, আমাকে এক অন্য আবেশে ভরিয়ে দিল। ভারতবর্ষের এই পরিচয়, ক’জন বিদেশি জানেন! “ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো”!

ইতিমধ্যেই হাতে গরম চায়ের কাপ এসে গিয়েছে। সামনেই একটা স্কুল। ছেলেমেয়েরা আস্তে শুরু করেছে। চা শেষ করেই আমি ওদের সঙ্গে পা মেলালাম, আমিও ঢুকে পড়লাম ভিতরে। ওদের প্রেয়ার, ক্লাসরুমে পড়াশোনা, এ সব দেখতে দেখতে ফিরে গেলাম নিজের ছোটোবেলার দিনগুলোতে।
আজ আমাদের যাওয়ার কথা ভার্সে। গরম আলুপরোটা আর আরেক প্রস্থ চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেই উঠে পড়লুম গাড়িতে। ড্রাইভারকাকু বলল, ওখরে থেকে ১০ কিলোমিটার গেলে হিলে। ওখান থেকে ফরেস্ট পারমিট করিয়ে তবে যেতে হবে ৪ কিলোমিটার ট্রেক করে, ভার্সে। মায়ের কাছে জানতে পারলাম ভারতের একমাত্র রডোডেনড্রন অভয়ারণ্য সিকিমের এই ভার্সতেই। আরও জানলাম ভার্সে নামটা এসেছে লেপচা শব্দ ‘বার্সে’ থেকে। এর মানে ‘বর্ষা’।

হিলে যাওয়ার রাস্তাটা অনবদ্য, দু’ পাশে রোডোডেন্ড্রনের জঙ্গল – বিভিন্ন প্রজাতির নানা রঙের! যখন লাল তো, তখন যেন আবির ছড়ানো বা কখনো সাদা বা পিঙ্ক। হিলে পৌঁছে গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়লুম স্যাংচুয়ারির মধ্যে, এই বনপথই চলে গেছে ভার্সে। ওক, পাইন, ফার, জুনিপার, ধুপি, বহু রংয়ের বাঁশ, ফার্ন ও নানা অজানা প্রজাতির গাছের সমারোহ এই জঙ্গল। কয়েকশো বছরের ওক গাছ গুলোকে দেখে মনে হয় যেন ভূত দাঁড়িয়ে আছে। নানা ধরনের রোডোডেন্ড্রন তো আছেই, তার সঙ্গে আছে বহু বর্ণের গোলাপ অর্কিডের ধ্রুপদ যুগলবন্দি। এ ছাড়া এঞ্জেলিয়া, ধুতরা, আমন্ড লিলি, কসমস, প্রিমুলা প্রচুর পরিমাণে ফুটে আছে। আর আছে পথের ধারে অযত্নে ফুটে থাকা কত নাম না জানা সুন্দর ফুল বোধহয় আমার পথচলাকে মনোরম করে তুলতে। অসম্ভব সুন্দর এই দৃশ্য। গাছ ভর্তি ফুটে থাকা লাল ম্যাংগোলিয়া আর লাল, সাদা গোলাপি রডোডেনড্রন এর সমারোহ। এ যেন এক নন্দনকানন! এই ফুলের জলসায়, নিজেকে মনে হচ্ছিল এক অনাহুত অতিথি। গাইড বলল, স্থানীয় ভাষায় রডোডেনড্রনকে বলে ‘গুরাস’। এই অভয়ারণ্য আবার বিলুপ্ত প্রায় রেড পান্ডার বাসভূমি। কালো ভালুকের দেখা মেলে কখনও সখনও।

শুকনো পাতা মাড়িয়ে বা বুনো ফুলের ঝোপ সরিয়ে হেঁটে চললাম। মাঝে মাঝে কুয়াশা এসে পথ ঢেকে দিচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন মেঘের ওপর দিয়ে হাঁটছি। যত ভিতরে ঢুকছি গাছপালাগুলো যেন আরও আমায় জড়িয়ে ধরছে আর ফিসফিস করে বলছে, আরও গভীরে, আরও গভীরে যাও! পথের আকর্ষণে আর ফুলের গন্ধে নিজেকে শীঘ্রই হারিয়ে ফেললুম। পথে ১ কিলোমিটার বাদে বাদে বসার বেঞ্চ। একাকী বেঞ্চটাকে দেখে মনে হল, যেন আমায় বলছে “একটু বসে যাও, দু’টো কথা বলে যাও! সত্যি একাকিত্বের কী দুঃখ!
অবশেষে গিয়ে পৌঁছোলাম ওপরে। এখানের একমাত্র থাকার জায়গা গুরাস কুঞ্জ। কী দারুন লোকেশন! সামনে খোলা হিমালয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলে এখান থেকে।
ফিরে এসে ঘোর কাটল। জীবনের প্রথম ট্রেক। মনে মনে এই ট্রেকটার নাম দিলাম “Hungry Eye Avenue”..যত হাঁটছিলাম চোখে দেখার খিদে তত বেড়ে যাচ্ছিল। লাল গুরাসের জঙ্গল আমাকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে পথের ক্লান্তির কথা বুঝতেই পারিনি।
ওখরে ফিরে আবার ইতস্তত ঘোরাফেরা। বাবা জানাল, সোমবাড়িয়ার কাছে ‘এন্ডেন’, যাওয়ার রাস্তাটা নাকি অসাধারণ। সবাই এক কথায় রাজি। চলো ওখানে – অসাধারণ শান্তির রাস্তা! আমরা সবাই গাড়ি ছেড়ে, একটু হাঁটলাম! নিঃশব্দতা একেই বলে – নিঃশব্দতার মধ্যে কেবল পাখির ডাক আর আমাদের কলকলানি। দু’ দণ্ড দাঁড়ালাম! বসেও পড়লাম পথের ধারে! মনের মধ্যে কে যেন গেয়ে উঠল আমার প্রিয় এক গানের কলি “আমি তুমি আজ একাকার হয়ে মিশেছি আলোর বৃত্তে”!
মুগ্ধ নয়নে বসে থাকতে ইচ্ছা করছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা! আবার কেন, মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে অমিত-লাবণ্যর কথা!
অনিন্দ্যকাকু টিপ্পনি কাটল, “কী! রে! Honeymoon Spot টা fixed করে ফেললি নাকি”!
‘যত অলিগলি আকুলি বিকুলি এই পথ চলা কতদুর..
আগুনের আঁচে, আনাচে কানাচে তুমি আর আমি রোদ্দুর,
তুমি আমি তিন সত্যি হয়ে, বাকি সব আজ মিথ্যে!
মম চিত্তে হৃতি নৃত্যে..
মেঘের পালক চাঁদের নোলক কাগজের খেয়া ভাসছে!

প্রয়োজনীয় তথ্য
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ওখরে ১২৯ কিমি। আমরা ছিলাম ‘দাওলাকি হোমস্টে’তে (ফোন -০৯৭৩৩২০২৯১৫)। এ ছাড়াও আরও হোমস্টে আছে ওখরে’তে। ভার্সেতে থাকার জন্য আছে ‘গুরাস কুঞ্জ’, ওদের ওয়েবসাইট (http://guraskunj.weebly.com)। লগইন করুন পেয়ে যাবেন সব তথ্য।
ছবি: লেখক