চলুন ভূতাবুড়ি ও ঘাঘরবুড়ি দর্শনে

writwik das
ঋত্বিক দাস

প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের জয়জয়কার আজ সর্বত্র৷ তবুও আজও কোথাও যেন ধর্মীয় বিশ্বাসই মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম সহায়ক৷ এমনই এক প্রত্যন্ত গ্রাম আজও বেঁচে আছে এই লৌকিক বিশ্বাসকে আশ্রয় করে৷ আর যাকে ঘিরে এই বেঁচে থাকা তিনি হলেন লৌকিক দেবী ভূতাবুড়ি৷

আসানসোল শিল্পশহরের বার্নপুর থেকে বাসে হীরাপুর ধর্মতলা নেমে কিছু দক্ষিণে গেলে পড়বে শ্যামডিহ গ্রাম৷ প্রত্যন্ত এক গ্রাম৷ বলতে গেলে আধুনিক সুযোগসুবিধা থেকে প্রায় বঞ্চিত৷ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা সবই এই গ্রামের মা ভূতাবুড়িকে ঘিরেই আবর্তিত হয়৷ এই ভূতাবুড়ি চণ্ডীর রূপ হিসেবে পূজিত হলেও মুলত তিনি লোকদেবী৷ দামোদর নদীর তীরে পশ্চিম বর্ধমানের সীমান্তে দেবীর থান৷ অনাবিল সুন্দর প্রকৃতি, নিস্তব্ধ এলাকা, পাশেই দামোদর নদ, ও পারেই বাঁকুড়ার গ্রাম, আরও দক্ষিণে হাতছানি দিচ্ছে বাঁকুড়ার বিহারীনাথ পাহাড়৷ চারিপাশে শুধু প্রকৃতি আর প্রকৃতি৷

আরও পড়ুন সুন্দরবন ছাড়াও ঘরের কাছে রয়েছে আরও এক ম্যানগ্রোভ অরণ্য, এই সপ্তাহান্তে চলুন…

এমন নির্জন স্থানে দামোদরের তীরে লাল পাথরের এক বেদিতে ভূতাবুড়ি মাতার থান৷ কোনো মূর্তি নেই দেবীর৷ বেশ ক’টি পাথরের ঘোটকই দেবীর প্রতিভু৷ পাশেই বাঘরায়ের থান৷ ইনি মূলত ভূতাবুড়ির ভৈরব বলেই পরিচিত৷ মন্দিরের পাশে এক কূপে দামোদর থেকে জল এসে ভরে থাকে। এই জল পানও করা যায়৷

ভূতাবুড়ি মন্দিরের পাশে দামোদর। ও পারে আবছা বিহারীনাথ পাহাড়।

‘ভুত’ শব্দের অর্থ প্রেতাত্মা আর তারই স্ত্রীলিঙ্ঙ্গ ‘ভূতা’৷ অর্থাৎ ভূতাবুড়ি প্রকৃতপক্ষে জনসমাজে অপদেবী হিসেবেই পরিচিত৷ অতীতে এই আসানসোল অঞ্চলে যখন শিল্প গড়ে ওঠেনি, আজকের আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি, তখন এই অঞ্চলের মানুষের কৃষিকাজই ছিল মূল ভরসা৷ চিকিৎসা ও শিক্ষার উন্নতির ছোঁয়াও তখন এখানে পড়েনি৷ উপরন্তু দামোদরের অভিশাপে ফি বছর ভেসে যেত গ্রাম। তখনও দামোদরের বুকে বাঁধ তৈরি হয়নি৷ এমন অবস্থায় দুঃখকষ্ট, রোগশোকের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য জন্ম হয় দেবী ভূতাবুড়ির৷

ভূতাবুড়ি মন্দিরের প্রবেশফটক।

এই দেবী ভূতাবুড়িকে নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত৷ এই দেবীরা সাত ভাইবোন – ছয় বোন ও এক ভাই৷ সব চেয়ে বড় বোন হল আসানসোলের কালীপাহাড়ির কাছে দেবী ঘাঘরবুড়ি। এই দেবীর কথা নিয়ে পরেই আলোচনা করছি৷ আর বাকি পাঁচ বোন হলেন দেবী নুনীবুড়ি, ঘোষবুড়ি, ধেনুয়াবুড়ি, কেন্দুয়াবুড়ি ও পিয়ালশালবুড়ি আর শান্তিনাথ হলেন এই সাত বোনের একমাত্র ভাই৷ দেবীর পূজার কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্র নেই। শুধুই ভক্তি আর ভূতাবুড়ি ও বাকি ছয় ভাইবোনের নাম উচ্চারণ করেই পূজারি দেবীর পূজা সুসম্পন্ন করেন৷

মা ভূতাবুড়ি।

বর্তমানে গোবিন্দ রায় মন্দিরে পূজার দায়িত্বে আছেন৷ কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গেই। তিনিই আমাদের জানালেন আরও কথা৷ পয়লা মাঘ জাঁকজমক করে দেবীর পূজার্চনা হয়৷ তখন দামোদরের তীর লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে৷ পূজা উপলক্ষ করে গ্রামে মেলাও বসে৷ এ ছাড়াও প্রত্যেক শনিবার দেবীর জোরদার পুজো হয়৷ পুজো চলাকালীন অনেক সময়েই পূজারির ওপর ‘মায়ের ভর হয়’। তখন মানুষের বিভিন্ন সমস্যার উপায় তিনি বাতলে দেন। এর পর পুজায় নিবেদন করা কাঁচা দুধ খেয়ে পূজারির ভর কাটে৷ পূজার ভোগ উপকরণের মধ্যে ফল ও নানা মিষ্টি থাকলেও ভূতাবুড়ির পছন্দের খাবার হল মুড়ি ও বিভিন্ন কলাই, ছোলা, বাদাম ইত্যাদি মুচমুচে করে ভাজা৷ পূজার সময় বিভিন্ন বাড়ি থেকে দেবীকে গামলায় এই কলাইভাজা ও মুড়ি ভোগ দেওয়া হয়৷ গোবিন্দবাবু আরও জানান, আগে ফি বছর দেবীকে উৎসবের সময় খিচুড়িভোগ দিয়ে সেই ভোগ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হত। কিন্তু পরবর্তীকালে মাতালের উৎপাত হেতু সেই রীতি বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ লোককথা ও প্রকৃতি সব মিলিয়ে ভূতাবুড়ির থান চির আকর্ষণীয়৷

ঘাঘরবুড়ির বিগ্রহ।

ভূতাবুড়ির মতোই তাঁর বড়ো বোন দেবী ঘাঘরবুড়িও আসানসোল অঞ্চলের আরেক জনপ্রিয় দেবী৷ অতীতে কালিপা্হাড়ি অঞ্চলের নুনিয়া নদীর ধারে তিনটে শিলাকে দেবী চণ্ডীর প্রতিভূ মনে করে মানুষের পূজার্চনা চলতে থাকে৷ এই কাণ্ড দেখে গ্রামের জায়গিরদাররা সেই স্থানে একটি মন্দির বানানোর সিদ্ধান্ত নেন৷ গড়ে ওঠে মন্দির৷ অনেকে মনে করেন, দেবীকে ঘাঘরা পরানোর জন্য নাম হয় দেবী ঘাঘরবুড়ি৷ পয়লা মাঘ ও শ্যামাপুজার রাতে বড়ো করে উৎসব হয়৷ এ ছাড়াও প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মন্দিরে ভক্তদের ভিড় হয়৷ মন্দিরচত্বর জমজমাট৷ পূজার উপকরণের দোকান, জলখাবারের দোকান, দুপুরের ভাত খাওয়ার হোটেল – সব মিলিয়ে মন্দিরচত্বরে সব সময়েই যেন চলছে ছোটো মেলা৷ এই মন্দিরচত্বরে সুকুমারের দোকানের খাঁটি দুধের গরমাগরম চা মুখে লেগে থাকবে৷ মাটির বড়ো মালসায় খাঁটি দুধ জাল দিয়ে অনবরত তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু চা৷

নুনিয়া নদী।

পাশেই নুনিয়া নদী৷ ছোটোনাগপুর মালভূমির পাথুরে নদীর পাড়ে বসে থাকতে ভালো লাগে৷ তবে নদীর জলে না নামাই ভালো৷ বেশ জমজমাট মন্দিরচত্বর৷ কল্যাণেশ্বরী, মাইথন ভ্রমণের সঙ্গে দেবী ঘাঘরবুড়ির মন্দির দর্শনও সেরে নিলে মন্দ হয় না৷

কী ভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে ট্রেনে আসানসোল। বা ট্রেনে আসানসোল হয়ে বার্নপুর। আসানসোল বা বার্নপুর থেকে বাসে হীরাপুরের ধর্মতলা। সেখান থেকে দক্ষিণমুখী পথ ধরে হাঁটলে পড়বে শ্যামডিহ গ্রাম। এই গ্রামের ভেতরেই দামোদরের ধারে মা ভূতাবুড়ির থান৷ তবে ভালো হয় আসানসোল বা বার্নপুর থেকে টোটো বা অটো ভাড়া করে যাওয়া। শ্যামডিহ গ্রামের পথে হেঁটে চলা মুশকিল৷

আর ঘাঘরবুড়ি যাওয়ার জন্য ট্রেনে আসানসোল বা কালীপাহাড়ি চলুন। সেখান থেকে বাসে ঘাঘরবুড়ি স্টপে নেমে সামান্য হাঁটা৷ এ ক্ষেত্রেও আসানসোল স্টেশন থেকে টোটো বা অটো বুক করে সরাসরি মন্দিরচত্বরে চলে আসা যায়৷

ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in

আর কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আসানসোল হয়ে চলে যেতে পারেন ভূতাবুড়ি। দিল্লিগামী জাতীয় সড়কের ধারেই ঘাঘরবুড়ি।

কোথায় থাকবেন 

ভূতাবুড়ির আশেপাশে থাকার জায়গা বলতে মাইথন বা আসানসোলে কোনো। হোটেলের খোঁজ পাবেন makemytrip, goibibo, trivago, cleartrip, holidayiq  ইত্যাদি ওয়েবসাইট থেকে। আর ঘাঘরবুড়ি মন্দিরের সামনে একটি গেস্ট হাউস আছে৷ আগাম বুকিং-এর দরকার হয় না।

মনে রাখবেন

কল্যাণেশ্বরী-মাইথন ভ্রমণের সঙ্গে ঘুরে নিতে পারেন ভূতাবুড়ি ও ঘাঘরবুড়ি।

ছবি: লেখক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top