শুভদীপ রায় চৌধুরী
পুজো আছে, ধুম নেই। আচার-অনুষ্ঠান পালন আছে, ভক্তসমাগম নেই। রথযাত্রা আছে, শোভাযাত্রা নেই। করোনা-আবহে শান্তিপুরে এ ভাবেই পালিত হচ্ছে এ বছরের রথযাত্রা।
শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব – সেই প্রাচীন কাল থেকেই শান্তিপুরে এই তিন ধারার মেলবন্ধন। এই অঞ্চলের কালীপুজো যেমন বিখ্যাত, তেমনই বিখ্যাত রাসযাত্রা। আবার এখানে বহু প্রাচীন শিবমন্দিরও রয়েছে যেখানে শিবরাত্রির উৎসবও পালন করা হয় ধুমধাম করে। আর ধুম কিছু কম নেই শান্তিপুরের রথযাত্রা উৎসবে। এ বছর সে সব অনুপস্থিত।
শান্তিপুরে রথযাত্রা উৎসবের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এখানে রয়েছে বিভিন্ন গোস্বামীবাড়ি। মূলত এই গোস্বামীবাড়িগুলির দৌলতেই শান্তিপুরে সাড়ম্বরে পালিত হয় রথযাত্রা। কারও বয়স তিনশো বছর, আবার কারও বয়স দু’শো কিংবা দেড়শো বছর। এ বছরও প্রাচীন রীতি মেনেই পালিত হচ্ছে রথযাত্রা উৎসব। তবে করোনাভাইরাস জনিত পরিস্থিতিতে ভক্তসমাগম প্রায় দেখাই যায়নি রথের দিন। উলটোরথের দিনও এই ছবির কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের মাহেশ, গুপ্তিপাড়া, বড়িশার রথের মূল দেবতা জগন্নাথ হলেও শান্তিপুরের রথের কেন্দ্রে রয়েছেন শ্রীরঘুনাথ। শ্রীরঘুনাথের পাশাপাশি জগন্নাথদেবও রয়েছেন, তবে রথের মূলে থাকেন শ্রীরঘুনাথই। শান্তিপুরের বড়ো গোস্বামীবাড়ি, মধ্যম গোস্বামীবাড়ি বা হাটখোলা গোস্বামীবাড়ি, সাহাবাড়ি–সহ প্রাচীন সমস্ত রথ উৎসবেই প্রধান দেবতা হলেন এই রঘুনাথ বা রামচন্দ্র। তাঁরই দারুমূর্তি পূজা করা হয়। এখানে রঘুনাথ বা রামচন্দ্র পদ্মাসনে বসে থাকেন, তাঁর গায়ের রঙ সবুজ আর ধুতি ও চাদর রয়েছে তাঁর গায়ে।
শান্তিপুরে বড়ো গোস্বামীদের রথযাত্রা সব চেয়ে প্রাচীন, বয়স হল আনুমানিক তিনশো বছর। এই গোস্বামীদের হাতে রঘুনাথ বিগ্রহ তুলে দিয়েছিলেন গুপ্তিপাড়ার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা, যখন তাঁরা শান্তিপুরের বসতি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। সেই থেকে রঘুনাথ রয়েছেন বড়ো গোস্বামীদের বাড়িতে। রঘুনাথকে কেন্দ্র করে প্রথমে রথযাত্রা শুরু হলেও পরে জগন্নাথদেবকেও বসানো হয় রথে। সঙ্গে থাকেন বলভদ্র ও সুভদ্রাদেবী।
কিন্তু শান্তিপুরের রথ উৎসবের কেন্দ্রে রঘুনাথ কেন? এর সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে একটি যুক্তি হল ফুলিয়ার কৃত্তিবাসকে স্বীকৃতি দিতেই রামের গুরুত্ব বেড়েছে এই অঞ্চলে। শুধু বড়ো গোস্বামীবাড়িতেই নয়, শান্তিপুরের আরও যে যে বাড়িতে রথযাত্রা হয় তাদেরও রথের মূল দেবতা রামচন্দ্র ওরফে রঘুনাথ।
বড়ো গোস্বামীবাড়ির আদি রথটি ছিল লোহার, প্রায় পঞ্চাশ ফুট উচ্চতা। দেড়শো বছর আগে সেই রথটি নষ্ট হয়ে গেলে একটু অপেক্ষাকৃত ছোটো কাঠের রথ তৈরি করা হয়েছিল। কালের নিয়মে সেটিও নষ্ট হলে ফের একটি লোহার রথ তৈরি করা হয়। রথের দিন গোস্বামীবাড়ি থেকে রঘুনাথ, জগন্নাথ-সহ বিভিন্ন বিগ্রহকে রথের কাছে নিয়ে আসা হয়। রথের একদম শীর্ষে রঘুনাথ-সহ জগন্নাথদেব, বলভদ্রদেব ও সুভদ্রাদেবীকে বসানো হয়।
আরও পড়ুন: কোভিডের আবহেই সপরিবার ঘুরে এলাম ঝাড়গ্রাম, আপনারাও বেরিয়ে পড়ুন
এ বছর রথের ছবিটি সম্পূর্ণ আলাদা এই করোনার জন্য। বড়ো গোস্বামীবাড়ির রথ পথে বের হল না। শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য রথের সামনে শালগ্রামশিলা এনে পুজো হল। তবে প্রাচীন নিয়ম মেনেই পুজো হয় বড়ো গোস্বামীবাড়িতে।
শুধুমাত্র বড়ো গোস্বামীবাড়িই নয়, সাহাদের বাড়ির রথও বিখ্যাত এই শান্তিপুরে। গোস্বামীদের অনুসারী ভক্ত জমিদার হীরালাল সাহা দেড়শো বছর আগে রথযাত্রা শুরু করেছিলেন। এই বাড়ির রথযাত্রা হীরালাল সাহা শুরু করলেও জনপ্রিয় হয়েছিল কুঞ্জবিহারী সাহার আমলে। প্রায় ১৬ ফুট উচ্চতার কাঠের রথ বের হত সাহাবাড়ির মন্দির থেকে, তবে তার বদলে এখন লোহার রথ নামে। এ বছর ভক্তিসহকারে পুজো হল সাহাবাড়িতেও, তবে ভক্তসমাগম হয়নি। এই বাড়িতে প্রথমে শ্রীশ্রীজগন্নাথের রথ হলেও পরে রথের মধ্যমণি হন শ্রীরঘুনাথ।
এ ছাড়া মধ্যম গোস্বামীবাটীর রথযাত্রাও বহু প্রাচীন। এই রথ উৎসবেরও মূলে রয়েছেন রঘুনাথ। রঘুনাথের পাশাপাশি জগন্নাথও থাকেন রথে। তাই বলাই যায়, আমরা সাধারণত যে রথযাত্রা অন্যত্র দেখি তার থেকে শান্তিপুরের রথ সত্যই আলাদা। শান্তিপুরের রথ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে বহু প্রাচীন কাল থেকেই।