তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ৩ / দারিংবাড়ি ছাড়িয়ে

শম্ভু সেন

দিনে মালুম হয়নি ততটা। রাতে ঠান্ডা পড়েছিল ভালোই। তাই লেপের মায়া কাটাতে বেশ সময় লাগল। ততক্ষণে সূর্য ঘরবসত জমিয়ে বসেছে। আজ আর তার উদয় দেখা হল না। এই ইকো হোম থেকে সূর্য একটু আড়ালে পড়ে। তাই গেট থেকে বেরিয়ে ঢাল বেয়ে কয়েক পা নেমে এসে পরিত্যক্ত পান্থশালার সামনে আসতে হয়। এই জায়গাটাই হল দারিংবাড়ির অঘোষিত সানরাইজ পয়েন্ট।

আরও পড়ুন: তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ১/ দারিংবাড়ির পথে

বলতে ভুলেই গেছি। এই দারিংবাড়িতে ছিল ওড়িশা পর্যটনের পান্থশালা। ২০০৩ সালের ২৪ জানুয়ারি এই পান্থশালার উদবোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক। শেষ পর্যন্ত দু’ বছর চলে তা বন্ধ হয়ে যায়। অজুহাত, মাওবাদী কার্যকলাপ। অথচ এই তথাকথিত ‘মাওবাদী কার্যকলাপের’ মাঝেই চালু হয়েছে বেসরকারি হোটেল। এখন গোটা চারেক হোটেল আছে এই দারিংবাড়িতে। ওড়িশা পর্যটন নিয়ে সরকারি প্রচারে দারিংবাড়িকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তার গায়ে মাওবাদী তকমা লাগিয়ে নিষ্ক্রিয় সরকার। এ নিয়ে এখানকার বাসিন্দারা বেশ ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভের রেশ কিছুটা ঝরে পড়েছিল অনিলবাবুর কথাতেও।

মন্দাসুরু ইকো ট্যুরিজম সেন্টার।

যা-ই হোক, প্রাতরাশের আয়োজনটা চন্দ্র বেশ ভালোই করেছিল। প্রাতরাশের ঢেকুর তুলতে তুলতেই বেজে গেল ৯টা। চললাম মন্দাসুরু। ওড়িশা বন দফতরের ইকো ট্যুরিজম সেন্টার।

চলেছি জাতীয় সড়ক ৫৯ ধরে, ফুলবনির রাস্তায়। বাঁ দিকে হিল ভিউ পার্ক ছাড়িয়ে আসার পর দারিংবাড়ির চৌহদ্দি শেষ। গাঁ-গঞ্জ উধাও। শুরু ঘাট-রাস্তা। ডান দিকের পাহাড়ে খাড়া দাঁড়িয়ে শালের জঙ্গল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সিমানবাড়ি।

এ বার জাতীয় সড়ক ছেড়ে আমরা ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা’য় তৈরি পথের শরিক। এই পথ যেন আদিবাসী মানুষের ঘর-গেরস্থালির উঠোন। এখানেই শুকোতে দেওয়া আছে পোশাকআশাক, এখানেই শুকোচ্ছে শস্য। পথের পাশেই বসেছে তাসের আসর, চলছে ক্যারাম খেলা। খেলাবিভোর শিশু ছুটে যায় কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে। তাই সাবধানী দিব্য। অতি সন্তর্পণে গাড়ি চালায়।

ডুডুবাটার পথে।

পেরিয়ে যাই গুমানিয়া। সাধারণের জমিজিরেত পেরিয়ে পথ সেঁধিয়ে যায় জঙ্গলে। পৌঁছে যাই মন্দাসুরু ইকো ট্যুরিজম সেন্টারের গেটে, ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে। দারিংবাড়ি থেকে পথ বেশি নয়, মেরেকেটে ৩৫ কিমি।

গাড়ি রেখে গেট দিয়ে ভিতর ঢুকতেই ডান দিকে টিকিটঘর। সৃজিত বনের মাঝ দিয়ে কংক্রিটের বাঁধানো পায়ে চলা পথ ক্রমশ উঠে গিয়ে দু’ ভাগ হয়েছে। দু’টি পথ শেষ হয়েছে দু’টি নজরমিনারে। নজরমিনার দু’টির অবস্থান দু’টি টিলায়। পাহাড়-প্রকৃতির আসল ছবি তো ধরা দেবে এই নজরমিনার থেকে।

বিস্মিত আমরা। কন্ধমাল জেলার পাহাড়-জঙ্গলের রূপ যে ফ্যালনা নয়, তা প্রমাণ হয় এই মন্দাসুরুতে। এক বিপুল গিরিখাত, অভেদ্য জঙ্গল, অন্তহীন নৈঃশব্দ্য। বোঝাই যায়, এখানকার প্রকৃতিকে লাঞ্ছিত করার সাহস করেনি মনুষ্যকুল।

ডুডুবাটা।

এখানকার নিসর্গ আমাদের বিবশ করে দিয়েছিল। কতক্ষণ জানি না। বনকর্মী পূর্ণর ডাকে যেন সংবিত ফিরল। সে ওড়িয়া আর হিন্দিতে বুঝিয়ে দিল, আরেকটা নজরমিনার তো আছে, সে-ও তো ডাকছে।

নীচের নজরমিনারে এলাম। আর মনে হল আমরা যেন আরও কাছে এলাম বনপ্রকৃতির। সেই গিরিখাতটা যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।

ফিরে চললাম মন্দাসুরু থেকে, পুরোনো চেনা পথে। চলে এলাম সিমানবাড়ি। তার পর সঙ্গী জাতীয় সড়ক। না, এখনই দারিংবাড়ির পথে নয়, বালিগুডার দিকে। কিলোমিটার তিনেক গিয়ে এমু প্রতিপালন কেন্দ্র। আপাতত আমরা চলেছি ‘নেচার্স প্যারাডাইস’। ফেরার পথে এক ঝলক দেখে নেব এমু পাখিদের।

এমু প্রতিপালন কেন্দ্র।

সিমানবাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার, কিরিকুটি ছাড়িয়ে এলাম। সড়ক ছেড়ে ডানহাতি মোরাম রাস্তা, পাহাড়ের কোল ঘেঁসে। আধ কিলোমিটার যাওয়ার পর মিষ্টি নামের পাহাড়ি নদী, ডুডুবাটা। বড়ো বড়ো বোল্ডারের উপর দিয়ে নেচেকুঁদে চলেছে। একটা বোল্ডারে বসে বেশ কিছুক্ষণ তার ক্রিয়াকলাপ অবলোকন করলাম। তার শীতল জলে পা ছোঁয়ালাম, হাত দিয়ে বিলি কাটলাম। বেলা একটা-দেড়টার রোদেও তার শীতলতা আরাম দেয়। ডুডুবাটার সঙ্গে ফোটো-সেশন চলল বেশ খানিকক্ষণ।

ফেরার পথে এমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব। তারের বেড়ার ও-পারে ওরা। যেন কত কাজে ব্যস্ত, আমাদের দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই, ইচ্ছাও নেই। আমরাই কৃপাপ্রার্থী, যদি কাছে আসে, মুখ তোলে, একটা ছবি তোলার সুযোগ পাই।

আরও পড়ুন: তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ২ / দারিংবাড়ির প্রেমে

বাব্বা, আড়াইটে? ঘড়ির দিকে তাকাতেই যেন ডনবৈঠক শুরু হয়ে গেল। দিব্য অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিল। চন্দ্র যে থালা সাজিয়ে বসে আছে। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *