‘পায়ের তলায় সরষে’ – আমি বাধ্য হয়েই ভ্রমণকারী, ভ্রমণ আমার জীবনযাপনেরই অঙ্গ। কিছু দিন এক জায়গায় থিতু হয়ে থাকলেই মন উচাটন হয়, মাথার মধ্যে একটা ক্যারা নড়াচড়া করে।
প্রতি দিন একই মানুষের সঙ্গ, খুব ঘনিষ্ট হলেও, আর উত্তাপ দেয় না! একই রকম মুখ দেখতে দেখতে চোখ খরখরে হয়ে যায়, তখন ইচ্ছে করে কিছু দিনের জন্য অন্য নদীতে ডুব দিয়ে আসি, অন্য হাওয়ায় আচমন করি। মনে হয়, অরণ্যের দিনরাত্রির চরিত্রগুলো বোধহয় আমিই! আচ্ছা ভাবুন তো, নিরিবিলি জঙ্গলে বসে থাকা বা গড়ানো কিংবা পাহাড়, সমুদ্র, নদীতে মিশে যাওয়া – এর আকর্ষণ আপনি অস্বীকার করতে পারেন।
আরও পড়ুন কুমারী সৈকত চাঁদপুরে একটা দিন
পরিচিত পরিবেশ ছাড়িয়ে, দূরে কোথাও নির্জন জায়গায় থাকলে, নিজের সঙ্গে দেখা হয়। মাঝে মাঝে নিজের সাহচর্য্ও তো দরকার! জঙ্গলে, পাহাড়ে, উপরে পরিষ্কার তারাভরা আকাশ, মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে বাতাসে পাতার শব্দ… আর কোনো মানুষ নেই… নিজের সঙ্গে কথা বলেছেন কখনো! দেখবেন, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করবেন! অনুভব করবেন, রূপসী বসুন্ধরা, মানুষের বসবাসের পক্ষে চমৎকার এক জায়গা! এ রকম নিস্তব্ধতার মধ্যেই তো টের পাওয়া যায় – মানুষের কণ্ঠস্বরঃ… একটা দু’টো পাখির ডাক, কিংবা বাতাসে, গাছের পাতার শব্দ, কত মধুর।
প্রতি দিন আমরা অনেক স্বপ্ন দেখি, অধিকাংশ স্বপ্নই আর মনে থাকে না। ধূপের গন্ধের মতো মিলিয়ে যায়, কোনো কোনোটি সকালে জেগে ওঠার পরেও কিছুক্ষণ মনে থাকে, আর কিছু স্বপ্ন বেশ স্থায়ী দাগ রেখে যায় স্মৃতিতে। তাজপুর যেন অনেকটা, সে রকমই। তাজপুর আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আপনার স্বপ্নে – সমুদ্রের ঢেউয়ের দোলা আর ফেনার আস্তরণ সঙ্গে সবুজ ঝাউগাছের গা- ঘেঁষাঘেঁষি বাস, যেন পথিকের ‘দিগন্ত-পথ’, কোথায় শেষ হবে, কেউ জানে না। জানতে চায়-ও না। ভ্রমর যেমন ফুলের সৌন্দর্যের তোয়াক্কা করে না, শুধু মধুর সন্ধানে ফুলের গভীরে ঢুকে যায়, তেমনই আমি এই প্রকৃতির সৌন্দর্যের তোয়াক্কা না করে, প্রকৃতির সৌন্দর্যের অনুভূতির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। প্রকৃতি এখানে উদার আর উন্মত্ত। নরম সকাল, পড়ন্ত বিকেল, সাঁঝবেলা কি রাতের বেলায়… সব কিছুই তো আপনার!
