এ বার অচেনা, অদেখা ডুয়ার্স, কোভিড-পরবর্তী সময়ে

সঞ্জয় গোস্বামী

আসুন একটু ভেবে দেখি সবাই মিলে।

পাহাড়, কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও উত্তরের ডুয়ার্সে পর্যটনের ভিন্ন দিক রয়েছে। অজস্র লোকসংস্কৃতির পীঠস্থান, সাথে নীল পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা সংকোশ, রায়ডাক, মাল নদী, পাশাপাশি চা বাগান আর ঘন জঙ্গল। রূপকথার রাজকন্যা যদি পাহাড় হয় ডুয়ার্স তার রাজপুত্র।

কিন্তু আদৌ কি ডুয়ার্সকে আমরা চিনেছি?

চিনেছি, ফেসবুকের প্ল্যান ধরে তিন রাত চারদিনের প্যাকেজ বা চার রাত পাঁচ দিনের প্যাকেজ ইত্যাদি ইত্যাদি। ভোরবেলা মুখে পাঁউরুটি আর ডিম সেদ্ধ গুঁজে গরুমারায় লাইন দিয়ে বা লাঞ্চ করে চিলাপাতায় গন্ডারের সান্নিধ্য, কে ক’টা ওয়াল্ড লাইফ দেখলাম তার হিসেব। রাতে নতুন সংযোজন আদিবাসী ‘ ডান্স’। কিন্তু ডুয়ার্সের ভিতরটা? মানুষগুলির জীবনযাপন, তাদের গান, অনাঘ্রাত চা বাগান চিরে রাস্তা ধরে হেঁটে চলা দিগন্তরেখা ছোঁয়ার তাগিদে?  অথবা কোনো নদীর পারে বসে একটা সারাবেলা কাটানো, ছুটে যাবে ট্রেন, ওই দূরের লাইন ধরে? লোকসংগীতের সুর দোলা দিয়ে যাবে মনে প্রাণে? ভাবা যায় না কি?

অথবা কোনো অনাঘ্রাত গ্রামে সারাটা দিন শুধু পদচারণা, নাম-না-জানা কোনো নদীর পারে বসে চুপকথার জাল বোনা। অথবা রাতে হোক স্টোরিটেলিং সেশন, ডুয়ার্স নিয়ে প্রচুর বই আছে, তার থেকে বেছে নিয়ে হোক আলোচনা, শেষে থাক প্রশ্নোত্তর পর্ব। অথবা হোক লোকসংগীতের সেশন যেখানে স্থানীয় শিল্পীর সঙ্গে থাকবে গান গাওয়ার সুযোগ। অথবা হোক লেখার প্রতিযোগিতা – এক অনাঘ্রাত গ্রামে  সারা দিন কী ভাবে কাটালেন  সে-ই নিয়ে লেখা।  পুরস্কার হিসেবে তুলে দেওয়া হোক স্থানীয় কোনো স্মারক।

এ রকম অজস্র কনসেপ্ট নিয়ে আসা যায় অন্য ডুয়ার্সকে চেনানোর জন্য। নতুন পথ খুলে গেলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কও সেই পথে চলবে। আর থাকই না, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এর ‘চাপ’, মনের গহীন কোণে জমে থাকা চাপ চাপ রক্তাক্ত অভিমান-ক্ষোভ, সব ধুয়ে মুছে ফেলা যায় এক নিমেষেই। 

ভুলটা সবার, আমাদের সকলের। কেউ আসল ডুয়ার্সের কথা বলি না। ট্যুরিস্ট যা চায়, সেই পথেপ্রান্তরে ছুটে যাই, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক যা চায় সেই দিকে ছুটে যাই, বিশেষজ্ঞ যা চান সেই পথে ছুটে যাই, কিন্তু ভেবে দেখি না ‘আমি বা আমরা কী চাই’।

পোস্ট-কোভিড সময়ে, যখন মানুষ দিশেহারা কোথায় ঘুরতে যাব, ডুয়ার্স কিন্তু পারে নতুন দিশা দেখাতে। না, এ বার সময় হয়েছে ডুয়ার্স মানেই গরুমারা-চিলাপাতা-জলদাপাড়া, এই চিন্তা ছেড়ে অন্য কিছু ভাবার। অ্যাকোমোডেশন সেখানেই হোক। কিন্তু এ বার ভেবে দেখার সময় হয়েছে নতুন ভাবে ডুয়ার্সের রূপকথা শোনানোর। খুব দুঃখজনক যে ডুয়ার্স নিয়ে সেই প্রচেষ্টা ডুয়ার্সের ট্যুরিজম সেক্টরও দেখায়নি।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে কে আগে এগোবে এই নতুন পথে – ট্যুরিস্ট না ট্যুরিজম? এটা লাখ টাকার প্রশ্ন। উত্তর কিন্তু সহজ। গল্পের জাল বুনতে হবে, জানাতে হবে, ডুয়ার্সের রূপকথা শোনানোর জন্য সঠিক ব্যক্তি চয়ন করতে হবে। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক যদি গন্ডারের ছবি দিতে পারে, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এটাও জানাতে পারে – চলুন দেখি সংকোশ নদী, যে নদী ডুয়ার্সকে ইস্ট আর ওয়েস্টে ভাগ করেছে। ডুয়ার্সের ফুড ট্যুরিজম নিয়েও ভাবার সময় হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় দেখি শুধু বোরোলি নিয়ে কথা হয়। কিন্তু ডুয়ার্সের অন্য রান্নার স্বাদগুলি নিয়ে কথা হয় না, এটাও খুব দুঃখজনক।

ডুয়ার্স মানেই সমতল, তা নয়। ডুয়ার্সের পাহাড়ি এলাকাগুলিও পিছিয়ে ট্যুরিজম-ম্যাপে। প্যারেন-সুনতালেখোলা-ঝালংয়ের বাইরে এক্সপ্লোর করার কোনো প্রচেষ্টার কাহিনি তৈরি হয়নি। কাউকে আকর্ষণ করতে গেলে চাই আগে সেই জায়গা নিয়ে রূপকথার জাল বোনা, কিন্তু আমরা থেকে গিয়েছি ‘পার ডে পার হেড’ আর গাড়িতে কটা মাথা হবে, সেখানে। কন্সেপ্ট-এর বাজারজাতকরণের পিছনে চাই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। কিন্তু হায় এখানেও সুইসাইডাল প্রতিযোগিতা।  মনোমোহিনী ডুয়ার্সে তাই রক্তক্ষরণ হয় প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে।

অথচ এই ডুয়ার্স হতে পারে এই ভারতের বুকে সেরা পর্যটন কেন্দ্র। শুধু ভারত কেন, সুদুর বিদেশ থেকেও আনা যায় বিদেশি পর্যটক।  জল-জঙ্গলের মহাকাব্যে শামিল করা যায় স্থানীয় যুবকদের। হয়নি। এত দিন ডুয়ার্স চলেছে গরুমারা-জলদাপাড়া-চিলাপাতার ঘেরাটোপে। সময় হয়েছে ঘেরাটোপের বাঁধন ছেড়ে বেরিয়ে আসার। চাই সুনির্দিষ্ট প্ল্যান। দু’দিনে ডুয়ার্সে ভ্রমণের ফেসবুকিয়ানদের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়ার জন্য আগে চাই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। সেই প্রয়াসে সকলকে শামিল হতে হবে, না হলে আবার ফিরে যেতে হবে সেই ‘রমাকান্তকামার’ ফেজ-এ। 

One Reply to “এ বার অচেনা, অদেখা ডুয়ার্স, কোভিড-পরবর্তী সময়ে”

  1. লেখাটা পড়লাম, ভালো লাগলো। এরকমই কয়েকটা জায়গার সন্ধান দিলে আমরাও একটু ঘুরে দেখতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *