মধুচন্দ্রিমায় গন্তব্য: নির্জনতা উপভোগ করতে চান? চলুন পাঁচমাড়ী

ধূপগড়।

ভ্রমণঅনলাইনডেস্ক: স্তব্ধতারও ভাষা আছে। তবে সেই ভাষা শুনতে হলে এই কোলাহলের শহর ছেড়ে যেতে হবে সেই জায়গায় যেখানে প্রকৃতিমাতা তাঁর ছায়ায় লালনপালন করছেন তাঁর উদ্ভিদ ও প্রাণীদের। সেখানে গেলে সারা দিনের ধকল ভুলে যাওয়া যায়। ভুলে যাওয়া যায় সব কষ্ট। এমনই এক জায়গা হল মধ্যপ্রদেশের পাঁচমাড়ী। সাতপুরা পাহাড়ে অবস্থিত ১০৬৭ মিটার উঁচু এই শৈলশহরে গেলে আপনার সঙ্গী হবে নিস্তব্ধতা। যাঁরা নির্জনতা ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অ্যাডভেঞ্চার, তাঁদের ভালো লাগার জায়গা। মধুচন্দ্রিমা যাপনেরও আদর্শ স্থান পাঁচমাড়ী।

ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে দেখতে গেলে, পৃথিবীর ইতিহাসের সঙ্গে এই অঞ্চলের একটা সম্পর্ক আছে। এখানে গোন্ড নামক আদিবাসীদের বাস। এই আদিবাসীদের নাম এসেছে ‘গন্ডোয়ানাল্যান্ড’ থেকে, যে ‘গন্ডোয়ানাল্যান্ড’-এর অস্তিত্ব নব্যপ্রস্তরযুগ থেকে। পাঁচমাড়ী  গেলে অনেক গুহা দেখা যায় যা দেখে বোঝা যায় সেগুলি অনেক প্রাচীন। সম্ভবত যখন পৃথিবী রূপান্তরিত হচ্ছে, তখনই সেই গুহাগুলির সৃষ্টি হয়েছে।

pandava caves
পাণ্ডব গুহা।

পাঁচমাড়ীকে সাতপুরা পাহাড়ের রানি বলা হয়। সবুজের শামিয়ানায় ঘেরা এবং অপরিসীম প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এই জায়গা রানিই বটে। শুধুমাত্র ভৌগোলিক বা বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত বলেই নয়, এই অঞ্চলে আছে ইতিহাসের ছোঁয়াও। পূর্বে এই অঞ্চলটি সাহসী রানি দুর্গাবতীর রাজত্ব ছিল।

এই অঞ্চলের আদিবাসীরাও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। রাজা ভাভূত সিং-এর নেতৃত্বে রুখে দাঁড়ায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া এখানে কোর্কু প্রজাতিদেরও বাস, যারা অস্ট্রো-এশীয় ভাষায় কথা বলে। মনে করা হয়, এই পাঁচমাড়ী কথাটি এসেছে পাঁচটি গুহা থেকে। লোককথা বলে, পাণ্ডবরা তাঁদের নির্বাসনকালে এই গুহাগুলি তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীকালে উনিশ শতকে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন জেমস ফরসিথ এই অঞ্চলকে শৈলশহরে রূপান্তরিত করেন। 

পাঁচমাড়ীর দ্রষ্টব্য

রিচগড়

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে, ভাঙছেন নির্জন পাহাড়ি চড়াই পথ। হঠাৎ আপনার সামনে এল একটি গুহা। একেবারে প্রাগৈতিহাসিক গুহা। এই হল রিচগড়, পাঁচমাড়ীর  অন্যতম আকর্ষক জায়গা। স্থানীয় মানুষরা বলেন, এক সময় এই গুহায় প্রচুর ভাল্লুকের বাস ছিল, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় রিচ। এই গুহা পেরোলেই সুন্দর উপত্যকা, দেখে মনে হয় এর কোনো শেষ নেই। তবে এই রাস্তায় গেলে গাইড নিতে হবে। রিচগড় যেন এক ছোটো অ্যাম্পিথিয়েটার, যার প্রবেশপথ আছে, বাহিরপথ আছে, আছে মধ্যবর্তী চত্বর।  

ধূপগড়

৪৪২৯ ফুট উঁচু ধূপগড় হল সাতপুরা পাহাড়ের সর্বোচ্চ অঞ্চল। নামের সার্থকতা বজায় রেখেই এই অঞ্চলে মেঘহীন দিনে খেলা করে সূর্যের আলো। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে, নানা রঙের ফুলের মাঝে সেই সূর্য রশ্মির রঙের খেলা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দূর হয়ে যাবে সব ক্লান্তি। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত, দুইই অপরূপ এই ধূপগড় থেকে। এখানে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের তৈরি করা একটি ঘেরা জায়গা আছে, যেখানে ইচ্ছা করলে সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।   

হান্ডি খোহ

handi khoh
হান্ডি খোহ।

ইংরেজি ‘ভি’ আকারের খাড়া পাহাড়, ৩০০ ফুটের বেশি গভীর খাদ, বয়ে চলেছে ঝোরা। একটা নুড়ি ফেললে পতনের আওয়াজ মেলে ৭ সেকেন্ড পরে। হান্ডি খোহ অঞ্চলটি প্রাকৃতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ তো বটেই, তবে এই অঞ্চলে যাওয়ার আরেকটি আকর্ষণীয় কারণ হলো এই অঞ্চলের একটি ইতিহাস। এখানে প্রাচীনকালে একটি জলাশয় ছিলো। তখন এখানে এক দুষ্ট সর্পিনী বাস করত, যাকে মহাদেব হত্যা করেছিলেন। তার পরেই এই জলাশয় শুকিয়ে যায় এবং জায়গাটি একটি হান্ডি তথা হাঁড়ির মতো হয়ে যায়। সেই থেকেই জায়গার এমন নাম। এমনকি এই হান্ডি খোহ-এর চারপাশে যে গাছপালা আছে, সেগুলি সাধারণত কোনো জলাশয়ের ধারেই জন্মায়।

বাবা মহাদেব, গুপ্ত মহাদেব এবং জটাশঙ্কর গুহা

এই তিনটি গুহা ভক্তদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দূর থেকে বহু ভক্তরা এখানে আসেন। বাবা মহাদেব গুহা এবং গুপ্ত মহাদেব গুহা একই জায়গায় হলেও জটাশঙ্কর গুহা একটু দূরে। এক আশ্চর্য গুহা গুপ্ত মহাদেব – একই পাহাড়ের মাঝে ফাটল – অন্ধকারাচ্ছন্ন। ৫০ ফুট অতি সংকীর্ণ পথ, মোমবাতির আলোয়  খুবই সন্তর্পণে পথ চলা। অপর দিকে বাবা মহাদেব গুহা খুবই সুন্দর। পুরাণ অনুযায়ী এখানে ভস্মাসুরকে ছল করে হত্যা করেছিলেন বিষ্ণু। জটাশঙ্কর গুহার পেছনেও অনেক পৌরাণিক কাহিনি আছে। শিব এখানে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। স্ট্যালাগমাইট পাথর এখানে জটার রূপ নিয়েছে। গুহার মাথায় জলের ধারা।  

অসংখ্য জলপ্রপাত

bee falls
বি ফলস।

দৃষ্টিনন্দন ডজনখানেক ফলস অর্থাৎ জলপ্রপাত আছে পাঁচমাড়ীর পাহাড়ে। ডাচেস ফলসের অপরূপ শোভা দেখতে পাহাড়ি পথে বেশ খানিকটা নামতে হয়। আরও আড়াই কিমি যেতে পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক জলাশয় – সুন্দর কুণ্ড। শহর থেকে ৫ কিমি দূরে সাতপুরা ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে বি ফলস বা যমুনা জলপ্রপাত। উপরের ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা যায়। আর জলপ্রপাতের পূর্ণ শোভা উপভোগ করতে নামতে হয় বেশ প্রায় ৪০০ মিটার। মিলিটারি ব্যারাক পেরিয়ে লিটল ফলস। বাসস্ট্যান্ড থেকে দেড় কিমি দূরে অপ্সরা বিহার – শীর্ণ অথচ করতোয়া স্রোতস্বিনী গিয়ে পড়েছে অতলস্পর্শী খাদে। অপ্সরা বিহার থেকে ১০ মিনিটের পথে রোমাঞ্চে ভরা রজত প্রপাত। রজতের শিরে ১৫০ মিটার উঁচু থেকে নামা বিগ ফলস।         