এখানে আছে শুধু অন্তহীন ঢেউ ভাঙার শব্দ আর ঢেউ গোনার অবসর, নীলচে সুমুদ্রে কখনো আলো কখনো ছায়া, সফেদ ঢেউয়ের আছড়ে পড়া, সবুজ ঝাউগাছে, আলতো ছোঁয়ায় সেই ঢেউ পা-দুখানি ভিজিয়ে দিয়ে যাবে, বিন্দু বিন্দু জলকণা, স্নেহধারার মতো ঝরে পড়বে আপনার চোখে-মুখে।
ঘুম থেকে উঠে এসে দাঁড়ালাম সমুদ্রের ধারে। শনশন হাওয়ায় ঝাউগাছগুলো পাগলের মতো দুলছে, চোখের সামনে সূর্য পৃথিবীকে চুমু খাচ্ছে, চমৎকার একটি আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে, সেই আলোয় মাখামাখি হয়ে, আকাশ খিলখিল করে হেসে উঠছে। হঠাৎ করে আমার মাথায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের চরিত্রহীন উপনাস্যের ‘কিরণময়ী ও দিবাকরের’ কথা মনে পড়ে গেল… কিরণময়ী দিবাকরকে চুম্বন করেছিলেন, তার পর খিলখিল করে হেসে উঠেছিলেন। মনে হল আমার চরিত্রহীন আর হয়ে ওঠা হল না। হালকা লালচে সোনালি রং-মাখা আকাশ, যেন পৃথিবীর সেরা সুন্দরী! খিলখিল করে হেসে উঠছে।
নতুন এক ফুসফুস পেলাম, তাজপুরে এসে, মনটা ভরে গেল। বয়সটা বেড়ে গিয়েছে, তা না হলে সারা দিন, নতুন প্রেম করলে যেমন হয়… শুধু কথা বলতাম আর ফটো তুলতাম।
শহর থেকে অল্প দূরে কোলাহলমুক্ত এক নির্জন জায়গা, ‘শব্দের অঙ্গীকার’ না-রাখা এক সমুদ্রতট – এই তাজপুর।
কচি আলো গায়ে মেখে জেগে ওঠা – পৃথিবীটাকে কী মায়াময় মনে হচ্ছে। ঘুম ভাঙা পাখিরা একটু হকচকিয়ে উঠেই, পৃথিবীটাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে চিৎকার শুরু করেছে, কোমল ও বিনীত ভাবে সূর্য উঠছে!
তাজপুরের ঝাউবনে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল এ যেন অভাগীর বুকে সবুজ ভালোবাসার গল্প, এক প্রান্তিক মানুষের আপনজন হয়ে ওঠার কথা, একই আকাশের নীচে, প্রান্তিক মানুষেরা অনেক বড়ো মনের মালিক বলে মনে হয়। প্রান্ত্যজনের বাঁচার হাতিয়ার…ঝাউগাছের ভিতর হাঁটা, আর সমুদ্রের ওপর আদিগন্ত নীল শামিয়ানা। এ যেন ‘অসময়ের পায়ে পায়ে হাঁটা’, শহুরে খোলস ছেড়ে দিয়ে মানবিক মন নিয়ে মিশে যান মানুষের সঙ্গে, দয়িত্বশীল ভবঘুরে ভাব নিয়ে – অনুভবটা অনেকটা এ রকম… ‘একেলা এসেছি এই ভবে, একেলাই চলে যেতে হবে…’।
সমুদ্রের ধারে এলে চোখে পড়ে আকাশলীনা – কবি জীবনানন্দ দাস বলেছিলেন, ‘সমুদ্র আর আকাশ যেখানে মিশেছে, সেই হল ‘আকাশলীনা’, ইংরেজিতে যাকে বলে স্কাইলাইন’।
কবি সুবোধ সরকারের একটি লেখা পড়েছিলাম,”এখন কলকাতায় আকাশ কিনে নিচ্ছে, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো, পঞ্চাশ-ষাট তলা হাইরাইস বানিয়ে, ভেঙে চুরচুর করে দিচ্ছে আকাশরেখা, আসলে মানুষ ইন্ডাস্ট্রি চায়, চাকরি চায়, দু’বেলা দু’মুঠো পেটে দিতে চায়, আকাশ দিয়ে কি পেট ভরে! তাতে যদি আকাশ হারিয়ে যায়, কোনো ক্ষতি নেই। আমরা যেমন বছরে এক বার দু’ বার পিকনিক করতে জঙ্গলে যাই, কিন্তু জঙ্গল সঙ্গে করে নিয়ে আসি না, তেমনি আমরা আকাশ দেখতে যাব” – তাই পরের প্রজন্মকে আকাশলীনা দেখাতে তাজপুরের সমুদ্রের ধারে ছুটে ছুটে আসতে হবে।
খাওয়ার কতগুলি অস্থায়ী আস্তানা সমুদ্রের ধারেই – চলুন না, দিনযাপনের একঘেয়েমি কাটাতে, এক কাপ কফি নিয়ে – না, মত বিনিময় নয়, হৃদয় বিনিময় করি, সেই হৃদয় যা আমরা খইয়ে ফেলতে ফেলতে এখনও দু’ হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছি। জীবন মানে তো হিরের খনি! মনে পড়ে গেল কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দু’টি লাইন, “অবান্তর স্মৃতির ভেতরে আছে, তোমার মুখ..অশ্রু ঝলোমলো..”।
‘২২শে শ্রাবণ’ – প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত একটি বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম। ওঁর মুখে একটি সংলাপ ছিল, “জীবনে ভাত ডাল আর বিরিয়ানির ডিফারেন্সটা বোঝা দরকার, প্রথমটা নেসেসিটি,আর পরেরটা লাক্সারি”। ছোটো ছোটো এই বেড়ানোর মুহূর্তগুলোই, সেই নেসেসিটি, তাজপুরের সমুদ্রতট আর লাল কাঁকড়াদের লুকোচুরি, কিংবা মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের অনলস জীবনসংগ্রাম, আপনাকে সেই কথাই মনে করিয়ে দেবে, এটা নেসেসিটি। যদি কেউ অন্যের জিনিস আঁকড়ে থাকে, তা হলে সে একা হয়ে যাবে, কিন্তু যেগুলো নিজের, নিজের ভালোবাসা, নিজের কামনা, নিজের সৃষ্টি আঁকড়ে রাখলে, কোনোদিন একা হতে হবে না।
আরও পড়ুন বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
আকাশ কালো, সাপের ফনার মতো মেঘগুলো সুমুদ্র থেকে উঠে আসছে। সুমিতা চেঁচিয়ে উঠল খানিকটা ভয়েই, সুনামি আসছে! সুনামি আসছে! আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম প্রকৃতির এই উন্মত্ত রূপ – সুমুদ্র ফুঁসছে, সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকানি, আর বাজের চমক। মুহূর্তের মধ্যে বদলে যাওয়া এই রূপ – এ কি মুহূর্তের উপলব্ধি না অনুভূতি? চিমটি কাটলাম। সম্বিত ফিরল ভাস্করের ডাকে – “অভিজিৎ দৌড়াও, বৃষ্টি নেমে গেছে যে”।
জানেন, ‘আপেক্ষিকতার তত্ত্ব’ খুব সহজ করে বোঝাতে আইনস্টাইন নাকি কাউকে বলেছিলেন, “মনে করো, কোনো লোকের একটি পা ফায়ার প্লেসের আগুনে ঠুসে দেওয়া হয়েছে, তা হলে সেই লোকটির কাছে পাঁচ মিনিটই মনে হবে এক ঘণ্টা। আবার কেউ যদি প্রেমিকার পাশে ঘনিষ্ট হয়ে বসে থাকে তা হলে তার এক ঘণ্টাকেই মনে হবে পাঁচ মিনিট” – প্রকৃতির এই রূপ দেখতে দেখতে আমার অনুভুতিটা অনেকটাই প্রেমিকার পাশে বসে থাকার মতো।
মনে হচ্ছিল, এত তাড়াতাড়ি, এত অল্প সময়ে, আমি স্নান করব কী করে, প্রকৃতির এই মুগ্ধতার সাথে।
আচ্ছা, কি মুশকিল! পাঁচ মিনিটে কি মহাভারত শেষ করা যায়?
শহরের কংক্রিটের তৈরি আস্তানাগুলো থেকে বেরিয়ে এসে রোজকার শহুরে মধ্যবিত্ত জীবন থেকে চুরি করে নেওয়া একটা ছোটো ছুটি, মনে থাকবে চিরকাল।
কোথায় থাকবেন
তাজপুরে থাকার জন্য বহু হোটেল আছে, ঘরে বসে সুমুদ্র দেখা কোনো হোটেল থেকেই সম্ভব নয়, হোটেল ও সুমুদ্রের মধ্যে আপনার বাধা ঝাউগাছের সারি। এদের সন্ধান পেয়ে যাবেন makemytrip, holidayiq, tripadvisor, yatra.com, travelguru প্রভৃতি ওয়েবসাইট থেকে। আমরা ছিলাম মল্লিকা রিসর্টে (৯০০৭৪০১৮৬৮, ০৯৪৩৩০৭৫৪৬৪)।
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে তাজপুর ১৭৩ কিমি, দিঘা যাওয়ার পথে বালিসাই, সেখান থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে ৫ কিমি গেলেই তাজপুর। চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগে। কলকাতা-দিঘা বাসের কন্ডাক্টরকে বলে রাখলে বালিসাইয়ে নামিয়ে দেবেন। সেখান থেকে মিলবে টোটো।
কাছাকাছি রেলস্টেশন রামনগর। হোটেলে আগে থেকে বলে রাখলে ওঁরা স্টেশন বা বালিসাই থেকে পিক আপের ব্যবস্থা রাখেন। অন্যথায় স্টেশন থেকে টোটো বা ট্রেকারে করেও চলে আসতে পারেন তাজপুর।
ছবি : লেখক