ভ্রমণঅনলাইনডেস্ক: ১৫৫৮ সালে আকবর চিতোর অধিকার করে নিলে, মেবারের রাজা রানা দ্বিতীয় উদয় সিংহ এই শহরে তার রাজত্ব নিয়ে আসেন এবং এই শহরটি হয় মেবারের রাজধানী। উদয়পুরের কথা ভাবলে বলিউডের কোনো প্রাসাদপম বাড়িতে নায়িকার বিয়ের দৃশ্যের কথা মনে পড়লেও উদয়পুর তার থেকেও অনেক বেশী। সংস্কৃতি, ইতিহাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, দোকান এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেক নিয়ে এই শহরটি কিন্তু সত্যিই মুগ্ধ করে।
শহরে কী দেখবেন
উদয়পুর ঘোরার জন্য প্রথমেই ভেবে নিন আপনি কী দিয়ে শুরু করবেন? প্রথমেই শুরু করুন ‘উদয়পুর সিটি প্যালেস’ দিয়ে। পিছোলা লেকের পাড়ে এই প্রাসাদটি খুবই ভালো ভাবে দেখভাল করা হয় এবং এই প্রাসাদে এখনও রাজ পরিবারের লোকজন বসবাস করেন। এই প্রাসাদ খুঁটিয়ে দেখতে কিন্তু অনেক সময় লাগবে।

এর পর চলুন পিছোলা লেকের কাছে গংগৌর ঘাটে ‘বাগোর কি হাভেলি’-তে। হাভেলির প্রতিটা ঘরে ঢোকা যায়। হাভেলি থেকে লেকটিও সুন্দর দৃশ্যমান। রোজ সন্ধ্যায় এখানে রাজস্থানের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান হল, পিছোলা লেকের মাঝে ‘জগ মন্দির প্যালেস’। উদয়পুর সিটি প্যালেস থেকে নৌকা করে জগ মন্দির প্যালেসে যেতে হয়।

উদয়পুর সিটি প্যালেসের ডান পাশে বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা ‘জগদীশ মন্দির-এ যেতে ভুলবেন না। এই মন্দিরে এখনও অতীতের আক্রমণের চিহ্ন রয়ে গিয়েছে।
ফতেহ সাগর লেকের পাশে ‘সহেলিয়োঁ কি বাড়ি’ও একটি আকর্ষণীয় জায়গা। এই জাযগাটি প্রধানত বাগান এবং এখানে রাজকুমারীর দাসীরা থাকতেন।
শহর থেকে ৫ কিমি দূরে মনসুন প্যালেস তথা ‘সজ্জনগড় প্রাসাদ’-এও অবশ্যই যাবেন। এই প্রাসাদে রাজারা বর্ষাকালে এসে থাকতেন। পাহাড়ের টঙে অবস্থিতর এই প্রাসাদ থেকে খুবই সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়।
উদয়পুরে আরও দেখে নিন

ক্রিস্টাল গ্যালারি, মহারানাদের ভিন্টেজ গাড়ির প্রদর্শনী, পিছোলা লেকের পিছনে সজ্জননিবাস বাগ, লেকের উত্তরে ফতেহ সাগর, ফতেহ সাগরে রমণীয় দ্বীপ-উদ্যান নেহরু পার্ক, বিপরীতে মোতি মাগরি পাহাড়ে প্রতাপ স্মারক, ৬ কিমি উত্তর-পশ্চিমে উদয়পুরের নবতম আকর্ষণ শিল্পীগ্রাম এবং শহর থেকে ৩ কিমি পুবে শিশোদিয়া রাজাদের অতীতের রাজধানী পাহাড়ে ঘেরা আহার। উদয়পুর রেলস্টেশন থেকে ৩ কিমি দূরে করনিমাতা রোপওয়ে। মচল্লা পাহাড়ের মাথায় শ্রী করনি মাতা মন্দির। উদয়পুরের দীনদয়াল পার্ক থেকে রোপওয়ে চড়ে চলুন মন্দিরে।
উদয়পুরের আশেপাশে

এক দিন বেরিয়ে পড়ুন শহর থেকে উত্তরে। চলুন রাজসমন্দ-কাঁকরোলি-নাথদ্বার-দেবীগড়-একলিঙ্গজি-নাগদা। প্রথমে চলুন ৬৩ কিমি দূরে রাজসমন্দ লেক এবং কাঁকরোলি। দেখুন মহারানা রাজ সিংহের তৈরি ৭.৭ বর্গ কিমি আয়তন বিশিষ্ট লেক, লেকের পাড়ে শিলালিপি, শ্বেতপাথরের ন’টি মণ্ডপ তথা নওচৌকি, বাগিচা, শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকাধীশ মন্দির ইত্যাদি। এ বার উদয়পুরের দিকে ১৮ কিমি এসে বৈষ্ণবতীর্থ নাথদ্বার, দেখুন শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। নাথদ্বার থেকে উদয়পুরের দিকে প্রায় ২১ কিমি এগিয়ে এলে দেবীগড়, ১৮ শতকের ফোর্ট প্যালেস। আরও ৭-৮ কিমি এসে একলিঙ্গজি, ৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি পিরামিড ধাঁচের মন্দির কমপ্লেক্স। উদয়পুরের দিকে একলিঙ্গজির একেবারে গায়েই নাগদা, রাওয়াল নাগাদিত্যের ১১ শতকের রাজধানী, প্রাচীন নগরী। ফিরে আসুন উদয়পুরে।

আরেক দিন চলুন রনকপুর-কুম্ভলগড়-হলদিঘাটি। সক্কালেই গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ুন। প্রথম গন্তব্য ৯৩ কিমি দূরের রনকপুর। ২৯টি জৈন মন্দিরের কমপ্লেক্স, দিলওয়ারাতুল্য। এখান থেকে চলুন ৩৩ কিমি দূরে আরাবল্লি পাহাড়ের ঢালে ৩৫৬৬ ফুট উঁচুতে কুম্ভলগড় দুর্গ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাচীরে ঘেরা দুর্গ, রানা কুম্ভের তৈরি। দুর্গের নানা মহলে ফ্রেস্কো চিত্র। বহু মন্দির। র্যামপার্ট থেকে মাড়োয়ারের সমতল ও আরাবল্লির জঙ্গল-পাহাড় সুন্দর দৃশ্যমান। চার কিমি দূরে কুম্ভলগড় স্যাংচুয়ারি। এ বার উদয়পুর ফেরার পথে চলুন হলদিঘাটি, আকবরের বাহিনীর সঙ্গে রানা প্রতাপের সেই যুদ্ধস্থল, যেখানে প্রাণ দিয়েছিল প্রতাপের প্রিয় ঘোড়া চেতক, কুম্ভলগড় থেকে ৫০ কিমি। হলদিঘাটি দর্শন শেষে ফিরে আসুন ৪০ কিমি দূরের উদয়পুর।

আরেক দিন চলুন উদয়পুর থেকে উত্তরে – প্রথমে চাওয়ান্দ, ৫৭ কিমি। এখানকার তীর্থমন্দির ইতিহাসখ্যাত। চিতোর থেকে উৎখাত হয়ে রাণা প্রতাপ আশ্রয় নেন চাওয়ান্দ প্রাসাদে। মেবার জয়ের জন্য এখানেই সেনাদের সংঘবদ্ধ করেন প্রতাপ। দেখে নিন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, প্রতাপের স্মৃতিসৌধ এখান থেকে চলুন জয়সমন্দ লেক, ২৩ কিমি। প্রিয়তমা রানির গ্রীষ্মাবাস ‘রুবি রানি কি মহল’ ও ‘হাওয়া মহল’ গড়তে ১৬৯১-এ রাণা জয় সিং গোমতী নদীতে ১০০ ফুট উঁচু বাঁধ দিতে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম লেক ধেবর লেকের সৃষ্টি করেছিলেন। আর রয়েছে ৬টি মন্দির এবং বাঁধের উপর পাথরের ছত্তিশ ও শিবমন্দির। উদয়পুর ফেরার পথে জয়সমন্দ থেকে ৩০ কিমি দূরে দেখে নিন জগৎ – অম্বিকা মাতা মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। এই মন্দিরকে রাজস্থানের খাজুরাহো বলা হয়।জগৎ থেকে উদয়পুর ৩০ কিমি।

এক দিন চলুন চিতৌরগড়, উদয়পুর থেকে ১২৪ কিমি। গড় তো চিত্তোরগড় গঢ়ৈয়াঁ/রানি তো রানি পদ্মিনী ঔর সব গধৈয়াঁ – তর্কে গিয়ে লাভ নেই। চিতোরের বাতাসে এই কথাটি প্রথমেই কানে ভাসে পর্যটকদের। শিশোদিয়া রাজপুতদের প্রাচীন রাজধানী চিতৌরগড়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রানি পদ্মিনী ও তাঁর জহরব্রত, মীরাবাঈ, রাণা কুম্ভের ইতিহাস।
খাওয়াদাওয়া
যদি ক্যাফেতে খেতে চান তা হলে গংগৌর ঘাটের আশেপাশের গলিতে অনেক ক্যাফে পাবেন। এবং স্থানীয় খাবার অবশ্যই খেয়ে দেখবেন।
কেনাকাটা
যদি উদয়পুরের কিছু স্মারক কিনতে চান তা হলে চলে যান সিটি প্যালেসের কাছে। ওই অঞ্চলে প্রচুর দোকান আছে, যেখানে আপনি মনের আনন্দে দরাদরি করতে পারবেন। আপনি কী খুঁজছেন সেটি আগে ঠিক করে নিন এবং দরদাম করে সেই জিনিসটি কিনতে পারবেন।

অভিজ্ঞতা
বিকেলের পড়ন্ত আলোয় পিছোলা লেকের উলটো দিকে আম্ব্রাই ঘাটে দেখতে পাবেন সেখানে অনেক লোকই জড়ো হয়েছেন এবং উপভোগ করছেন হালকা হাওয়া এবং আলো জ্বলে ওঠা সিটি প্যালেস। কেউ সেখানে গান করেন, কেউ ছবি তোলেন। আবার কেউ লেকের ধার দিয়ে হেঁটে বেড়ান। ফতেহ সাগর লেকেও আপনি যেতে পারেন। নির্জনতা পছন্দ করলে এই লেকটিই আপনার জন্যে আদর্শ।
কী ভাবে ঘুরবেন
আপনি যদি শহরটি খুঁটিয়ে দেখতে চান, তা হলে হেঁটে বা লোকাল বাসে ঘুরতে পারেন। স্থানীয় অটো ভাড়া করেও ঘুরতে পারেন। তবে উদয়পুরের বাইরে যেতে হলে গাড়ি ভাড়া করে নেওয়াই ভালো।
কী ভাবে যাবেন
ভারতের বিভিন্ন জায়গার সঙ্গে রেল ও বিমানপথে যুক্ত উদয়পুর। ভারতের যে কোনো জায়গা থেকে দিল্লি এসে সেখান থেকে উদয়পুর আসা বেশি সুবিধাজনক। দিল্লি থেকে দুটি দৈনিক ট্রেন আছে। এ ছাড়াও সাপ্তাহিক, ত্রিসাপ্তাহিক ট্রেন আছে। ট্রেনের বিশদ সময় জানার জন্য দেখে নিন https://erail.in ।

কোথায় থাকবেন
উদয়পুরে থাকার জন্য রয়েছে রাজস্থান পর্যটনের হোটেল কাজরী ও হোটেল আনন্দভবন। অনলাইন বুকিং http://rtdc.tourism.rajasthan.gov.in । এ ছাড়াও উদয়পুর শহরে বিলাসবহুল হোটেল থেকে শুরু করে নানা মানের হোটেল আছে, নেট সার্চ করলে যার সন্ধান পেয়ে যাবেন।
কখন যাবেন
আপনি যদি বৃষ্টি পছন্দ করেন, তবে এই শহরে বর্ষাকালে গেলেই সবচেয়ে ভালো। এই সময় এই “সিটি অফ লেক” বা উদয়পুর শহরটি চারিদিকে সবুজ হয়ে ওঠে এবং লেকেও থাকে পর্যাপ্ত জল। তবে আপনি যদি প্রখর শীতে উত্তর ভারতে না যেতে চান, তবে শীতকালেও যেতে পারেন উদয়পুর।