আরও পড়ুন চলুন যাই সেই শহরে যেখানে ভাস্কো-দা-গামা চিরনিদ্রায় ছিলেন ১৪ বছর

আরও কিছু দ্রষ্টব্য

পাঁচমাড়ীর আরো কয়েকটি দ্রষ্টব্য স্থান আছে। সরকারি উদ্যানের বিপরীতে পাণ্ডব গুহা – গুহাগুলি ক্ষয়িষ্ণু, তবে সংলগ্ন নার্সারিটি সুন্দর। অতীতের ফরসিথ পয়েন্ট আজকের প্রিয়দর্শিনী পয়েন্ট – এখান থেকে পাঁচমাড়ীর নৈসর্গিক শোভা দেখতেন ফরসিথ। মারাদেও গুহা – বেশ কয়েকটি গুহার কমপ্লেক্স। মেসোলিথিক যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০০ বছরেরও বেশী) গুহাচিত্রে তৎকালীন সমাজজীবন পরিস্ফুট। দেনওয়া ভিউ পয়েন্ট – সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা দেনওয়া নদী দেখতে অনেকেই আসেন এই স্থানে।  পাতালকোট – পাঁচমাড়ী থেকে ২ ঘণ্টা গাড়িতে গেলে এই ভিউ পয়েন্টে পৌঁছে যাবেন। চৌরাগড় পাহাড়শিরে শিবমন্দির। স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের নামে রাজেন্দ্রগিরি ভিউ পয়েন্টটিও খুব সুন্দর। অবশ্যই ঘুরে নেবেন সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক। 

কী ভাবে যাবেন

পাঁচমাড়ীর কাছের স্টেশন পিপারিয়া, দূরত্ব ৫৪ কিমি। দেশের প্রায় সব বড়ো জায়গার সঙ্গে ট্রেনপথে যুক্ত পিপারিয়া। কলকাতা থেকে পিপারিয়া যাওয়ার ট্রেন হাওড়া-মুম্বই মেল ভায়া ইলাহাবাদ। হাওড়া থেকে রাত ৯-৫৫ মিনিটে ছেড়ে পিপারিয়া পৌঁছোয় পরের দিন রাত রাত ৮-২৮ মিনিটে। পিপারিয়া থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলুন পাঁচমাড়ী। কিংবা রাতটা পিপারিয়ায় কাটিয়ে পরের দিন সকালে বাসে বা গাড়িতে চলুন পিপারিয়া।

কোথায় থাকবেন

mpt highlands
এমপিটি হাইল্যান্ডস।

পাঁচমাড়ীতে থাকার জন্য মধ্যপ্রদেশ পর্যটনেরই এক গুচ্ছ হোটেল আছে – এমপিটি চম্পক বাংলো, এমপিটি গ্লেন ভিউ, এমপিটি হাইল্যান্ডস, এমপিটি সাতপুরা রিট্রিট, এমপিটি অমলতাস, এমপিটি ক্লাব ভিউ, এমপিটি রক এন্ড মেনর, এমপিটি দেবদারু বাংলো, এমপিটি কর্নিকর বাংলো, হিলটপ বাংলো এবং পঞ্চবটী হোটেল। অনলাইন বুকিং: http://www.mptourism.com/। এ ছাড়া প্রচুর বেসরকারি হোটেল আছে। নেট সার্চ করলে পেয়ে যাবেন। এ ছাড়া https://www.airbnb.co.in/ সার্চ করে নিজের বাজেট মাফিক হোটেল, হোমস্টে বা অ্যাপার্টমেন্টের সন্ধান পাওয়া যায়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *