তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ২ / দারিংবাড়ির প্রেমে

দুপুরের খাওয়াটা বেশ জম্পেশ হল। অনিলবাবু আপশোশ করছিলেন মাছ খাওয়াতে পারছেন না বলে। এই দারিংবাড়িতে মাছ জোগাড় করা ততটাই দুষ্কর যতটা দুষ্কর ডুমুরের ফুল জোগাড় করা। তাই শেষ চেষ্টা করেছিলেন দিব্যকে দিয়ে মাছ জোগাড় করার। কিন্তু দুপুর সাড়ে ১২টায় আসকার বাজারে মাছ পাওয়া যাবে, সেখানকার মৎস্যাসক্তির এমন খ্যাতি আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।

আমিষ তো হল না। কিন্তু চন্দ্র যা নিরামিষ আহার করাল তাতে তো আমরা ফিদা – সরু চালের গরম ঝরঝরে ভাত, পিঁয়াজ-সহ মশুর ডাল, আলুপোস্ত, ফুলকপির তরকারি, দু’ রকম ভাজা এবং শেষ পাতে চাটনি। পদের সংখ্যায় নয়, চন্দ্রের রান্নার হাতেই আমরা কাত।      

আরও পড়ুন: তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ১/ দারিংবাড়ির পথে

শীত এখনও গেড়েই বসে আছে এই দারিংবাড়িতে। ঘরের সামনেই মিষ্টি রোদের আঁচল বিছানো। তার ডাক উপেক্ষা করে কার সাধ্যি। ঘর থেকে বেতের আরামকেদারা টেনে এনে সেখানেই আধশোয়া।

ভুবনেশ্বর থেকে শ’ আড়াই কিলোমিটার পথ ভেঙে ডিয়ার্স ইকো হোমে আসতে আড়াইটে বেজে গেল। এই ইকো হোম দারিংবাড়ির বাজার এলাকার বাইরে। চৌমাথা থেকে যে রাস্তাটা ফুলবনির দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তায় কিলোমিটার খানেক এসে ডান দিকে পথ উঠে গেছে টিলার মাথায়। কিছুটা হালকা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ। পথের শেষে যে এমন একটা সুন্দর আবাস আছে বোঝা যায় না।

ডিয়ার ইকো হোম।

স্থান-মাহাত্ম্যে পাঁচ তারকা পেতে পারে এই ইকো হোম। অনেকটা উপর থেকে পুরো দৃশ্যমান দারিংবাড়ি। সামনের দিকে টিলার ঢাল বেয়ে জমি নেমে গেছে থাকে থাকে। এই জমিতে চাষ হয়, বোঝাই যায়। শীতের ফসল ঘরে উঠেছে, তাই জমি এখন ন্যাড়া। জমির আল ধরে সাবধানে বেশ কিছুটা নেমে গেলে পৌঁছে যাওয়া যায় ফুলবনিগামী জাতীয় সড়ক ৫৯-এ।

বেশ কিছুটা নীচে দূরের চৌমাথাটাও নজরে আসে। ডান দিকে ইকো হোমের প্রায় গা ঘেঁসেই শাল-পলাশ-শিমুল-মহুয়ার জঙ্গল। সেই জঙ্গল ধাপে ধাপে উঠে গেছে দূরের পাহাড়ে। বাঁ দিকে পাহাড়ের সারি কাছেই, রাস্তার ও পারেই, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।

শীতের পড়ন্ত বেলায় সঙ্গী রোদ। আরাম এড়ানো বড়ো মুশকিল। আরামকেদারায় আধশোয়া অবস্থায় চোখটা কখন লেগে এসেছিল। সঙ্গীদের হাঁকডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘড়িতে সাড়ে ৪টে। ভাত-ঘুমটা ভালোই হল। অনিলবাবু জানিয়েছিলেন, কাছেই আছে হিল ভিউ পার্ক। আজ বিকেলে জায়গাটা ঘুরে আসতে পারি। কাল থেকে দূরের ঘোরাঘুরি।

নীচের পিচ পথ ধরে খানিকটা গেলেই বাঁ দিকেই হিল ভিউ পার্ক।

প্রায় ৪৫ মিনিট লেগে গেল পার্কে পৌঁছতে। পথ বেশি নয়, মেরেকেটে এক কিলোমিটার। আসলে এই পার্ক হচ্ছে সেই পাহাড়ের মাথায়, যেটা ইকো হোম থেকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। ইকো হোমের টিলা থেকে তরতর করে নেমে এসে ডান দিকে ফুলবনির রাস্তায় খানিক গিয়ে বাঁ দিকে পাহাড় চড়া। পথ অবশ্য বাঁধানো। এই পথে গাড়িও উঠতে পারে। চড়াইটা বেশ ভালো। দম লাগে।

পাহাড়ের মাথায় সুন্দর করে সাজানো পার্ক। নানা রকম মরশুমি ফুলগাছের বাহার। দম ছাড়ার জন্য অঢেল বসার জায়গা। রয়েছে একটি নজরমিনারও। হিল ভিউ পার্ক থেকে আরও মজে গেলাম দারিংবাড়ির প্রেমে। এখানকার পাহাড়গুলো বড়ো আপন, বড়ো কাছের।

দিন তো এখনও খুব বড়ো হয়নি। তবু কলকাতা থেকে খানিকটা পশ্চিমে সরে এসেছি বলে দিনের আলো খানিকক্ষণ পেলাম। কিন্তু এখানে সূর্যটা আড়ালে চলে গেল বেশ তাড়াতাড়ি। পশ্চিমের পাহাড়টা যে বেশ উঁচু, তারই পিছনে লুকিয়ে গেল সূর্য।তাই এই হিল ভিউ পার্কে সন্ধে হব হব হলেও, দারিংবাড়ির অন্যত্র এখনও কিন্তু আলো রয়েছে। কোথাও কোথাও এক চিলতে রোদও। এক অদ্ভুত দৃশ্য।

হিল ভিউ পার্ক।

পার্ক থেকে নেমে একটা অটো ধরে চলে এলাম চৌমাথায়। জায়গাটা বেশ জমজমাট। সান্ধ্য বাজার বসেছে। এখানেই পঞ্চায়েত সমিতির অফিস, থানা, স্টেট ব্যাঙ্ক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বাজার – সব কিছু। আর সেই হোটেলটাও, হোটেল ইউটোপিয়া। দারিংবাড়িতে রাত কাটানোর দ্বিতীয় ঠেক। আদিবাসীরা তাঁদের সতেজ সবজির পসরা নিয়ে হাঁকডাকে ব্যস্ত। চা-এর সঙ্গে টুকটাক চালানোর নানা রসদও মজুত এই চৌমাথায়। চা পর্ব এখানেই সেরে ফিরে এলাম ইকো হোমে। দারিংবাড়িতে তখন সন্ধে নেমেছে। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *